অনিরুদ্ধ সরকার
সাংবাদিক,
নিবন্ধকার, কলকাতা
মোহিনী ও রাজলক্ষ্মী।
প্রথম জন তাঁর জীবনে আসেন যখন, তিনি তখন বছর দশেকের কিশোর।
দ্বিতীয় জন তার ক’বছর বাদেই।
মোহিনীকে তিনি ভুলতে পারেননি জীবনের শেষতম মুহূর্তেও। অথচ
রাজলক্ষ্মী-সঙ্গ তাঁকে বোধহয় অনেকটাই নির্ভরতা দিয়েছিল, শুধু রোজের কেজো জীবনে নয়,
সাহিত্যচর্চাতেও।
তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়।
কে এই মোহিনী? নারায়ণপুর গাঁয়ের এক গৃহস্থ নবকুমার
চক্রবর্তীর কন্যা।
আর রাজলক্ষ্মী? হালিশহরে ছিল তাঁর আবাস। পিতার নাম সীতারাম
বন্দ্যোপাধ্যায়।
দু’জনেই রূপবতী তো বটেই। গুণবতীও।
মোহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বছর এগারোর।কিন্তু বঙ্কিম তাঁর যৌবনের
শুরুতেই ‘মোহিনী-হারা’ হন। আর প্রায়
সেই সময় থেকেই আমৃত্যু তাঁর পাশে ছিলেন বঙ্কিম-প্রিয়া রাজলক্ষ্মী।
মোহিনী তাঁর প্রথমা স্ত্রী। রাজলক্ষ্মী দ্বিতীয়া।
কাঁটালপাড়ার বঙ্কিম তখন নেহাতই বালক। বয়স দশ মাত্র। বড়দা
শ্যামাচরণ ঠিক করলেন, এবার ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন।
চার কিলোমিটার দূরে নারায়ণপুর। সমৃদ্ধ গাঁ। সে গাঁয়ের
বালিকা মোহিনী তখন পাঁচ বছরের কিশোরী। তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন ভাইকে।
মোহিনীর পিতা প্রচুর গয়না দিলেন মেয়ের বিয়েতে। বঙ্কিমের বাবা যাদবচন্দ্রও তাই।
বঙ্কিমের বাবা যাদব চন্দ্র |
তখন বঙ্কিমের রোজগার বলতে পরীক্ষায় ভাল ফল করে বৃত্তির টাকা
পাওয়া। তাই দিয়ে তিনি বাগান করতেন। কিন্তু বিয়ের পর মোহিনীকে এত ভালবেসে ফেলেছিলেন
যে, ওই টাকা থেকে কিছু কিছু বাঁচিয়ে যৎসামান্য উপহারও দিতেন স্ত্রীকে। তার মধ্যে
একবার দিলেন দু’টি কানের দুল। একটি চুলের কাঁটা। সব সোনার!
মোহিনীকে বঙ্কিম যেন চোখে হারাতেন। কিছু নতুন লেখা লিখলেও
মোহিনীকে প্রথমে পড়ানো চাই। মোহিনীর সঙ্গে দু’দণ্ড দেখা না হলে তাঁর চলে না।
মোহিনী বাপের বাড়ি গেলে লজ্জার মাথা খেয়ে লুকিয়ে-লুকিয়েও তিনি নারায়ণপুর চলে যান।
কখনও ফিরে আসেন ভোরের দিকে। কখনও তা’ও
না।
এ নিয়ে এক জায়গায় একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, যাতে আন্দাজ মেলে কিশোর লাজুক বঙ্কিম কী ভাবে লোক-আড়ালে তাঁর মোহিনী-প্রীতিকে ধরে রাখতে চাইতেন।
দাদা সঞ্জীবচন্দ্র |
শ্বশুরঘর থেকে ফিরে বঙ্কিম চুপি চুপি বোধহয় পড়তে বসে যেতেন।
একদিন দাদা সঞ্জীবচন্দ্র দেখলেন, ভাই ভোরবেলা পড়াশুনোয় নিমগ্ন। রাতে শুতে যাবার
সময়ও তাই দেখেছেন। তা’হলে কি সে সারারাত জেগে আছে? ঘটনার বর্ণনাটি এমন যে, মনে হতে
পারে, ওই মাঝের সময়টুকু বঙ্কিম পড়াশুনোয় নয়, গিয়েছিলেন নারায়ণপুরে
মোহিনী-সাক্ষাতে!
মোহিনী ততদিনে অবশ্য শ্বশুরালয়েরও সকলের নয়ণের মণি। কিন্তু
এই মধুর প্রেমের কী করুণ অবসান!
বঙ্কিমকে চাকরি নিয়ে যেতে হয় যশোরে। দীর্ঘকাল মোহিনী-বিরহে
তিনি যেমন ব্যাকুল, তেমনই তাঁর প্রিয়াও।
শেষে ঠিক করলেন, অনেক হয়েছে, এবার তিনি মোহিনীকে যশোরে
নিয়ে আসবেন। চিঠি লিখলেন স্ত্রীকে। চিঠি পেয়ে মোহিনী তো আহ্লাদে আটখানা। বাড়ির
গুরুজনরাও খুশি। তাঁদেরও ছেলে আর তার বউয়ের দূরে দূরে থাকার ক্লেশ সহ্য হচ্ছিল না।
মোহিনীকে কাছে পাবার আনন্দে বঙ্কিম আকুল। তার মধ্যে অবশ্য কিছুটা
উৎকণ্ঠাও আছে। ক’দিনের জ্বরে মোহিনী যে শয্যা নিয়েছে! ফলে বঙ্কিমের তর সয় না।
দ্রুত চললেন কাঁটালপাড়ার দিকে।
কিন্তু হায়!
মাঝপথে খবর পেলেন ওই জ্বরই তাঁর প্রিয়ার কাল হয়েছে।
সে আর এ পৃথিবীতেই নেই।
ফিরে গেলেন বঙ্কিম। সে যাত্রায় আর কাঁটালপাড়ামুখো হলেন না।
এরপর বহুকাল তিনি দেশবাড়ি যাননি।
দাদা সঞ্জীবচন্দ্রের কাছে একটি অনুরোধ রেখেছিলেন শুধু। সেই
দু’টি কানের দুল আর চুলের সোনার কাঁটাটি, যা তিনি উপহার দিয়েছিলেন প্রাণপ্রিয়াকে,
তা যেন তাঁকে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন দাদা!
পরের জীবনে বহুকাল অবধি এই দু’টি উপহার কী ভাবে আগলে আগলে
বেড়াতেন বঙ্কিম, তাঁর কাহিনি বলব।
তখন রাজলক্ষ্মী এসে গিয়েছেন তাঁর
জীবনে।
(পরের পর্ব, ‘বঙ্কিমের জীবনে দুই নারী ২য় পর্ব’, ক’দিন পরে)
তখন ভাঙাচোরা কাঁটালপাড়ার বাড়ি |
ঋণঃ বঙ্কিমভবন গবেষণা কেন্দ্র কাঁটালপাড়া নৈহাটি, বঙ্কিমচন্দ্র রচনাবলী (যোগেশচন্দ্র বাগল), বঙ্কিমচন্দ্র (সুনির্মল বসু), বঙ্কিম প্রসঙ্গ (সুরেশচন্দ্র সমাজপতি), বঙ্কিম জীবনী (শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), অন্য এক বঙ্কিমচন্দ্র (গোপালচন্দ্র রায়), বঙ্গদর্শন পত্রিকা, বঙ্কিমচন্দ্রজীবনী (অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য), কাছের মানুষ বঙ্কিমচন্দ্র (সোমেন্দ্রনাথ বসু), বঙ্কিম ১৭৫ (সম্পাদনা: সত্যজিৎ চৌধুরী), ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র (হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনাসংগ্র (২য় খণ্ড)।
ছবিঃ শুভাশিস চক্রবর্তী
No comments:
Post a Comment