কৌশিক দাশগুপ্ত
শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক
গন্তব্য এম কে লজ, কানহা। মধ্যপ্রদেশ।
গোনডিয়া থেকে প্রায়
তিন ঘণ্টার পথ। খাপড়ার চাল দেওয়া ঘর, সোনালি ধানের ক্ষেত— ব্যস্ত কাস্তে ধরা কৃষক রমণীর
হাত। জ্বালানি কাঠ বাছতে থাকা জরতি ট্রাইবাল বৃদ্ধা....
নিখাদ জঙ্গলের মধ্যে
দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে আমাদের ট্র্যাভেরা।
গণগনানো রোদ-ঝাঁকড়া মাথাওয়ালা গাছগুলো যে ছায়ার মাদুর পেতে রেখেছে জায়গায় জায়গায়, তাতে বসবার জো নেই। তিনটে থেকে সাফারি শুরু। খাওয়ার ডাক পড়েছে। এরপর ট্যুরিস্টদের ভিড় শুরু হবে। যেতে হবে।
খোলা জিপসিতে বৈকালিক কানহা সফর।
মূলত শাল, কেন্দু আর বাঁশের জঙ্গল।
মাঝখান দিয়ে সামান্য
উঁচু নিচু ঘাসের বর্ডার দেওয়া, এবড়োখেবড়ো রাস্তা।
গাড়ি চলার জন্য।
পাখির শিস, পাতার মধ্যে দিয়ে অবিরত বয়ে চলা হাওয়ার সরসর শোনা যায় গাড়ি
সাইটিং-এর জন্য থামলে। নইলে গাড়ির মৃদু মার্জার গরগরানি জঙ্গলের নৈঃশব্দকে তার সমগ্র
সজীবতায় ধরে রাখে। প্রতি মুহর্তে প্যালেট উপচে পড়া রং, ক্যানভাস, ইজেল, ব্রাশের
খেলা চলে চারপাশে।
চনমনানো হাওয়ায় ভেসে আসা বনজ ওষধির সঞ্জীবনী সুঘ্রাণ আমাদের পথশ্রম ভুলিয়ে দিচ্ছিল নিমেষে। তৃণভোজনরত স্পটেড ডিয়ার, বারাশিঙ্গার পাল মনে করিয়ে দিল এদের খাদকেরা আছে জঙ্গলের মধ্যেই কোথাও।
বানর আর বার্কিং
ডিয়ারের বিশেষ একটি ডাক বাঘের উপস্থিতির সতর্কীকরণ। সেই ডাক শোনা গেলেই ড্রাইভার প্রতাপের
তর্জনী ঠোঁটে। উন্মুখ, উত্তেজিত, নৈঃশব্দ্য। নিঃশব্দ গাড়ি অনেকবার এগোলো, পিছোলো। প্রতাপের চেষ্টায় কোনও খামতি ছিল না। কিন্তু উলটো
দিকে যে তিনি অধিকতর প্রতাপাণ্বিত! ফলে...
অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স।
দেখা পাওয়া গেল না তাঁর।
অন্য সবার সঙ্গে সঙ্গে হতাশা আমাকেও ছুঁয়ে গেল মুহূর্তের জন্য।
তারপরেই মনে হল,
শেষ হাসি বা গর্জনটা না হয় তাঁর জন্যই তোলা থাক। শিকারি শ্রেষ্ঠকে ক্যামেরায় শিকার
করার জন্য যখন আমরা জঙ্গল চষে ফেলছি, তিনি তখন হয়তো কোনও দুর্ভেদ্য ঝোপের আড়ালে একটু
গড়িয়ে নিচ্ছেন রাতের শিকারের প্রস্তুতিতে।
মনে হল, নাই’বা দেখা
গেল তাঁর দৃকপাতহীন আলস্য মন্থর চলন। তাঁকে দেখতে না পাওয়ার অর্থ, তিনি তাঁর মর্জির
শাহেনশাহ; পয়সা দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে তাঁর সাম্রাজ্যে
ঢুকেছি বলেই বাধ্যতামূলক দর্শন দিতে বাধ্য নন।
তাঁর অনুপস্থিতির
মধ্যে দিয়েই তিনি রাজকীয় ভাবে উপস্থিত,
অন্তত আমার কাছে।
এ তল্লাটের
জঙ্গলি বর্ণমালা বলে, দেখা দিলেন না বটে, কিন্তু দেখে চলেছেন তিনি অবিরাম আপনাকে।
এক সময় মনে হল, দেখতে চাওয়াটা যেন বড় বেশি সোচ্চার, বিধৃত, চিৎকৃত, আগ্রাসী। কিন্তু তাঁর চলার, বেঁচে থাকার, ঝোপেঝাড়ে অবয়ব ঢেকে রাখার মধ্যে কোথায় যেন এক কাব্যিক সংযম এবং রহস্যময়তা জড়িয়ে।
সেই সংযম ও রহস্যের অলিগলিতে যে ছমছমানি, যে অনিশ্চয়তা, সময়কে অসময়, অসময়কে সময় করে নেওয়ার স্পর্ধা, তা তো তাঁরই নিজস্ব ভঙ্গি। হয়তো’বা দেখাকে শেখানোর তরিকাও বটে!
তা’ই বা কম কী সে!
ছবিঃ লেখক ও কৌশিক বসু
No comments:
Post a Comment