প্রীতম পাল
চর্মপণ্য শিল্পে প্রযুক্তিবিদ, রাজারহাট
‘স্যার’ উপাধি পেয়েছেন! সংস্কৃত শাস্ত্রশিক্ষা,
কী নারী শিক্ষা প্রসারেও তাঁর ভূমিকা!
তিনিই কলকাতা হাইকোর্টের উচ্চতম আসনের প্রথম
পুরুষ!
এককালে এলাকায় ইস্কুল প্রতিষ্ঠা থেকে পুকুর খনন,
রাস্তা নির্মাণ হয়েছে তাঁর উদ্যোগেই।
সরকারি পদে থেকেও ব্রিটিশ আমলে মাথা না-নোওয়ানো
বাঙালিদের একজন তিনি।
অথচ আজ হাইরাইজ-এ ছেয়ে যাওয়া রাজারহাট, তাঁর
বেড়ে ওঠার ভিটেভূমি কতটুকু মনে রেখেছে তাঁকে!
স্যার রমেশ চন্দ্র মিত্র।
কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম বাঙালি বিচারপতি
(অস্থায়ী)।
এলাকায় যে বিদ্যালয়টি তিনি তৈরি করেন, তাঁর
গায়েও এমন এক ইতিহাসি তকমা, গোটা পৃথিবীতে এমনটি কোথাও আছে বলে
জানা নেই!
বিদ্যালয় আছে, তার প্রতিষ্ঠা
দিবস নেই। আছে ‘প্রতিষ্ঠাতা দিবস’। না, না, ভুল পড়লেন না,
ঠিক ঠিক পড়েছেন। প্রতিষ্ঠা
নয়, প্রতিষ্ঠাতা দিবস-ই!
ব্রিটিশ আমলে তৈরি সুপ্রাচীন এই স্কুলটির দ্বারোদঘাটন ঠিক কোন তারিখে, কোথাও লেখা নেই। শুধু সালটিই যা জানা,
১৮৮০। এ দিকে প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিটি তো যে সে মানুষ নন। যাঁর নামের উল্লেখ ছোটবেলার সাধারণ জ্ঞান-এর
বইতেও পাওয়া যায়।
ঘটনা হল, নেই সেই
মানুষটির জন্ম-তারিখের কোনও হদিশও। তেমন হলে নয়, সেই দিনটিকেও
বেছে নেওয়া যেত! তারও উপায় কই। এমনই মুহূর্তকালে দাঁড়িয়ে রমেশচন্দ্র মিত্রর
মৃত্যুদিনকেই স্মরণ করে ইস্কুলের কর্তৃপক্ষ।
ফিরে যাই তাঁর জীবনে।
![]() |
স্যার রমেশ চন্দ্র মিত্র |
রাজারহাট। কলকাতা থেকে অল্প দূরে আজকের বর্ধিত শহরতলি। তখন তার আজকের ‘শহুরে চাকচিক্য’ কোথায়! চারদিকে শস্যের ক্ষেত। ধানজমি। শুকনো কিংবা ভরাট পুকুর। আমজামের জঙ্গলে ঘেরা গ্রামের পর গ্রাম।
সময়টা ১৮৪০। রাজারহাটের বিষ্ণুপুর গ্রামের
সম্ভ্রান্ত বাসিন্দা রামচন্দ্র মিত্র ও কমলমণি দেবীর ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করলেন
যে যুগপুরুষ, পরবর্তী কালে তিনিই হয়ে উঠলেন বাঙালির অন্যতম
পথপ্রদর্শক, এলাকাবাসীর শ্রদ্ধার জন রমেশচন্দ্র
মিত্র।
মাত্র ছ’বছর বয়সে বাবাকে
হারান রমেশ। ফলে ছেলেবেলা যে তাঁর মসৃণ
ছিল না, বলাই বাহুল্য। এলাকায় ইস্কুল-পড়াশোনার চল নেই। ছোট্ট রমেশ পড়াশুনোর জন্য
ভর্তি হন অনেক দূরে, সেই কলকাতার হেয়ার স্কুলে। কী করে যে যাতায়াত
করতেন ইস্কুলে, ঈশ্বর জানেন!
স্কুলের পাঠ শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজ। সেখান
থেকে বিএ-তে স্নাতক।
মাত্র ২১ বছর বয়সে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল-ও পাস করলেন। এরপর সদর দেওয়ানি আদালতে আইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। ১৮৭১ থেকে ১৮৯০ সাল অবধি কলকাতা হাইকোর্টের অন্যতম বিচারপতি!
![]() |
কলকাতা হাইকোর্টের সামনে আবক্ষ মূর্তি |
রমেশচন্দ্র মিত্রই প্রথম ভারতীয়, যিনি দু-দুবার কলকাতা হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির কার্যভার সামলেছেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে আইনের ফাঁসে পড়ে স্থায়ীভাবে তিনি প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন নি, এই যা!
ছিলেন স্বাধীনচেতা। বিবেকবান। চাপের কাছে মাথা
নিচু করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। শোনা যায়, আদালত অবমাননার দায়ে একবার জাতীয়
কংগ্রেসের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দোষী সাব্যস্ত করেন ব্রিটিশ
বিচারকরা। সেই মতের বিরুদ্ধাচারণে গিয়ে হইচই ফেলে দেন রমেশচন্দ্র মিত্র।
বিচারক-জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর বহু
গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে ছিলেন। ১৮৮৭ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অন্যতম সদস্য
হন। ১৮৯১ সালে হন বড়লাটের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য। একসময় হয়েছিলেন কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় ও রিপন কলেজের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও।
আরও আরও কিছু!
১৮৯২ সালে নাইট উপাধি পান রমেশচন্দ্র মিত্র।
পরে কেসিআইই উপাধিও। কেসিআইই নিয়ে এখানে বিস্তারিত বলা মুশকিল। পুরো কথাটি শুধু
বলি, ‘নাইট কম্যান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’।
১৮৯৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের
সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দেশের স্বাধীনতা ও নিজের
স্বদেশপ্রেমের সুচিন্তিত মতামত দেন রমেশচন্দ্র।
শৈশব থেকেই রমেশ দেখতেন, এলাকায় ইস্কুলের বালাই নেই। সে কথা মাথায় রেখেই ১৮৮০ সালে তিনি তৈরি করেন ‘বিষ্ণুপুর উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়’। যার এখনকার নাম ‘বিষ্ণুপুর স্যার রমেশ ইনস্টিটিউশন’।
![]() |
বিষ্ণুপুর স্যার রমেশ ইন্সটিটিউশন-এর পুরানো বাড়ি |
আজ যেখানে বিষ্ণুপুরের বাজার বসে, সেই জমিটিও তাঁর দেওয়া।, সেই
জমিটিও তাঁর দেওয়া। যেখানে প্রতি সোম ও
শুক্রবারে এক সময় বসত চালের হাট। দূর-দূর গ্রাম থেকে মানুষ আসতেন চাল কিনতে।
রাজারহাট-বিষ্ণুপুরের পাশাপাশি সংস্কৃত শাস্ত্র
শিক্ষার জন্য আরও একটি কান্ড করেন রমেশচন্দ্র। কলকাতার ভবানীপুরে তিনি তৈরি করেন
একটি চতুষ্পাঠী।
রমেশচন্দ্রর কথা বলতে গেলে তাঁর স্ত্রী
জগত্তারিণী দেবীর কথা না বললেই নয়।
সেই সময়ে নারী শিক্ষার প্রসারে খুব উৎসাহী
ছিলেন রমেশ-জায়া জগত্তারিণী দেবী। তাঁর সেই ইচ্ছার সঙ্গী হয়ে রমেশচন্দ্র ওই
ভবানীপুরেই তৈরি করেন আরেকটি বিদ্যালয়। যার বর্তমান নাম স্যার রমেশ মিটার গার্লস
হাইস্কুল।
রমেশচন্দ্র মৃত্যুর আগে রাজারহাটে তাঁর নিজের
বাড়িতে এলাকাবাসীর কল্যাণে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের কথাও ভাবেন। কিন্তু
জীবদ্দশায় সে ভাবনা আর রূপায়িত হয়নি তাঁর। সেই ইচ্ছেটি পূর্ণ করেন তাঁর পুত্র।
১৮৯৯ সালের ১৩ জুলাই রমেশচন্দ্রের দেহাবসান হয়।
তার ঠিক দু’বছর বাদে, ১৯০১-এ পুত্র
স্যার প্রভাসচন্দ্র মিত্র নিজেদের বাড়িতে এই দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন।
কলকাতা হাইকোর্ট চত্বরে এখনও জ্বলজ্বল করে
প্রথম বাঙালি বিচারপতির আবক্ষ মূর্তি। আরেকটি মূর্তি দন্ডায়মান তাঁরই তৈরি
রাজারহাটের স্কুলবাড়ি চত্বরে। ২০০৫ সালে স্কুলের ১২৫ বছর পূর্তি উৎসবে যে মূর্তি
উন্মোচন করতে আসেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
কিন্তু আজকের রাজারহাট, এর বাইরে কতটুকু মনে
রেখেছে তার কৃতী সন্তানকে!
আপামর বাঙালিই বা কতটা স্মরণে রেখেছে স্যার
রমেশচন্দ্র মিত্রকে?
জানা নেই।
তবে এটুকু জানা, তাঁর তৈরি
ইস্কুলটির ‘প্রতিষ্ঠাতা দিবস’ ব্যাপারটি
বিদ্যালয়টির কাছে কতটা স্পর্শকাতর! একটি ঘটনা বললে, তার কিছুটা
আন্দাজ পাবেন
একবার ছাত্রদের কাছে বিতরণ করার জন্য স্কুলের
ডায়েরিতে ১৩ জুলাইকে ভুল করে ‘প্রতিষ্ঠা দিবস’ বলে ছাপা হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে
জানাজানি। এবং ঝড়। প্রতিবাদের। অভিযোগ, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে।
তাতে অবস্থা এত চরমে ওঠে যে, রাতারাতি
ছাপা বদলাতে বাধ্য হয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যালয়ের ইতিহাসে তো বটেই, হয়তো’বা
বাঙালি জীবনেও এ কাহিনি বিরল মুহূর্তের ঘটনা হয়ে বেঁচে আছে!
কিন্তু আজকের বাঙালি?
এ কালের রাজারহাট?
কতটুকু মনে রেখেছে তাঁর ভূমিপুত্রকে?
![]() |
মিত্তির বাড়ির দূর্গামন্ডপ |
ছবিঃ প্রতিবেদক, তায়ন মাশ্চটক, বিষ্ণুপুর স্যার রমেশ ইনস্টিটিউশন ফেসবুক পেজ
No comments:
Post a Comment