Saturday, July 4, 2020

জীবন যে রকম ২ - সাধের কাটিং খাতা - দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

সাধের কাটিং খাতা

দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
সাংবাদিক, কলকাতা


রোগটা অনেকেরই ছিল। শুধু আমার না। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে জন্মানো আমার দাদাদের তো বটেই। পাড়াপড়শিরও কারও কারও। ইস্কুলেও দেখতাম তাই-ই।

রোগ বলব, নাকি নেশা? আত্মা ফুঁড়ে দেওয়া নেশা! প্রথম প্রেমের মতো বোমভোলা করে দেওয়া টান? রাতবিরেতের নিশিডাক? কো‌নটা যে!

সক্কালবেলা কাগজ এল কী, খেলার পাতাটা খুলে গোগ্রাসে গেলা থেকে ছকটা শুরু হয়ে যেত। তারপর এক-দু’দিন গেল কী, পুরনো কাগজের তবিল ঘেঁটে খচাখচ, কচাকচ। তখনও ‘কাটিং’ শব্দটা জানতুম না। কী বলতুম, মনেও পড়ে না। কিন্তু পছন্দের ছবি, লেখা কেটে কেটে গঁদের আঠা মাখিয়ে পটাপট খাতায় সেঁটে দেওয়াতে সে যে কী গৌরব, আহা!

গঁদের আঠা বললুম, না? হুম। তাই। গঁদের আঠা। আটায় জল মিশিয়ে আগুনে জ্বাল দিয়ে ‘হোম-মেড’ ‘চুটকি মে চিপকাও’। তখন কোথায় ফেভিকল! ফেভিক্যুইক দূর কী বাত্‌! গঁদের শিশি পাওয়া যেত বটে, টিউবওয়ালা ‘জেম’ কোম্পানির আঠা আসতেও দেরি। আটাগোলা আঠাই ঢের।

হঠাৎ টনি, আমার বন্ধু একবার বলল, ‘‘শোন শুধু আঠা দিস না। একটু তুঁতে দিস সঙ্গে। নইলে পোকায় খাবে।’’

ও এসব জানত। ওরা ঠোঁঙা তৈরি করে বাজারে বেচত যে!

কিন্তু তুঁতে? সে কোথা পাই। আর সে তো বিষ! টনিই জোগাড় করে দিল। বাড়ি থেকেই হাপ্‌তা মেরে বন্ধুকৃত্য সারল আর কী!

তখনও ছোড়দা বেঁচে। আমি আর ছোড়দা কত যে দুপুর পার করেছি ওই কাটাকুটি আর সাঁটাসাঁটিতে। ছোড়দা, আমার খুড়তুতো দাদা। ছোটবেলায় অতশত বুঝতাম না, কে খুড়তুতো, কে জ্যাঠতুতো। পাড়াতুতোও গুলিয়ে দেয়নি ভালবাসাকে!

ছোড়দা, মা‌নে ছোড়দা। আমার চেয়ে ছ’বছরের বড়। ছোড়দার দাদা, আমার বড়দা। বড়দা আমার চেয়ে বছর ষোলোর এগিয়ে। বড় হয়ে বড়দার কাটাকুটির শখ তখন তলানিতে। তার সদ্ব্যবহার করে ছোড়দা একদিন বড়দার খাতা হাতিয়ে নিল চুপিচুপি।

ও হো! সে পুরো রাজ্যজয়ের আনন্দ! দু’জনে টগবগ করে ফুটছি। হাত-পা ছুঁড়ছি। আবার লাগাম দিচ্ছি মুখে। যদি পাঁচ-কান হয়ে লুঠ করা সাম্রাজ্য আবার বেহাত হয়ে যায়! খাতা তো যাবেই, ছাতার পেটাই-ও জুটতে পারে।

তবে আমাদের লাফালাফির কারণটা কিন্তু খুব সাচ্চা।

আসলে আমরা তো গাভাসকার-বিশ্বনাথ, বড়জোর ওয়াদেকার-

পাতৌদিদের পাই। সুরজিৎ সেনগুপ্ত, সুধীর কর্মকার, হাবিব-আকবরদের পাই। বড়দার খাতায় যে ট্র্যুম্যান, পিটার বার্জ, রে ইলিংওয়ার্থ...! ও দিকে থঙ্গরাজ, নইম, পিকে, বলরাম...!

উফ্‌ফ্‌! ভাবা যায় না! ছোড়দা আর আমি বসার ঘরে সেদিন সাইলেন্টলি হরির নেত্য করেছিলুম। পরদিন ইস্কুল-ব্যাগে সেই খাতা নিয়ে গিয়ে কী ‘রেলা’!

’৭৩-এর ৯ মে। ছোড়দা চলে গেল।

ও তখন ক্লাস এইট। ইস্কুলে বাস্কেটবল খেলছিল। বলটা আটকে গিয়েছিল জা‌লে। পাঁচিলে উঠে কেউ কেউ পাড়ছিল। ছোড়দার মতো নীচে দাঁড়িয়েছিল আরও ক’জন। ভাঙা পাঁচিল পিষে দিয়েছিল পনেরো বছরের যে কিশোরটাকে, সে আমার শৈশব-কৈশোরের ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী!

টানা দু’দিন আমি মাকে জড়িয়ে বসেছিলাম দালানে। কখন খাইয়ে দেওয়া হত, কখন ঘুমোতাম, জানতামই না। বেহুঁশ, অসাঢ়! শুধু মনে পড়ে, যখনই চটকা ভাঙত, জড়ানো গলায় মাকে কেবলই বলতাম, ‘‘তুমি কেঁদো না মা, আমি আর খেলতে যাব না, দেখো।’’

ধীরে ধীরে যখন মায়ের কোলটা ছেড়ে দাঁড়ালাম, ছোড়দার গন্ধটা খুঁজতাম সারা বাড়িতে।

ওর ঘুড়ি, লাটাই, চরকায় হাত বোলাতাম।

ওর পাজামা, স্যান্ডো গেঞ্জিতে মুখ ঘোষতাম।

আর সেই থেকে বুকে জাপটে ধরে রেখে দিয়েছি ওর-আমার সাদা-কালো ছবির দেশটাকে। আমাদের ভালবাসার রাজপ্রাসাদটাকে।

ক’দিন পরে ওরই আঁকার তুলিতে রং বুলিয়ে বুলিয়ে বাঁধভাঙা বর্ষায় ভিজতে ভিজতে যে খাতার ভেতরের পাতায়, কী জানি কী মনে করে লিখেছিলাম, ‘বিশ্বদেব স্মরণে’! ছেলেকে নিয়ে এই দু’টো অক্ষর স্ট্যাম্প-প্যাডে ধরল আমার সন্তান-হারা কাকা। তার ছাপটাও ধরে রাখলাম খাতায় ‘বিশ্বদেব স্মরণে’।

বিশ্বদেব, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়।

আমার ছোড়দা।

আমার ছোটবেলার হিরো।

আমার আইডল।

আমার বুকের গভীরে কাটাকুটি বুনে দেওয়া রাজা। 


1 comment:

  1. নস্টালজিয়া মিশে আছে প্রতি শব্দে!

    ReplyDelete