আমার সামনে তিনশোরও বেশি নরমুন্ড |
পৌঁছে গেলাম নরমুন্ড শিকারিদের গাঁ ২য় পর্ব
অভিজিৎ দাশগুপ্ত
এসআরএফটিআই-এর প্রাক্তন ডিন, দূরদর্শন-এর প্রাক্তন স্টেশন অধিকর্তা, তথ্যচিত্র নির্মাতা
তিনশোরও বেশি মানুষের খুলি আমার সামনে। আমি স্থির তাকিয়ে সেই দিকে।
পাশ থেকে গলা পেলাম মুন্ডু-শিকারির!
‘‘আরও অনেক ছিল,’’ গলায় যেন খানিকটা আফসোস ঝরে পড়ল তাঁর।
বললেন, ‘‘তিরিশ বছর আগে শেষবারের মতো মাথা শিকার করেছিলাম।’’
সেই শিকারি আর আমার মধ্যে দোভাষীর কাজ করছিলেন বেদি।
‘‘আজকালকার ছেলেদের একেবারেই সাহস নেই।’’
আমি মনে মনে বললাম, ‘ভাগ্যিস নেই!’
হঠাৎ একটা ফড়িং উড়ে এসে বসল ওঁর কাঁধের ওপর। বিদ্যুৎ গতিতে সেটাকে ধরে খপ করে মুখে পুরে দিলেন তক্ষুনি।
মুখ নাড়তে নাড়তে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব ভাল।’’
শুনে বেদি মাথা নাড়লেন।
উল্কি-উজ্জ্বল কালো মুখ। হাতে চকচক করছে শানানো কুঠার। সে দিকে তাকিয়ে বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগল আমার।
কিন্তু মানুষটি বেশ শান্ত। স্বভাবে একটা বন্ধু-বন্ধু ভাব আছে। হাসলে কালো দাঁত নজরে আসে। আমাকে একটা কাঠের টুকরো দেখালেন। তার ওপর দিকে চারটে শিং। নীচের দিকে লম্বা চুলের গুছি গড়ান দিচ্ছে।
শিকারি বলে চললেন, ‘‘অনেক দিন আগে একটা মেয়েকে মেরেছিলাম। কাঠে লাগানো চুলগুলো দেখছেন, ওটা ওই মেয়েটার মাথার। ওটা চড়িয়ে আমি মুন্ডু শিকার করতে বেরতাম। ঊরুর পেশিতে চুলের ঝাপটা লাগলেই রক্ত টগবগ করত। সে সব দিন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে...’’
হঠাৎ দেখি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি।
বেদি ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মনটা পড়ে ফেললেন। আমার ক্যামেরাটা বোধহয় শিকারিকে সমস্যায় ফেলছে।
বেদি বলে উঠলেন, ‘‘শোনো, ওর গলায় ঝলানো যেটা দেখছ, সেটা কিন্তু কোনও জাদু-টাদু নয়। এতে তোমার বা তোমার নাতিপুতির কোনও ক্ষতি হবে না। উল্টে এই যন্ত্রটা দিয়েই একজন বড় শিকারি হিসেবে তোমাদের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। বুঝলে?’’
এখান থেকেই বোধহয় সম্পর্কটা, ওদের দেখাটা বদলে গেল।
এতক্ষণে সন্দেহের চোখে তাকানো মানুষটি কেমন শিশুর মতো খুশি হয়ে গেলেন!
কী উচ্ছ্বাস, কী উচ্ছ্বাস তখন!
একটা নতুন কুঠার আনতে বললেন একজনকে। নিমেষে ঘরের ভিতর থেকে একটা আনকোরা কুঠার চলে এল। তিনি সেই নতুন কুঠার আর ‘চুল’ তুলে দিলেন আমার হাতে। বললেন, ‘‘ওদের বল, আমি একজন ভাল শিকারি ছিলাম।’’
বেদি তাই-ই বুঝিয়ে দিলেন আমাদের।
রাত গড়াল। এক ফালি চাঁদ আকাশে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারোটা। অন্ধকার রাতে, জঙ্গলে খস খস পায়ের আওয়াজ। হঠাৎ একদল লোক ঢুকল ঘরে। কে ওরা? লংক্লথ পরা। এছাড়া শরীরে আর কিচ্ছুটি নেই। প্রত্যেকের হাতে বল্লম-কুঠার। একজনের কাছে অন্য একটা হাতিয়ার। যাকে বলে মাজল-লোডার। সেই একই রকম কালো উল্কি-আঁকা মুখ। কানে .১২ বুলেট। বেদি ওদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। এবার আলাপটা জমে উঠল। একটু পরে ওরাও যেন কিছুটা সহজ হল আমাদের সঙ্গে। ‘নরম’ হল বলা যায়। কয়েকটা লিফলেট দেখাল আমাদের। তাতেই বুঝলাম, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ফুটে উঠেছে প্রতিটা অক্ষরে, প্রতিটা ছত্রে। ওদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, ভারত তাদের পিতৃভূমি কেড়ে নিতে চাইছে। এতজন লোকের কানে বুলেট দেখে বুঝলাম, এই বুলেট পরার ব্যাপারটা ওদের কাছে পৌরুষের চিহ্ন। এ দিকে নাগাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। জীবনধারণের যুদ্ধে নাগা পুরুষরা কখনও সেভাবে কাঁধ মেলায় না। মহিলারা শুধু গৃহস্থলির কাজ সামলান তা নয়, পরিবারের জন্য বাইরে বেরিয়ে রোজগারও করেন। বহু পুরুষ নেশায় কাটায় দিনভর। আর? এক গ্রামের সঙ্গে অন্য আর এক গ্রামের লড়াই-এ জিত হলে, তাঁরা জয়োল্লাসে আমোদ করেন। ক’দিন থাকতে থাকতে বেদি আমি আর বাসু তিনজনেই খুব বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। ওখান থেকে ফিরে আসার বেশ কিছু কাল পরেও তাই। বেদি আমার বিয়েতেও এসেছিলেন। তারপর আর বহুদিন যোগাযোগ ছিল না।
কয়েকমাস আগে দিল্লি থেকে একটা ফোন। ও প্রান্তের মানুষটি বললেন, ‘‘নাগিনীমোড়ার কাউকে চেনেন আপনি?’’
প্রথমটা বুঝতে পারছিলাম না। তারপর, আরে!! এ তো বেদির গলা!
সঙ্গে সঙ্গে একটা রি-ইউনিয়ন হয়ে গেল।
নেট ঘেঁটে বেদি আমায় খুঁজে বের করেছেন। বন্ধুত্বের জোর এতটাই!!
আমার স্বীকার করতে বাধা নেই, মাথা শিকারীর শিরস্ত্রাণ, সেই কালো কালো দাঁত, হাতে ধরা চকচকে কুঠার, এসব ছবিগুলো ভয়ঙ্কর। কয়েকজনের কানের লতি থেকে গজিয়ে ওঠা শিং-এর দৃশ্য সত্যিই স্মৃতি থেকে তাড়ানো যায় না।
যে সব ছবি মনে থেকে যায় সেগুলো অমূল্য।
কিন্তু মনের উষ্ণতা? তাকেই বা ভুলি কী করে!
সেই শিকারির বাড়ির সার সার নরমুন্ডগুলো আজও আমাকে ভয় দেখায়।
কিন্তু তাঁর দেওয়া দু’ফুট লম্বা কাঠের টুকরোয় লাগানো চারটে ভেড়ার সিং আর মরা মেয়ের মাথা থেকে ছিঁড়ে আনা বহু পুরনো চুলের গুছি আমার ঘরের দেওয়ালে আজও শোভা পাচ্ছে। এখনও।
এ গল্পের এখানেই শেষ!
এই সরল চাহনিই বা ভুলি কী করে |
রাত গড়াল। এক ফালি চাঁদ আকাশে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারোটা। অন্ধকার রাতে, জঙ্গলে খস খস পায়ের আওয়াজ। হঠাৎ একদল লোক ঢুকল ঘরে। কে ওরা? লংক্লথ পরা। এছাড়া শরীরে আর কিচ্ছুটি নেই। প্রত্যেকের হাতে বল্লম-কুঠার। একজনের কাছে অন্য একটা হাতিয়ার। যাকে বলে মাজল-লোডার। সেই একই রকম কালো উল্কি-আঁকা মুখ। কানে .১২ বুলেট। বেদি ওদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। এবার আলাপটা জমে উঠল। একটু পরে ওরাও যেন কিছুটা সহজ হল আমাদের সঙ্গে। ‘নরম’ হল বলা যায়। কয়েকটা লিফলেট দেখাল আমাদের। তাতেই বুঝলাম, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ফুটে উঠেছে প্রতিটা অক্ষরে, প্রতিটা ছত্রে। ওদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, ভারত তাদের পিতৃভূমি কেড়ে নিতে চাইছে। এতজন লোকের কানে বুলেট দেখে বুঝলাম, এই বুলেট পরার ব্যাপারটা ওদের কাছে পৌরুষের চিহ্ন। এ দিকে নাগাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। জীবনধারণের যুদ্ধে নাগা পুরুষরা কখনও সেভাবে কাঁধ মেলায় না। মহিলারা শুধু গৃহস্থলির কাজ সামলান তা নয়, পরিবারের জন্য বাইরে বেরিয়ে রোজগারও করেন। বহু পুরুষ নেশায় কাটায় দিনভর। আর? এক গ্রামের সঙ্গে অন্য আর এক গ্রামের লড়াই-এ জিত হলে, তাঁরা জয়োল্লাসে আমোদ করেন। ক’দিন থাকতে থাকতে বেদি আমি আর বাসু তিনজনেই খুব বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। ওখান থেকে ফিরে আসার বেশ কিছু কাল পরেও তাই। বেদি আমার বিয়েতেও এসেছিলেন। তারপর আর বহুদিন যোগাযোগ ছিল না।
শিঙের নীচে মৃত কিশোরীর কেশ |
শেষ
(লেখক ৬০-এর দশক থেকে সাংবাদিকতায়। ’৭০-এর গোড়া থেকেই টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এফটিটিআই (পুণে)-এর প্রাক্তনী। বিবিসি লন্ডন, এআইবিডি মালয়েশিয়া, এনডিআর জার্মানি, এবিসি অস্ট্রেলিয়া-য় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। নির্মিত তথ্যচিত্রের জন্য ২টি জাতীয় পুরষ্কার ও ২৮টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছেন। লেখাটি ‘আ ক্যানডিড ক্যানভাস’ ইংরেজি বইটির প্রকাশিতব্য বাংলা গ্রন্থ থেকে নেওয়া। যার অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়)
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment