বঙ্কিমের জীবনে
দুই নারী ২য় পর্ব
অনিরুদ্ধ সরকার
সাংবাদিক, কলকাতা
মোহিনীকে তাঁর পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়!
যুবক পুত্রের এই মৃয়মান অবস্থা দেখে তাঁর বাড়ির লোকজনও আশঙ্কিত। আট মাস কেটে গেল। দ্বিতীয় বিবাহ হল বঙ্কিমের।
কন্যার নাম রাজলক্ষ্মী। নিবাস হালিশহর।
পিতার নাম সীতারাম বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজলক্ষ্মীও গুণবতী। সুন্দরী তো বটেই। বিয়ে তো করলেন, কিন্তু ভাল কি বাসতে পেরেছিলেন দ্বিতীয়া স্ত্রীকে? এ নিয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়।
মোহিনীদেবীর সেই যে দুল, কাঁটা— ও দু’টি বঙ্কিম বহুকাল নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন। অন্য অলঙ্কার দিলেও মোহিনীকে দেওয়া গহনা কিছুতেই না। রাজলক্ষ্মীকে বলেছিলেন, ‘‘এগুলি এখন আমার কাছেই রইল। যে দিন তোমায় ভালবাসিব, সে দিন দিব।’’
রাজলক্ষ্মী দেবী |
চার বছর কেটে গেল। রাজলক্ষ্মীর কোলে এল কন্যা সন্তান। নাম রাখা হল শরৎকুমারী। শরৎকুমারীর জন্মের তিন মাস পর সেই অলঙ্কার রাজলক্ষ্মীর হাতে তুলে দিলেন বঙ্কিম!
সেই তুলে দেওয়ার ঘটনাটিও বেশ প্রেম-জর্জর! কী এক কারণে বঙ্কিম চলেছেন নৌকায়। সঙ্গে স্ত্রী। এক ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে রাজলক্ষ্মীকে তখনই সেই দুল আর চুলের কাঁটা নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
এই সময় থেকেই সম্ভবত বঙ্কিম-রাজলক্ষ্মী সম্পর্ক নয়া মোড় নেয়। রাজলক্ষ্মী ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বঙ্কিমের যথার্থ সঙ্গিনী!
বড় চাকুরে ছিলেন বঙ্কিম। কিন্তু সংসারের দায়ভার এতটাই যে মোটা উপার্জনেও যেন কুলিয়ে উঠত না। একান্নবর্তী পরিবার। ভাইদের সংসারও অনেকটা তাঁকেই টানতে হয়। তার উপর মেজদাদা সঞ্জীব তো কিছুই করেন না! তাঁর পুরো ভার ভাই বঙ্কিমের কাঁধে। এর পরেও রেহাই নেই। আত্মীয়-পরিজনের অনেকের চিকিৎসা, অন্নবস্ত্র, সব কিছুর কথাই ভাবতে হত তাঁকেই।
স্ত্রী রাজলক্ষ্মী সব সময় তাঁর পাশে। বঙ্কিমের সাহিত্যিক বন্ধুদের কাছেও তাঁর কদর ষোলোআনা। তাঁদের আপ্যায়নও তাঁকেই করতে হত।
স্বভাবগম্ভীর রাজলক্ষ্মী ভাল রান্না জানতেন। অতিথি এলে রাজলক্ষ্মীর হাতের রান্না না খাইয়ে বঙ্কিম পারতপক্ষে কাউকে ছাড়তেন না। ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর কাছে খরচপত্রের দায়দায়িত্বও তুলে দেন তিনি। এমনকী নিজে চিঠিপত্র লেখারও যখন সময় পেতেন না, লিখে দিতেন রাজলক্ষ্মীদেবী। বঙ্কিম কেবল সই করে দিতেন।
কালে কালে রাজলক্ষ্মীর প্রতি তাঁর এত নির্ভরতা বাড়তে থাকে যে, বলতেন, ‘‘তিনি না থাকিলে আমি কী হইতাম, বলিতে পারি না।’’
রাজলক্ষ্মীর প্রতি এত টান, অথচ কী আশ্চর্য, শেষদিন পর্যন্ত মোহিনী যেন বঙ্কিমের অবচেতনে ডানা মেলে ভেসে বেড়াতেন তাঁরই গহীন অতলে।
মৃত্যুকালে যখন অর্ধচেতন অবস্থা, যন্ত্রণায় কাতর, তখন রাজলক্ষ্মী নয়, বারবার বলেছিলেন একটিই নাম—
‘‘মোহিনী, মোহিনী! আমি এ
বার তার কাছে যাব।’’
সমাপ্ত
ঋণঃ বঙ্কিমভবন গবেষণা কেন্দ্র কাঁটালপাড়া নৈহাটি, বঙ্কিমচন্দ্র রচনাবলী (যোগেশচন্দ্র বাগল), বঙ্কিমচন্দ্র (সুনির্মল বসু), বঙ্কিম প্রসঙ্গ (সুরেশচন্দ্র সমাজপতি), বঙ্কিম জীবনী (শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), অন্য এক বঙ্কিমচন্দ্র (গোপালচন্দ্র রায়), বঙ্গদর্শন পত্রিকা, বঙ্কিমচন্দ্রজীবনী (অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য), কাছের মানুষ বঙ্কিমচন্দ্র (সোমেন্দ্রনাথ বসু), বঙ্কিম ১৭৫ (সম্পাদনা: সত্যজিৎ চৌধুরী), ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র (হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনাসংগ্র (২য় খণ্ড)।
ছবিঃ শুভাশিস চক্রবর্তী
No comments:
Post a Comment