Saturday, July 11, 2020

জীবন যে রকম ৪ - নরখাদক বাঘ মেরে তাঁরা জমিদার - সৌমেন জানা

লালগড় রাজবাড়ি


নরখাদক বাঘ মেরে তাঁরা জমিদার

সৌমেন জানা
শিক্ষক, মুর্শিদাবাদ

সাহস রায়!! কোনও নামে এমন শব্দ কোনওদিন চোখে পড়েনি তো!

একটু বাদেই পরিচয় করাব ভদ্রলোকের সঙ্গে। তার আগে চেহারাটার বর্ণনা দিই। দ্বিতীয় চমকটা সেখানেই।

ভাঙা গাল উদ্ধত চোয়াল। নাকটিও বেশ উঁচিয়ে বয়স ষাটের কম না। মাথার সামনের দিকে চুল বেশ কিছুটা উঠে যাওয়ায় কপালটা চওড়া হয়ে গিয়েছে দুবলা পাতলা চেহারা। গড়নে বড়ই নিপাট অথচ এঁরই নাম নাকি প্রশান্তকুমার সাহস রায়!

এক পরিচিতর বাড়ি থেকে জঙ্গলমহলে ঘুরতে এসেছি। মেদিনীপুর শহর ছেড়ে ঘণ্টা দেড়েক গাড়িতে। জঙ্গল লালগড়। সেখানে এক ভগ্ন জমিদারি চিহ্নের খবর পেয়েছি সদ্য। তাতেই লোভ সামলাতে পারিনি আর কী!

কারুকার্যমন্ডিত খিলান

ফলে সাত সকালেই লালগড় অভিযান। গন্তব্য কংসাবতী নদীর তীর ‘সাহসরায়’-দের দো'তলা জমিদারবাড়ি।খয়াটে বাড়ির সামনেটায় পৌঁছেই চোখে পড়েছে কাঁটা তারের হেলে পড়া কতগুলো চিৎ হওয়া থাম নূব্জ্য মহল্লার মলিন ঔদ্ধত্যের কী আশ্চর্য প্রতীক ওই থামগুলো!

প্রকান্ড কাঠের সদর দরজাটির গায়ে এখনও কারুকাজের ছাপটি অবশ্য স্পষ্ট নীচের তলার পুরোটাতেই হাল আমলের সাদা রঙ ল্যাপা ওপরতলায় কোনও রঙের ছোঁয়া পড়েনি। তার সবটা ফ্যাকাশে, মলিন, পাঁশুটে খানিক পলেস্তরা খসা ভগ্ন দেওয়ালের হাঁ করে থাকা ইটগুলো যেন আগন্তুকের দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসল পাশে ভেঙে পড়া খিলান। চিড় ধরা দেওয়ালের গায়ে জন্মানো শ্যাওলা, বট, পাকুড়ের ভাঁজে আজও ছুঁয়ে আছে হারানো আভিজাত্যের ফিকে দাগ।

তাকিয়ে ছিলাম সেদিকেই। 

সর্বমঙ্গলা মন্দির

একজনের ডাকে সম্বিত ফিরল। বয়োঃবৃদ্ধ তার পরণের ধোপদুরস্ত সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির মতো মাথায় চুলটিও বেশ সফেদ।

—কাউকে খুঁজছেন?

দু’শব্দের ছোট্ট বাক্যটার সুরটা কোমল হলেও স্বরটিতে আদেশের কড়াপাক মিশে বললাম, ‘ঘুরতে এসেছি।’

—আসুন আমার সঙ্গে। ঘুরিয়ে দেখাই। আমি প্রশান্তকুমার সাহস রায়। এগুলো সব আমিই দেখভাল করি।

পরিচয় আগেই পেয়েছিলামদেখলাম এই। জমিদারবাড়ির প্রবীণ সদস্য। ঘুরতে ফিরতে তিনিই গল্প বললেন খানিক খানিক।

আদিবাস মধ্যপ্রদেশের এটোয়া ‘ব্রহ্মভাট’ সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁদের কয়েকজন শ্রীক্ষেত্র বা পুরী এসেছিলেন ওই এটোয়া থেকেই। ফিরতি পথে দেশে না গিয়ে কাঁসাই নদীর অববাহিকায় এই জংলা জায়গাটিতেই থেকে যান সবাই কারণ? অজ্ঞাত পরে এই ‘ভিনদেশী’রাই ‘জমিদারিত্ব’ পান

কিন্তু ‘সাহসরায়’? শোনা থেকেই তো শব্দটা কানের কাছে খচখচায়খোলসা করলেন প্রৌঢ়। 

লালগড় রাজবাড়ির অংশ

বললেন, ‘‘সময়টা ১৭৪০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে কোনও একটা বছর হবে মারাঠাদের তখন প্রবল প্রতাপ। তাদের লুঠপাট ঠেকানো দায়। প্রতাপাণ্বিত সেই মারাঠাদের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বাংলার নবাব আলিবর্দি খান এখানে ঘাঁটি গাড়েন এ দিকে তখন ঘন শালের জঙ্গল বাঘের উৎপাত খুব সেরকমই একটি নরখাদক বাঘকে তখন গুণচন্দ্র ও উদয়চন্দ্র নামের দুই ভাই মিলে শায়েস্তা করেন।’’

আমি হাঁ করে গল্প গিলছি। উনি বলে যাচ্ছেন।

‘‘নবাব তাঁদের সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে বড় ভাই গুণচন্দ্রকে ‘সিংহ সাহস রায়’ ও ছোট ভাই উদয়চন্দ্রকে ‘সাহস রায়’ রাজউপাধি দিলেন তাঁদের ‘রাজা’ হিসাবেও ঘোষণা করেন তিনি’’

এরপর সেই উদয়চন্দ্র সাহস রায় রামগড়ে তার রাজধানী গড়ে রাজত্ব চালাতে থাকেন অপুত্রক অবস্থায় তিনি মারা গেলে লালগড়ের রাজা গুণচন্দ্র সিংহ সাহস রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র লক্ষণচন্দ্রকে রামগড়ের রাজা করা হয়। এভাবেই বংশপরম্পরা চলতে থাকে।

সেই প্রবল সাহসী বংশের আজকের এই দশা! জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।

প্রশ্ন শুনে স্থির চাউনিতে তাকালেন বৃদ্ধ ক’সেকেন্ড মাত্র কিন্তু সে চোখের দৃষ্টিতে কী যে বেদনার জ্বালা গড়িয়ে পড়ছিল!

আলটপকা মুখ থেকে খসে পড়ল ক’টা শব্দ, ‘‘শরিকি বিবাদ। আর কী বলি!’’

শুনলাম, মূল জমিদার বাড়িটির প্রথম মহলের এক অংশ অফিসের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাকি অংশ একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ভাড়া নিয়েছে। এই চুনের প্রলেপ তারই কারণে।

হাঁটতে-চলতে তিনটি মন্দির দেখালেন প্রশান্তকুমার জমিদার বাড়ির সামনেই। প্রথমটি দুর্গার, দ্বিতীয়টি শিবের। তৃতীয়টি শনি মন্দির। মাঝখানেও একটি মন্দির কোনও একসময় হয়তো ছিলআজ নেই। তাকে কে যেন ভেঙ্গেচুরে বিকিকিনির পসরা সাজিয়ে বসেছেন।

জমিদারবাড়ির অন্দরমহল

কিছুটা দূরে আরও দু’টি মন্দির। আনুমানিক সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো ‘রাধামোহন জিউ’-এর। এক্কেবারে বিষ্ণুপুরী জোড়বাংলা শৈলীর। দেওয়ালের গায়ের লিপি দেখে জানলাম, বাংলার ১৩৮০ সালে পৃথ্বীশ নারায়ণ শেষবারের মতো এটির সংস্কার করেন। তার অবস্থা এখন তথৈবচ। তবে এখনও পূজা হয়। পাশের দো’তলা দালান মন্দিরটি মা সর্বমঙ্গলার। তার সৌন্দর্য এখনও নজরকাড়া। তবে সে আর কদ্দিন, বোঝা ভার!

যে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনশো বছর ধরে জীবন চলত এলাকার মানুষদের, তার কী জরাজীর্ণ দশা আজ!

একসময় নহবতখানায় মিঠে তান ধরত সানাইবাদকের দল জ্বলে উঠত জলসাঘরের ঝাড়বাতি চনমনিয়ে উঠত নর্তকীর ঘুঙুরের বোল সেই নহবতখানা আজ শূন্য। নিঃস্ব। বাতিহারা জলসাঘর খাঁ খাঁ। দিনমানে অস্ত সূর্যের রাগ যেন শুধুই ভাঙনের পাঁজর গুনে চলে জমিদারি স্মৃতির! তার না আছে শব্দ, না কোনও আলো।

কাছেই বিশাল ঝি‌ল। ছেলের দল ঝাঁপ দিচ্ছে সেখানেছলাৎছল নড়ে উঠছে ঝিলের জল। শুনলাম, আগে ঝিলের মাঝখানে নাকি একটা হাওয়ামহল ছিল। আজ আর তা’ও নেই। ভেঙ্গে গেছে কবেই! শুধু মহলের বুনিয়াদটুকু জেগে আছে ঝিলের মাঝে।

একদিন তা’ও হয়তো বুদবুদের মতো নিঃশব্দে মিলিয়ে যাবে টলটলে জলে! ভাঙন ধরা সাহস-প্রাসাদের হারানো গরিমার জমাট ব্যথা বুকে বয়ে

ভগ্ন হাওয়া মহল



ছবিঃ লেখক

1 comment:

  1. Exactly address ta janaben pls.
    Ekhon geleo ki sahos rai er sathe porichay kora jabe?
    Pls suggest me.

    ReplyDelete