এই সেই খুলির সারি |
পৌঁছে গেলাম নরমুন্ড শিকারিদের গাঁ ১ম পর্ব
অভিজিৎ দাশগুপ্ত
এসআরএফটিআই-এর প্রাক্তন ডিন, দূরদর্শন-এর প্রাক্তন স্টেশন অধিকর্তা, তথ্যচিত্র নির্মাতা
এখনও সেই মানুষটির কথা, তার কালো কালো দাঁত, দপদপে চোখগুলো ভুলতে পারিনি!
সামনে দাঁড়িয়ে সে বলে চলেছে, ‘‘অনেক দিন আগে একটা মেয়েকে মেরেছিলাম। কাঠে লাগানো চুলগুলো দেখছেন, ওটা ওই মেয়েটার মাথার। ওটা চড়িয়ে আমি মুন্ডু শিকার করতে বেরোতাম। ঊরুর পেশিতে চুলের ছোঁয়া লাগলেই রক্ত টগবগ করত।’’
সময়টা ১৯৬৮-৬৯।
আমি তখন স্টেট্সম্যান পত্রিকায় ফটো জার্নালিস্ট। চাকরি করি।
জুনিয়র স্টেট্সম্যান-এর এডিটর তখন ডেসমন্ড ডয়েগ। তবে সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। ডেসমন্ড লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক, পর্বত অভিযাত্রী, অসম্ভব অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ। উনি যেমন জন হান্টের দলে তেনজিং নরগে, এডমন্ড হিলারির সঙ্গে এভারেস্টে গিয়েছিলেন, তেমনই বহু অ্যাডভেঞ্চার করেছেন।
তরতর করে নেপালি ভাষা বলতেন। নাগামিজ বলতেন।
নাগাল্যান্ডের ‘হেড হান্টার্স’ গ্রাম নিয়ে একটা ‘স্টোরি’ করার অফার পান ডেসমন্ড। কোথা থেকে পেয়েছিলেন বলতে পারব না। তবে অবশ্যই বিদেশের কোনও একটা ম্যাগাজিন সংস্থার দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট। এ দিকে উনি ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। আর সেই সময় আন্ডারগ্রাউন্ড নাগা মুভমেন্ট চলছে। ফলে ডেসমন্ড নাগাল্যান্ড যাওয়ার অনুমতি পেলেন না। তাতেই আমাকে পাঠানোর কথা ভাবেন ডেসমন্ড।
ডেসমন্ডের বেশ কিছু বন্ধু ছিল নাগাল্যান্ডে।
তার একজন আকুম ইমলং। আকুম ছিলেন তুয়েংসাং-এর মন্ত্রী। তুয়েংসাং একটা জেলা। সেখানে পৌঁছনো খুব একটা কষ্টের ছিল না। কিন্তু সেখান থেকে আমায় যেতে হবে মন এবং চুই গ্রাম। আগে পড়বে মন, তারও অনেক ভেতরে চুই। দু’টো গ্রামই পরিচিত ‘হেড হান্টার্স ভিলেজ’ হিসেবে। নরমুন্ড শিকারিদের গাঁ। আর এই দু’টোতেই যাওয়া ছিল ভীষণ কষ্টের। জিপ যেত না। শেষ ২০ কিলোমিটার মতো হাঁটা।
তো, ডেসমন্ড একদিন আমায় ওঁর বাড়িতে ডাকলেন।
দুপুরে লাঞ্চ করলাম ওঁর সঙ্গেই। সে সব মিটলে পুরো ব্যাপারটা শুনিয়ে বললেন, “বার দুয়েক যেতে হতে পারে। কিংবা তার বেশিও।”
এক কথায় রাজি আমি।
পিঠোপিঠি বেদি আর আমি |
কাজটা হল, নাগাল্যান্ডে গিয়ে আমায় কিছু স্টিল শ্যুট করতে হবে। বিশেষ করে ওই নরমুন্ড শিকারিদের গ্রামে। এই বিষয়টায় ডেসলার প্রচন্ড আগ্রহ। ডেসমন্ডকে আমরা ছোট করে ‘ডেসলা’ বলতাম।
ডেসলা বললেন, পুরো ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নেওয়ার জন্য আমাকে আগে একবার কোহিমা যেতে হবে। সেই আমার প্রথমবার নাগাল্যান্ড যাওয়া।
তো, গেলাম কোহিমা।
আকুমের একটা গেস্ট হাউস ছিল। সেখানেই উঠলাম। বিশেষ করে আকুমের কাজ ছিল ‘আমি কোনটা করব আর কোনটা করব না’ এই নিয়ে ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া। এই বাধানিষেধের ঘেরাটোপ আমার কোনওকালে পোষাত না। সেই দফাতেও তাই। খোদ আকুমেরই অবাধ্য হয়ে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলাম।
সে অবশ্য অন্য গল্প।
ডেসলা কয়েকটা চিঠি করে দিয়েছিলেন আমায়। নাগাল্যান্ডে হাই-প্রোফাইল লোকেজনকে ‘অ্যাড্রেস’ করে লেখা। আমার কাজ ছিল তাঁদের সঙ্গে দেখা করে নাগা রীতি রেওয়াজ সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়া।
করলাম দেখা। প্রত্যেকেই আমাকে বেশ কয়েক ঘণ্টা করে সময় দিলেন।
কম বেশি সবাই বললেন, “যদি নাগা অধিবাসীদের সঙ্গে বন্ধুভাবে না মিশে যেতে পারেন, তাহলে আপনি যে ‘ইন্ডিয়া’ থেকে আসছেন, এই পরিচয় আপনাকে সমস্যার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।”
ফিরে এলাম কোহিমা থেকে।
এর মাস তিন পর। আবার ন্যাগাল্যান্ড যাব।
হঠাৎ একজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম। বাসুদেব মুখোপাধ্যায়। আমার বন্ধু-মানুষ। খুব অন্যরকম। ট্যুরিস্ট স্পট দেখার বদলে তিনি আমার বিপজ্জনক পথের শরিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা দুজনেই জানি না কার কপালে কী আছে! শুধু জানি, নিশ্চিত বিপদ আর চূড়ান্ত অস্বাচ্ছন্দ্য ওত পেতে আছে যাত্রাপথে।
জোড়হাটে পৌঁছে শুনলাম, মোককচুং যাবার কোনও যানবাহন পাওয়া যাবে না। কী করি? হঠাৎ খেয়াল হল, আমার বাবার এক বন্ধু জোড়হাটের উকিল। যোগাযোগ করলাম। জানতে পারলাম ওঁর এক ক্লায়েন্ট আছেন যিনি মোককচুং-এ মেটিরিয়াল সাপ্লাই দেন। তাঁর একটা ট্রাক আছে। কিন্তু সেই ট্রাকের ড্রাইভার ছুটিতে। কবে ফিরবেন, কখন ফিরবেন, তিনি কিছুই জানেন না।
কানে কার্তুজ |
শুধুমাত্র তাঁর মালপত্র মোককচুং পৌঁছে দেব আমরা, এই শর্তে তিনি আমাদের ট্রাক দিতে রাজি হলেন। মেনে নিলাম শর্ত। ট্রাক ছুটল মোককচুং-এর পথে।
পাকদণ্ডি পথের বাঁকে মুখিয়ে আছে বিপদ আর বিপর্যয়ের ভয়। তবু ট্রাক চলল। পৌঁছেও গেলাম মোককচুং।
মোককচুং থেকেই যেতে হবে টুয়েনসাং-এর মন আর চুই গ্রাম।
রাস্তা বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, এখানে তার কোনও অস্তিত্বই নেই। দেখা হল রাজেন্দর সিং বেদির সঙ্গে। এক্সট্রা অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার। একদম ইয়ং সর্দারজি। আমাদের থেকে বয়সে বোধ হয় সামান্য বড়। আমাদের মতোই পাগল।
তাঁরই জিপে চড়ে বসলাম।
চারদিকে ঘন জঙ্গল। জিপ চলল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। জিপের ড্রাইভার ভীম। ওঁর নাম বোধহয় অন্য কিছু, কিন্তু বেদি তাকে ‘ভীম’ বলেই ডাকছিলেন।
পাহাড়ী রাস্তায় ধীর গতিতে চলছিল গাড়ি। ব্রেক কাজ করছে না। ভীম খুব চেষ্টা আর কসরত করাতে মাঝে মাঝে ব্রেকটা সাড়া দিচ্ছিল, এই যা!
ভীম বলল, ‘‘মাত্র পাঁচবার পাম্প করেছি স্যার।’’
সাত-আটবার টায়ার-ই পাংচার হয়ে গেল। কোনও বাড়তি টায়ার সঙ্গে নেই। প্রতিবার ভীম টায়ার মেরামত করছে।
জংলা পথে জিপটাকে আর টানবার শক্তি ছিল না ন্যাড়া-ন্যাড়া টায়ারগুলোর। একে পাহাড়, তার ওপর কাঁচা মাটির রাস্তা। বারবার জিপ থেকে নেমে ধাক্কা দিতে হচ্ছে।
এভাবেই পাহাড়-পথে বারবার গাড়ি ঠেলা |
গন্তব্যে পৌঁছলাম এ ভাবেই। জায়াগাটার নাম নাগিনী মোড়া। এখান থেকে মন গ্রামটা হাঁটা পথ। বেদির দু’কামরার ছোট ঘর। তাকে ছাউনি বললেই ঠিক হয়। একটা কামরায় তাঁর অফিস। আর অন্যটা শোবার ঘর। সেখানেই আমরা সবাই একসঙ্গে রয়ে গেলাম।
বেশ অনেক দিন রইলাম সে বার।
হাঁটতে হাঁটতেই আশেপাশের গ্রামগুলোয় যেতাম। চড়াই-উতরাই ভাঙতে হত রোজ। মাইলের পর মাইল।
গ্রামগুলোয় এক ধরনের পানীয় খেতে দেওয়া হত আমাদের। স্থানীয় পানীয়। ‘মধু’, এক ধরনের ওয়েলকাম ড্রিংক, আর কী! ওটা নেওয়াটাই রীতি। ফিরিয়ে দেওয়া মানে, ওদের আহত করা।
ওদের চোখমুখে উল্কি আঁকা। কানের লতিতে .১২ কার্তুজ। আমাদের দিকে ওরা তাকিয়ে থাকে কৌতূহলীর চোখে। গ্রামে গ্রামে কুঁড়েগুলোয় সারাক্ষণ উনুন জ্বলে। প্রায়ই দেখি উনুনের আগুনে কিছু না কিছু পোড়ানো হচ্ছে।
আমাদের বন্ধু বেদি |
একদিন এক গ্রাম। সে গ্রামের মোড়লের বাড়ি গিয়েছি। মোড়লকে ওরা ‘আং’ ডাকে। আং আমায় খাবার জন্য কিছু একটা হাতে দিলেন। নিয়ে দেখি, একটা পোড়া ইঁদুর! কিছুক্ষণ আগেই যা আগুনে ঝলসাতে দেখেছি, আসার সময়। বেদি আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘‘ডোন্ট রিফিউজ।’’
এ’ও হল নাগাদের এক ধরনের পরীক্ষা। যেখানে আমাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে।
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল।
আমরা সেই গ্রামের প্রধান মাথা-শিকারির ঘরে পৌঁছলাম। আলাপ পরিচয়-পর্ব মেটার পর তিনি আমাদের অনেকগুলো কাঠের র্যাকের সামনে নিয়ে গেলেন।
মুখে গর্বের হাসি।
আমি গুনতে শুরু করলাম। দেখলাম তিনশো’র বেশি আছে। কী?
মানুষের খুলি!
এরপর ২য় ও শেষ পর্বে
(লেখকের ‘আ ক্যানডিড ক্যানভাস’ ইংরেজি বইটির প্রকাশিতব্য বাংলা গ্রন্থ থেকে নেওয়া। যার অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।লেখক ৬০-এর দশক থেকে সাংবাদিকতায়। ’৭০-এর গোড়া থেকেই টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এফটিটিআই (পুণে)-এর প্রাক্তনী। বিবিসি লন্ডন, এআইবিডি মালয়েশিয়া, এনডিআর জার্মানি, এবিসি অস্ট্রেলিয়া-য় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। নির্মিত তথ্যচিত্রের জন্য ২টি জাতীয় পুরষ্কার ও ২৮টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছেন)
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment