Sunday, August 16, 2020

জীবন যে রকম ১৪ - শেষজীবনে অবনঠাকুরের সঞ্চয় শুধু তিন রঙা মধু ২য় পর্ব - বিনোদ ঘোষাল

শেষজীবনে তাঁর সঞ্চয় শুধু তিন রঙা মধু ২য় পর্ব

বিনোদ ঘোষাল
নিবন্ধকার, ঔপন্যাসিক


অদ্ভুত বৈপরীত্যে ভরা জীবন বটে! তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি কিনা আর্ট কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ হলেন। রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি ভারতে এলে তাঁদের আর্ট গ্যালারি দেখাতে, ওরিয়েন্টাল আর্ট নিয়ে বোঝাতে দায়িত্ব নিলেন। ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সিইই উপাধি পেলেন। লন্ডনে তাঁর ছবির প্রদর্শশালা হল। ইংরেজ শাসনকালেই কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের কাছ থেকে ডি-লিট পেলেন তিনিই। আবার তাঁর রবিকার স্বদেশী আন্দোলন, রাখিবন্ধন উৎসবের হোতাও সেই একই মানুষ। রবীন্দ্রনাথ যখন একের পর এক দেশপ্রেমের গান লিখছেন, তাকে ছবির রূপ দিচ্ছেনও তাঁর আদরের ভাইপোটি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কী অদ্ভুত মানুষ দেঝুন, ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ডাকে যে চিত্রকর শিল্পকলা নিয়ে অনবদ্য বক্তৃতা দিচ্ছেন, যা কিনা পরে কালজয়ী গ্রন্থ ‘বাগীশ্বরী প্রবন্ধাবলী’ নামে প্রকাশিত হচ্ছে, সেই মানুষই শেষ জীবনে তুলি ধরাই ছেড়ে দিচ্ছেন। বদলে করছেনটা কী?কুটুম-কাটাম! ফ্যালনা জিনিসপত্তর দিয়ে শিশুদের খ্যালনা তৈরি। তার এক ভারী মনোরম গপ্পো পাবেন রানী চন্দের লেখা ‘ঘরোয়া’-তে। সেই গল্প দিয়েই শুরু করি।

এই মগ্ন চিত্রকরই শেষ বয়সে ছেড়ে দিয়েছিলেন রং, তুলি
একটা কাঠের ইঁদুর তৈরি করছিলেন। শুধু লেজটুকু জোড়া বাকি ছিল তার। সে গল্প রানী চন্দ শুনছেন তাঁরই কাছে। জোড়াসাঁকো বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে। সৃষ্টিকর্তা ইঁদুর-মালিকটি তাঁকে বলছেন, তাঁর সৃষ্টি কী ভাবে হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে বাগানে লাফ দিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে! তন্ন তন্ন করেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! রানি তাঁর গুরুদেবকে সেই গল্প বললে, আশি বছরের রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সত্তর বছরের ভাইপোটিকে নিয়ে নাকি বলেছিলেন, ‘‘অবন চিরকালের পাগলা!’’ তাঁর এমন অসংখ্য পাগলামোর নমুনা থেকে আরও খানকতক তুলে দিই। তবে সে সব নিখাদ পাগলামো বলব, নাকি উল্টো খাতে জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার, তাকে স্বাদে-গন্ধে আরও ভরপুর করে তোলার সাপুড়ে-ভাবনা বলব, জানি না! নাতি মোহনলালের গল্পে যাই। মা-হারা মোহনলাল তখন তাঁর দাদামশাইয়ের বড় সঙ্গী। ‘দক্ষিণের বারান্দা’য় মোহনলাল লিখছেন, ‘‘লেখকদের সঙ্গে আর তাঁদের লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় আমাদের খুব ছেলেবেলা থেকেই। কত্তাবাবা (রবীন্দ্রনাথ), দাদামশাই (অবনীন্দ্রনাথ), বাবার (মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়) কথা ছেড়েই দিলুম, এ ছাড়া লেখক-সমাগম জোড়োসাঁকো-বাড়িতে কম হত না। আমাদেরও তাই শখ যেত লেখার।’’ কিন্তু উপায়? ‘দাদামশাই’ শুনলেন। উপায়ও বাতলে দিলেন, ‘‘এত ভাবনা কীসের! স্বপ্ন দেখিস না? সেগুলোই লিখে ফেল।’’
তাঁর প্রিয় ছাত্র নন্দলাল
ব্যস। পড়াশুনো তখন শিকেয়। পরদিন মাস্টারমশাই এসে দেখলেন, দু’তক্তা শ্রীরামপুরী কাগজ লম্বালম্বি চার টুকরো করে কেটে গঁদের আঠা দিয়ে জুড়ে রাখা হয়েছে। তাতে স্বপ্ন লিখবে তাঁর ছাত্রদল! ভাবুন একবার! ওঁর জীবনেরও সবখানে কেমন যেন তাঁর রবিকা’র গানের মতো ‘ভাবনাতে মোর লাগিয়ে দিলে ঝড়ের হাওয়া’! সেই ঝোড়ো হাওয়ার সওয়ারি হওয়ার কথা আরও পাবেন তাঁর লেখার আঁতুড় ঘরে প্রবেশ করলে। রবিকার উৎসাহে তাঁর লেখার শুরু। এই বস্তাপচা কথাটি বারবার বলে অনেকেই হাত ধুয়ে ফেলেন। যেন ওটুকুই অবনঠাকুর এবং তাঁর লেখাজোকা! তারপর সে লেখা বইল কোন খাতে, তার জন্মগুলো কীভাবে, তার দিকদর্শন নেই। অথচ ফিরে ফিরে দেখা দরকার সে সবই। ‘ক্ষীরের পুতুল’। কী ভাবে মক্সো করছেন, দেখুন। রবিকা’র স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর প্রয়াণের পর তাঁর একটি খাতা পেলেন রবি-পুত্র রথীঠাকুরের কাছে। তাতে রূপকথার গল্প লেখা। শোনা যায়, ক্ষীরের পুতুল-এর ভাবনাটি তারপরই। ‘ভূতপতরির দেশে’। গিয়েছিলেন পুরী বেড়াতে। সপরিবার। রাতবিরেতে হঠাৎ ঠিক করলেন কোণারক যাবেন। চন্দ্রভাগায় সূযোর্দয় দেখবেন। রাত ৮টায় পালকি করে বেরিয়ে পড়লেন সকলকে নিয়ে। সময়কাল ১৯১৫-র আশেপাশে। সারা রাত হুম হুম না, হুম হুম না! পথঘাট নির্জন। ছমছমে। সেই অনুভূতিই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিল ‘ভূতপতরির দেশে’! ‘বুড়ো আংলা’। সেলমা লাগেরলফ বলে এক লেখিকা ছিলেন। সুইডেনের। ১৯০৬-এ তাঁর একটা বই বেরল ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চারাস অব নিলস’। গল্পের নায়ক নিলস নামের এক বালক। হাঁসের পিঠে চড়ে যে ঘুরে বেড়ায়। অসম্ভব জনপ্রিয় হল বালকটি। বড়দিনের উৎসবে সুইডেন-বাজার কাঁপিয়ে দিল নিলস ও তার সাগরেদ হাঁস। খড়ের পুতুল হয়ে সে সব বিকোতে লাগল দোকানে দোকানে। তখনই অবনঠাকুরের এক ফরাসি বান্ধবী, আঁদ্রে কার্পেল তাঁকে পাঠান ওই পুতুল। সেই পুতুলই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিল ‘বুড়ো আংলা’। যার প্রথম প্রকাশ মৌচাক পত্রিকায়। যা বই আকারে বেরয় ১৯৪১-এ। তাঁর রবিকা যে বছর গেলেন এ ধরাধাম ছেড়ে! যেমন ছিলেন শিশুসাহিত্যিক, তেমনই ছিলেন শিশুপ্রেমিক, আর তাঁর ছাত্রপ্রেম? শিক্ষক হয়ে তাঁর বিরল সব আচরণ? সে যে কী অনন্য নির্মল স্পর্শকাতরতায় মোড়া! অসম্ভব প্রিয় ছাত্র ছিলেন নন্দলাল বসু। তাঁর গল্প বলি। গুরুমশাইকে তিনি ‘উমার তপস্যা’ বলে একটি ছবি এঁকে দেখালেন। গুরু বললেন, ‘‘আহা, এত রং কেন? আর কিছু না করো, উমাকে একটু চন্দন, ফুলটুল দিয়ে সাজাও।’’ ছাত্র গেল ফিরে। এদিকে কিছুক্ষণ বাদ থেকেই গুরুমশাইয়ের শুরু হল অস্থিরতা, ‘ইস! কেন বললাম এ কথা! নন্দ হয়তো ও ভাবে উমাকে দেখাতেই চায়নি। তাছাড়া তপস্যায় বিভোর উমা কেনই বা খামোকা ফুল-চন্দনে সাজবে।’ সারারাত ঘুম হল না এই ভাবনায়। ভোর হতেই ছুটলেন ছাত্রের কাছে। ছাত্র তখন গুরুমশাইয়ের কথা মেনে তুলি নিয়ে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। পড়িমড়ি করে থামালেন শিষ্যকে। দোষ কবুল করলেন নিজের, ‘ইস্, আরেকটু হলেই দিতাম ছবিটি নষ্ট করে!’ এমন এক উদার মানুষ, অগাধ পাণ্ডিত্যের মাঝদরিয়ায় থেকেও অহং বলতে যাঁর ছিটেফোঁটা নেই, শেষমেশ তিনিই কী দুঃখী! তবে তা নিয়ে কোনও অভিযোগটি নেই কারও কাছে। শুধু মানতেন শিল্পীজীবন বড় দুঃখের। এক জায়গায় অবনঠাকুর বলছেন, ‘‘বসন্তে যখন জোয়ার আসে, ফুল ফুটিয়ে ভরিয়ে দেয় দিকবিদিক। আবার ভাঁটার সময় তা ঝরিয়ে দিয়ে যায়। আমারও যাবার সময়ে যা দু’ধারে ছড়িয়ে দিয়ে গেলুম। তোমরা তা দেখতে পাবে, জানতে পাবে, কত ঘাটে ঠেকেছি, কত পথে চলেছি, কী সংগ্রহ করেছি ও সংগ্রহের শেষে কী বকশিশ পেয়ে গেছি। এতকাল চলার পরে বকশিশ পেলুম আমি তিন রঙের ফোঁটা মধু।’’ কথার গায়ে কেমন মর্মর ধ্বনি, না! যে মানুষ সারাজীবনে এত রামধনু জাগিয়েছেন, আশৈশব রঙের আড়তদার যিনি, শেষকালে তিনিই কিনা ঠেকছেন তিন রঙে! বৈপরীত্য এখানেও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। কিন্তু এই পরিণতি বড় নির্মম। এই নির্মমতার নিয়ন্ত্রক কে, কে জানে!
শেষ
সম্পাদনা সহযোগীঃ সুশোভন মুখোপাধ্যায় 

প্রান্তবেলায় এক সম্বর্ধনা সভায়
ঋণঃ অবনীন্দ্র রচনাবলী, জোড়াসাঁকোর ধারে, দক্ষিণের বারান্দা, ঘরোয়া, বাবার কথা, আনন্দবাজার পত্রিকা
 

1 comment:

  1. বড় ভালো একটা লেখা। কত অজানা কথা জানলাম।

    ReplyDelete