প্লিজ আসবেন আমাদের ‘পুষ্পশ্রী’-তে
অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
শিক্ষিকা, হাওড়া
ওঁর সঙ্গে কথা
বলার পর থেকে একটা গানের কলি কেমন যেন নতুন করে ধরা দিচ্ছে আমার কাছে। কোন গান,
কেন? বলব সবটা। তার আগে কথালাপটা তো শুরু করি।
ও পার থেকে একটা
মাঝবয়সি গলায় ‘হ্যালো’ ভেসে আসতেই বললাম, ‘ইন্দ্রকুমার পোল্লে বলছেন?’
‘‘বলছি। আপনি?’’
‘আমি আপনাদের
পুষ্পশ্রী সিনেমা হলটা নিয়ে একটা লেখা করব বলে একটু কথা বলতে চাইছিলাম। শুনলাম, আপনি তো অন্যতম কর্ণধার এখন। তাই...’’
‘‘লেখা? কীসের
লেখা?’’ গলাটা যেন একটু পাকিয়ে উঠল।
তবু বললাম, ‘এই
পুষ্পশ্রী হল কী ভাবে তৈরি হল, নামটা পুষ্পশ্রী-ই বা কেন? এই সব আর কী! আর পুরনো
হল-এর যদি একটা ছবি...’’
কথা থামিয়ে এ
বারও উত্তর এল বটে, তবে বেশ চড়া ঢঙে।
‘‘ছবি? ছবিটবি
কিচ্ছু নেই আমাদের কাছে। আর শুনুন, ভেবেছেন কী! করোনা। লকডাউন। তিন মাস হল, ‘হল’ বন্ধ।
রুজি-রোজগার বুঝতেই পারছেন। এখন এ সব গল্প বলার সময় আছে?’’
‘না মানে,
সামান্য একটু যদি... বেশি সময় নেব না।’’
চড়া ধমকের সামনে
যতটা নরম হয়ে বলা যায়! ভদ্রলোক ফোনটা রেখে দিলেন না। কিন্তু মেজাজ যে বেশ তিরিক্ষি
হয়ে আছে, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝিয়ে দিলেন।
স্বাভাবিক! আমায়
নাছোড় দেখে শেষে যে মুখ খুললেন, তা-ই ঢের।
১৯৭৭। ফেব্রুয়ারির ১০। সম্ভবত বটকৃষ্ণ পোল্লে-র হাতে তৈরি এই পুষ্পশ্রী। তাঁর স্ত্রী-র নামেই নাম
রেখেছিলেন হল-এর। তৈরির সময় পাশে ছিলেন ভাই আনন্দকুমার পোল্লে। তখনকার দিনে বিশপ
হাউস-এর জমিতে তৈরি হয়েছিল ‘হল’। গোড়ার দিকে টিকিটের দাম ছিল
৭৫ পয়সা আর ১টাকা ১০। তাতেও পুরো বাতানুকূল। যে কথা তখন হাওড়ার মতো অঞ্চলে দুরাশা
বললেও কম। তবু। পরে অবশ্য খরচপাতি বেড়ে যাওয়াতেও টিকিটের দাম বাড়াতে না পারায় বা
আরও সব কারণে সেই সুবিধের ইতি হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে
পুষ্পশ্রী যেন হঠাৎ দলছুট জলুশ-হারা হয়ে ফিকে হয়ে যেতে বসেছিল। হাওড়াবাসী হলে
বুঝতেন, এ শুধু ‘পুষ্পশ্রী’-পরিবারের কাছে নয়, অন্যদেরও কতটা দাগার বিষয়!
ব্যাপারটা কেমন
জানেন, পাশের বাড়ির ছেলে। টগবগে। দামাল। রোজ যেতে আসতে দেখেন হন্তদন্ত হয়ে। তাকেই যদি একসময় আবিষ্কার করেন, ধুঁকতে ধুঁকতে রাস্তা
পেরোচ্ছে, কষ্ট লাগে তো, নাকি? ঠিক তেমনটা যেন।
’৮০-’৯০ কী ২০০০
সালে কৈশোর-যৌবন পেরোনো ছেলেপুলেদের কত যে উথালপাথাল ঢেউ-এর সাক্ষি এই মাঝবয়েসি সিনেমা
হলটি!
আমার নিজের কথা
বললে, খানিক বুঝবেন।
সময়টা ২০০০ সাল। আমার তখন ক্লাস এইট। ঋত্বিক রোশনের ‘কহনা প্যার হ্যায়’ রিলিজ করল।
সেই প্রথম আমার
হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। কোন হল? না, সেই পুষ্পশ্রী সিনেমা হল। কদমতলা তো বটেই, হাওড়ারও নাম করা সিনেমা হল। আমাদের গর্বের। যেমন বিশাল, তেমনই তার বড় স্ক্রিন। আওয়াজখানাও
বেশ গমগমে। টিকিটের দাম? তা’ও মধ্যবিত্তকে খুশি করার মতোই।
এর পরে মাঝে ক’টা
বছর কেটে গিয়েছে। ‘পুষ্পশ্রী’-তে বেশ ক’বার ঢুঁ মারতে মারতে একটা ঘরবাড়ি-টাইপ
ব্যাপারস্যাপার হয়ে গিয়েছিল।
এদিকে স্কুলের
গণ্ডি পেরিয়ে আমি কলেজে।
একদিনের ঘটনা মনে
পড়ে, কোনও এক কারণে টিফিন ব্রেকের পরের সব ক’টা ক্লাস বাতিল। তাল খুঁজে ক্লাসের গোবেচারা এক বন্ধু ইমরানকে টিকিট
কাটতে পাঠালাম পুষ্পশ্রী-তে। পুরো হুকুম, যে সিনেমাই চলুক, ১৪টা টিকিট যেন সে আনে।
আনল বেচারা।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে কাটার জন্য অবধারিতভাবে সব ক’টাকে ফ্রন্ট-রোয়ে বসতে হল। আসন
পিছু খরচা নগদ ১৫ টাকা।
সিনেমাটার কী
নাম, আজ আর মনে নেই, তবে গোটা সিনেমা জুড়ে জিৎ, কোয়েল আর সাড়ে তিনখানা বিয়ে ছাড়া
কিস্যু যে ছিল না, তা বিলক্ষণ খেয়াল আছে। তাতে কী, বিনোদন ষোলো আনা উশুল চোদ্দজনের
হঠাৎ অভিযানে!
এরপরও কত সিনেমা
দেখেছি এই পুষ্পশ্রীতে, তার ইয়ত্তা নেই। সেই কৈশোরবেলা থেকে এই সে দিন অবধি। পুষ্পশ্রী নিয়ে এত এত জমা স্মৃতি, পুরনো
অ্যালবামের হলদেটে ছবির মতো এমন মায়া নিয়ে ধরা দেয়, সবটা মিলেজুলে সে তখন আর নিছক
একটা সিনেমা হল হয়ে থাকে না, তার বাইরে একটা কিছু। যার গায়ে মানুষ-মানুষ গন্ধ। বড়
আপনজনের আদল।
দেখ না দেখ,
মাল্টিপ্লেকস-এর যুগ এসে পড়ল। মধ্যবিত্তের পকেটে থাবা। আর বহু বহু
হল মালিকদের পেটে পড়ল দড়াম দড়াম করে ঘা।
একালে হল-এ
সিনেমা দেখা মানে ছারপোকা, বাদাম চাট মিলে খান ২৫ টাকা আর নয়। চারজনের পরিবার-এ ছবিঘরে ঢোকা মানেই
একটি ২০০০-এর নোট পটাং করে ভোক্কাট্টা!
এ দিকে সিঙ্গল
স্ক্রিন মালিকদের গোদের ওপর খাঁড়ার কোপ, বাড়িতে, গাড়িতে, খাটে, ছাদে, চৌকাঠে
আসতে-যেতে বোতামের ডগায় হাজারটা বিনোদনী মশলা।
দর্শক ক্রমশ
হল-বিমুখ।
যাদের তা’ও পকেট
ভারী, ওই মাল্টিপ্লেক্সেই গাড়ি থামায়, নন-এসি কাঠের চেয়ারওয়ালা, মলিন পরদার অ-সুখ
তাদের সইবে কেন!
একে একে সিঙ্গল
স্ক্রিনে তালা ঝোলা শুরু।
তখনও কিন্তু
হাওড়ার এই অভিজ্ঞতায় ঘুণ ধরা ‘পুষ্পশ্রী’ দিব্যি চলছিল। গতি সম্বুক হলেও, চলা তার
থামেনি।
তবে পিছু হঠার
দিনে আরও ক’টা কারণ লটকে গিয়েছিল তখনই।
‘পুষ্পশ্রী’ গেলে ‘স্টেটাস আপডেট’ দেওয়া মানে, ইজ্জত কা সওয়াল! এমনকী হল-এ বসে থাচুম-খাচুম করে পপকর্নও কষ্ট-কল্পনা।
![]() |
এখন পুষ্পশ্রী |
ফলে
এক্স-ওয়াই-জেড জেনের কাছে ‘পুষ্পশ্রী’ শ্রী-হারা ত্যাজ্য-পুত্র।
মোটা পকেটের বাবু-বিবিরও তাই। স্বীকার
করা ভাল, আমরাও ততদিনে ‘পুষ্পশ্রী’-র রাস্তা তেমন মাড়াই না। একটা চোরা কষ্ট থাকত
না, তা নয়, কিন্তু কালেভদ্রে হল-এ যাওয়া আম-পাবলিক ধীরে ধীরে আরামপ্রিয় হতে হতে সইয়ে
নিচ্ছে মাল্টিপ্লেক্সের টিকিটের হিসহিসে ফণা। সেই আম-এর দলে তখন আমরাও নাম
লিখিয়েছি!
ঠিক তখনই আস্তিন
থেকে নতুন তাস ‘পুষ্পশ্রী’-মালিকের। খবর পেলাম রেনোভেট করা হয়েছে ‘পুষ্পশ্রী’। আগাপস্তালা
ঢেলে সাজানো হয়েছে।
খুশি হলাম। খুব খুশি হলাম। এক্কেবারে ঘরের ছেলেকে প্রায়
হারা-ম্যাচ জিততে দেখলে যেমন হয়, অনেকটা তেমনই সেই আনন্দ। ময়দানে তাগড়াই তাগড়াই
নামডাকওয়ালা বিদেশি খেলোয়াড়ের সঙ্গে যেন জিরজিরে বাঙালি তনয়ের পাল্লাপাল্লি দিয়ে
‘গোল’ দেওয়া! বা রে, বাহ্!
মনে মনে বললাম, নিজেকে
টিকিয়ে রাখতে গেলে, যুগের দোহাই না দিয়ে ‘আপডেট’ করতে পারার জেদ থাকতে হয়। তাকত থাকতে হয়। সে কথা
যেন আরেকবার বুঝিয়ে দিল ‘আমাদের পুষ্পশ্রী’।
দৌড়ে গিয়েছিলাম
নতুন পুষ্পশ্রী-কে দেখব বলে।
তখন ‘দৃষ্টিকোণ’ চলছে।
সেটা উপলক্ষ মাত্র। দৃষ্টি তখন একটাই। হাতে সময় নিয়ে কনে দেখার মতো দু’চোখ ভরে দেখা
পুরনো বাড়ির বদলে যাওয়া ঝাঁ চকচকে আনাচকানাচ। মা যেমন হঠাৎ বড় হয়ে ওঠা তার সাজুগুজু করা কন্যাকে অপরিসীম তৃপ্তি নিয়ে দেখে,
অনেকটা তেমন করে!
চমকের এখানেই শেষ
নয় বাবা!
‘Book
My show’-তে যখন জ্বলজ্বল
করে ‘পুষ্পশ্রী’ নামটা দেখেছিলাম, বোধকরি সে আনন্দ প্রায় নিজের পোলাপান, কী মাইয়াকে ফার্স্ট হতে দেখার
সামিল!
একরাশ ভাললাগা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সেই থেকে আজ, সুযোগ পেলেই ‘ওয়ে টু পুষ্পশ্রী’ ধরে ফেলি।
![]() |
পুষ্পশ্রী-র অন্দরমহল |
হাওড়া এলে আপনিও
আসতে পারেন আমাদের সাধের ‘পুষ্পশ্রী’-তে। মন্দ লাগবে না। তবে ওই ১৫টি টাকায় আর এনট্রি পাসটা মেলে না, একটু বেশি, এই যা! কিন্তু গায়ে
লাগবে না, এটাই হল হক কথা!
ও হ্যাঁ, বলতে
ভুলেই গেছি... চাইলে পপকর্ন-চিপস্-কফিও পাবেন।
আর পাবেন ভালো
লাগা।
কাউকে নতুন করে
বাঁচতে দেখলে, যেমন ভাল্লাগে, ঠিক তেমনই ভাল লাগা। যে ভাল লাগার কোনও ‘বাহির’ নেই, গোটাটাই অন্তরের। তাকে বোঝা যায় শুধু, হাজার
চেষ্টা করেও ধরা বা দেখা যায় না!
এমন ভাবতে ভাবতেই
গানটা মনে পড়েছিল—
‘পুষ্প বনে
পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে...’
![]() |
এখনকার টিকিট |
ছবিঃ
‘পুষ্পশ্রী’-র ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া, এখনকার টিকিট ও ‘কহো না প্যার হ্যায়’-এর পোস্টার সংশ্লিষ্ট সংস্থার থেকে সংগৃহীত
No comments:
Post a Comment