হ্যারি |
ক্লাস ঘরে পোষা
পাইথন
বসুধা
মুখোপাধ্যায়
শিক্ষিকা,
সান ফ্রানসিসকো
চোখের সামনে দেখলাম, ক্লাসঘরের টেবিলের তলা
থেকে বেরিয়ে এল ইয়া
তাগড়াই একটা পাইথন!
জঙ্গলি নয়, আমারই কলিগ কেমিস্ট্রির টিচার
বিন-এর পোষ্য!
এটুকু পড়ে, নির্ঘাত ভেবে বসছেন, টেনিদা, কী
ঘণাদার গপ্পো ফাঁদছি।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমেরিকায় আমার আড়াই দশকের
প্রবাস-জীবনে অত্যাশ্চর্য বহু বহু ঘটনার মধ্যে এ এক নির্জলা সত্যি, জলজ্যান্ত
ঘটনা!
তেইশ বছর হয়ে গেল দেশ ছেড়ে এখানে। প্রথমে
ছিলুম লস এঞ্জেল্স-এ। তারপর সান ফ্রানসিস্কোর কাছে একটা শহর, হেওয়ার্ড-এ। তা’ও কুড়ি
বছর হয়ে গেল। হাই স্কুলে অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াই।
বছর দুই আগের কথা।
সে ঘটনায় যাওয়ার আগে একটা ব্যাপার বলে নেওয়া
দরকার। এখানে হাই স্কুল এডুকেশনটা সেমিস্টারে-সেমিস্টারে ভাগ করা থাকে। দু’টো
সেমিস্টার। সেশন শুরু হয় জানুয়ারিতে। তারপর জুন-জুলাই-অগস্ট টানা গরমের ছুটি।
তারপর আরেকটা সেশন।
প্রতি সেমিস্টারের শেষে ছাত্রছাত্রীদের জন্য চোদ্দ দিন করে স্পেশাল ক্লাস-এ টিচিং দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কমজোরি মানে, যারা পাস করতে পারেনি, তারা থাকে। আবার হয়তো কেউ অসুস্থ ছিল বলে, বা অন্য কোনও কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি, তারাও। সোজা কথায়, পরীক্ষায় উতরোতে না পারলে তো কলেজে যেতে পারবে না, গ্র্যাজুয়েট হবে না। তাই এই ব্যবস্থা।
টেবিলের তলা থেকে বেরোলো হ্যারি |
টিচারদের জন্য এই সময় ক্লাস নেওয়াটা
বাধ্যতামূলক নয়। কারণ সময়টা তো ‘ব্রেক’। অনেক টিচারই এ সব ক্লাস করে না। কিন্তু
আমি প্রায়ই করি। আসলে আর কিছু না হোক, টানা ছুটির একঘেয়েমিটা থাকে না। বাড়তি কিছু
রোজগারও হয়।
ঘটনাটা ঘটেছিল একটা গরমের ছুটিতে। দিনটা
শুক্রবার। জুন মাসের ১০ তারিখ নাগাদ স্পেশাল ক্লাস শুরুর আগে একটা দিন থাকে টিচাররা
সেদিন পড়ানোর জন্য সারাদিন কপি-টপি করে, কমপিউটার সারাই এ সব হয়-টয়। আমিও সে বার এ
ভাবেই তৈরি হচ্ছি। তবে তা আমার ঘর নয়, অন্য টিচারের ঘর।
এখানে বলে রাখি, এখানে টিচারদের নির্দিষ্ট ঘর
থাকে। তাঁরা সেই ঘরেই ক্লাস নেন। ছাত্রছাত্রীরা প্রত্যেক ক্লাসের শেষে সাবজেক্ট
অনুযায়ী টিচারের ঘরে আসে। টিচারদের কোথাও যেতে-টেতে হয় না।
আমাদের স্কুলটা বেশ বড়। প্রায় হাজার চারেক
স্টুডেন্ট। দো’তলায় পুরোটা বিভিন্ন সায়েন্স টিচারের ঘর। আমার রুম নম্বর যেমন ৭১৬।
গরমের ছুটিতে প্রায়ই ঘরে-ঘরে কিছু পরিচর্যার
কাজ চলে। দেওয়াল, মেঝে, ইলেকট্রিক লাইন, স্যানিটাইজেশন। তো, সে বার আমার ঘরে তেমনই
কিছু হচ্ছিল বলে আমায় কেমিস্ট্রি টিচার বিন-এর ঘরে ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
সেখানেই প্রস্ততি নিচ্ছিলাম।
তখনই আমার বহু দিনের বন্ধু গ্রিফিন ঘরে এল।
এসেই বক বক বক বক করেই যাচ্ছে। এ দিকে আমার কিছু কাজ তখনও পড়ে। কাজ করছি, আর কথার
পিঠে হুঁ-হ্যাঁ করে কথা মেলাচ্ছি। গ্রিফিন বোধহয় তাতে একটু ‘বোর’ হচ্ছিল। ও চলে
যাচ্ছিল। হঠাৎ যাবার সময় একটা কোণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘বসুধা, ওটা কী? একটা খাঁচা
দেখছি! কীসের ওটা?’’
আমি একটু উদাস হয়েই বললুম, ‘আমি কী করে জানব?
আমি তো এ ঘরে ক্লাস নিই না।’ আসলে আমার তখন খুব তাড়া। বারবার ঘড়ি দেখছি। মনে মনে
ভাবছি, গ্রিফিন গেলে হয়!
ও তখন দেখি বেশ উত্তেজিত। ভয়ার্তও। বলল,
‘‘আরে কী বলছ! ওটা তো একটা জন্তু-টন্তুর খাঁচা! আর খাঁচাটা খোলা, দেখে মনে হচ্ছে
সদ্য ওটা পালিয়েছে।’’
এইবার আমি ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম।
‘মানে? কী-ই-ই বলছ? জন্তু? কী হতে পারে?
পালিয়েছে মানে?’
প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বিন-কে ফোন করলাম।
‘হ্যালো বিন, ওটা কীসের খাঁচা? তোমার ঘরে?’
ও দিক থেকে শান্ত গলা ভেসে এল বিন-এর, ‘‘ও
কিছু নয়। ওটা আমার পুষ্যি, হ্যারির।’’
‘কে হ্যারি?’
‘‘আমার পাইথন।’’
শুনে আমার তো তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ার দশা!
বিন-এর মাথায় হ্যারি |
‘মানে? কী বলছ তুমি! পাইথন?’’
শুনে গ্রিফিনের উল্টে পড়ে যাওয়ার দশা।
বিনকে বললাম, ‘তুমি জানো? ও পালিয়েছে!
খাঁচাটা খোলা?’
একই ভাবে বিন বলল, ‘‘চিন্তা করো না, হ্যারি খু-উ-ব ঠান্ডা। কিচ্ছু করে না। আমি আসছি।’’
এ দিকে গ্রিফিন সব শুনেটুনে ধাঁ। আমার পড়াশুনো
মাথায়। চেয়ারের ওপর পা তুলে জড়সড় হয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। ততক্ষণে সাতটা ঘণ্টা পেরিয়ে
গিয়েছে, ও ঘরে থাকার। বিন-এর হ্যারি নিশ্চই আমায় দেখেছে। তার মধ্যেই চুপিসাড়ে
পালিয়েছে। ফিরে এসেও দেখবে। তখন?
টেক্সট করলাম বিন-কে, ‘‘তুমি কোথায়? এখনই এসো।
আমি কিছুতেই আর ক্লাস নিচ্ছি না এখানে। আমি কি পাগল!’’ ও তখনও দেখি, হ্যারির
গুণগান করে চলেছে।
ধ্যাত্তেরি!
মিনিট কুড়ির মধ্যে বিন এল। ঝুড়ি-টুড়ি নিয়ে। এ
দিক ও দিক খুঁজল তার পুষ্যিকে। কোথায় কী! আমি তার মধ্যেই ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে
পরিষ্কার পালালাম, যাকে বলে!
ডিস্ট্রিক্ট-কে মেল করলাম পুরো ঘটনা জানিয়ে।
ডিস্ট্রিক্ট হল, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিস বলা যেতে পারে। সোজা লিখে দিলাম, ‘‘যদি সাপ
না বেরয়, আমি সোমবার থেকে আসছি না।’’
শুনে ডিস্ট্রিক্টের তো মাথায় হাত। জনা পঁয়ত্রিশ
ছাত্র, তাদের পড়াবে কে? আমায় আশ্বস্ত করে-টরে বলা হল, চিন্তা নেই। সোমবার লোকজন
থাকবে।
অগত্যা গেলাম সোমবার। কিন্তু তখনও সেই খাঁচা খোলা। নো হ্যারি। এ দিকে সকাল সাড়ে আটটা থেকে ক্লাস শুরু। তখন ঘড়িতে প্রায় আটটা। ছাত্ররা আসতে শুরু করেছে। আমায় বলা হয়েছে, কাউকে কিছু না বলতে। সবাই জেনে গেলে তো হট্টগোল শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু সে নয় হল, এ দিকে আমার তো খাঁচা ছাড়া! লোকজন খুঁজেই চলেছে। হ্যারির কোনও পাত্তা নেই।
ক্লাস শুরু হয়-হয় প্রায়। তখনও লোকজন বাইরে
দাঁড়িয়ে, যদি হ্যারি বেরয়!
হঠাৎ ল্যাব টেবিলের নীচ থেকে বেরিয়ে এল প্রায়
সাড়ে তিন ফুট লম্বা ডোরকাটা পা-ই-থ-ন!
লোকজন পড়িমড়ি করে তাকে কোনওক্রমে পাকড়ে কী করে
যে খাঁচায় ভরল, সেটুকু দেখার মতো অবস্থা তখন আমার ছিল না।
এই দীর্ঘ প্রবাসে ঘাড়ের কাছে অমন হিলহিলে আতঙ্ক
নিয়ে ঘর-করার দুঃস্বপ্ন আমি আজও ভুলতে পারিনি।
বিনকে জোরদার জবাবদিহি করতে হয়েছিল
ডিস্ট্রিক্টের কাছে, এটুকু বলতে পারি।
একদম অভিনব অভিঞ্জতা। এসব ওখানেই সম্ভব। লেখাও খুব ভালো লাগলো।
ReplyDelete