Thursday, August 6, 2020

জীবন যে রকম ১৩ - প্লেগ কেড়ে নিয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যাকে ১ম পর্ব - বিনোদ ঘোষাল

প্লেগ কেড়ে নিয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যাকে ১ম পর্ব

বিনোদ ঘোষাল
নিবন্ধকার, ঔপন্যাসিক


তিনি চিত্রকর। তিনি শিল্পাচার্য। তিনি অসাধারণ এক
মাস্টারমশাই। কিন্তু ক’জন জানেন তিনি ছিলেন দরদিয়া সারেঙ্গি-বাদক? এমনকী মস্ত অভিনেতাও! যাঁর কাছে প্রায়শই অভিনয়ের পাঠ নিতে হাজির হতেন শিশির ভাদুড়ী, কী অহীন্দ্র চৌধুরী! তাঁর কথা ভেবেই নাকি তাঁর বিশ্বখ্যাত কাকা নাটক লিখতে বসে ভাইপোর অভিনয়ের ধাঁচটি মাথায় রেখে একটি চরিত্র রাখতেনই রাখতেন! ২০২১-এ তিনি ১৫০। অগস্টের ৭, ১৮৭১-এ তাঁর ভুবনে আসা। তিনি অবনঠাকুর। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গুনেন্দ্রনাথ, সৌদামিনীর পুত্র। রবীন্দ্রনাথের অতি আদরের ভাইপো। সাহিত্যপ্রেমী সবাই বলেন, গদ্য তো নয়, যেন ছবি লিখতেন তিনি! তার চলনে কেবলই দৃশ্য আর দৃশ্যকল্পের আঁচড়! তার থেকেই দু’কলম ‘শকুন্তলা’ শোনাই। তারপর না হয় তাঁর জীবনে যাব। অবনীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘‘মালিনীর জল বড় স্থির— আয়নার মতো। তাতে গাছের ছায়া, নীল আকাশের ছায়া, রাঙা মেঘের ছায়া— সকলই দেখা যেত। আর দেখা যেত গাছের তলায় কতগুলি কুটিরের ছায়া।’’ এ তো তা’ও প্রকৃতির। ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ সুয়োরানীর বর্ণনাটি পড়ুন— ‘‘সুয়ো রানি সাতমহলা বাড়িতে থাকেন। সাতশো দাসী তার সেবা করে। পা ধোওয়ায়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। সাত মালঞ্চের সাত সাজি ফুল, সেই ফুলে সুয়ো রানি মালা গাঁথেন। সাত সিন্দুক ভরা সাত রাজার ধন মানিকের গহনা, সেই গহনা অঙ্গে পরেন। সুয়ো রানি রাজার প্রাণ।’’ সুখী, বিলাসী রানীর গদ্য এমন। এখান থেকে চলে যাব দাসীর বর্ণনায়। তাঁর ‘আপন কথা’ থেকে তুলে দিচ্ছি— ‘‘একেবারে রাতের অন্ধকারের মতো কালো ছিল আমার দাসী— সে কাছে বসেই ঘুম পাড়াত কিন্তু অন্ধকারে মিলিয়ে থাকত সে, দেখতে পেতেম না তাকে। কোনো-কোনো দিন অনেক রাতে সে জেগে বসে চালভাজা কটকট চিবোত, আর তালপাতার পাখা নিয়ে মশা তাড়াত। শুধু শব্দে জানতেম এটা। আমি জেগে আছি জানলে দাসী চুপি-চুপি মশারি তুলে একটুখানি নারকেল-নাড়ু অন্ধকারেই আমার মুখে গুঁজে দিত— নিত্য খোরাকের উপরি পাওনা ছিল এই নাড়ু!’’
বইটির প্রচ্ছদ
শব্দের গায়ে যেমন মায়া, তাঁর জীবনের শরীর জুড়ে যেন তারই ছায়া! কন্যা-বিয়োগ যখন সইলেন, তার অব্যবহিত পর স্ত্রীকে ঘিরে তাঁর যে কাতরতা, সেই কাহিনিতে যাই। খানিক বুঝবেন তবে। কলকাতায় তখন প্লেগ। মহামারি। সেই মারিই কেড়ে নিল তাঁর আদরের কন্যটিকে। এ দিকে শোক করবেন কী, স্ত্রী যে পাগলপারা! আগে তাঁকে যে জুড়োতে হবে। অনেক পাখি কিনে দিলেন তাঁকে। বাচ্চা বাচ্চা আদুরে পাখি। টিয়া, ময়না, চন্দনা। তাদের যত্নআত্তি করতেন স্ত্রীর সামনেই। ভারী আদর করে খেতে দিতেন মুসুর ডাল সিদ্ধ, ছাতুর গোলা। ক’দিন পরে তারা যখন বড় হত, ছেড়ে দিতেন আকাশে। কোনও পাখির অসুখ হলে নাওয়াখাওয়া যেন যেতেন ভুলে! পুঁথিপত্র নেড়েঘেঁটে ওষুধ দিতেন, পথ্য দিতেন। তাতেও কারও কারও শরীর না সায় দিলে তাকে কোলে শুইয়ে বসে থাকতেন ঠায়! এ ভাবে তাঁর পাখি-সঙ্গ কোথাও বোধহয় টুকরো টুকরো স্বস্তির দানা বিলোতো পাশে থাকা আনমনা সন্তান-হারা ভার্যাকে! সে স্বস্তি যে তাঁকেও শান্ত করত! তখন তাই-ই যে চাওয়া তাঁর। হয়তো’বা একমাত্র চাওয়া! ভেতরে দগদগে ঘা-এর জ্বালা ভুলে কন্যাশোক দাবিয়ে রাখাটাই তখন একাধারে পিতা ও স্বামীর দস্তুর! পরে সে জ্বালা পুষিয়ে ছিলেন যে ভাবে, সে’ও বোধহয় তাঁকেই মানায়! প্রাণ ঢেলে আঁকলেন ছবি, ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’! প্রশংসার পর প্রশংসা। তাতে তিনি বললেন, ‘‘এই ছবি কি এত ভাল হয়েছে সাধে? মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম। শাহজাহানের মৃত্যু-প্রতীক্ষাতে যত আমার বুকের ব্যথা, সব উজাড় করে দিলুম।’’ কন্যা শোক দাবিয়ে রাখাকে যদি কাঠিন্য বলি, তার প্রকাশকে, তাকে উড়ান দেওয়ার ঢংকে তবে কী বলি? তরল? কোমল? মোলায়েম? শব্দ যেন কুলোয় না, বরং দুই-এ মিলেজুলে মায়ার খেলাটিই বোধহয়
‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’
ক্রমে বড় হয়। দানা দানা হয়ে তাই-ই বেজে চলে ভগ্ন, জীর্ণ, বাতিহীন নাচমহলের চাপা হাহাকারের মতো! বড় মেয়ে উমাকে একবার বলেছিলেন, ‘‘জানিস, কোথা থেকে না আমন্ত্রণ পেয়েছি। দিল্লি, লাহোর, জয়পুর, বম্বে, মাদ্রাজ, মহীশূর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, চীন সব জায়গা থেকে আমায় ডেকেছে। কেন যাইনি জানিস? তোর মাকে একলা রেখে যেতে হবে বলে। বড় ভীতু ছিল সে।’’ কথাটি শুনলে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়! তবে যে আমরা বলি, শিল্পীমন বড় বিবাগী, উদাসী, আলাভোলা, বে-সংসারী, বারোয়ারি! বড় ভারী লাগে মন? সত্যিই তাই। চলুন, থামি তবে। চলে যাই ওঁর শৈশবে। দামাল, দস্যি অবনের ছেলেবেলায়। লাল-লাল মাছ দেখে যার মনে হয়েছিল, এদের লাল জলেই থাকা ভাল। জলে গুলে দিয়েছিলেন লাল গুঁড়ো। নিমেষে মাছের দল মরে ভেসে উঠেছিল জলে। বাড়িতে শিখ দারোয়ান। তাঁর মস্ত গোঁফ। তাঁকে নাজেহাল করে ছাড়ত ওই একরত্তি ছেলে! সুযোগ পেলেই এক টান দিয়ে দুদ্দাড়িয়ে পগার পার! একবার বাটালি দিয়ে লুকিয়ে কাঠের কাজ করতে গিয়ে আঙুল কেটে রক্তারক্তি। সেই কাটা দাগ আজীবন বইতে হয়েছে তাঁকে। বড় বেলায় এই ‘দস্যিমে’ দেখা দিল অন্য ভাবে। সে গল্প বলতে গেলে, নিজের হাতে গড়া নাটকের দল ‘ড্রামাটিক ক্লাব’-এর কথা বলতেই হয়! ক’দিন পরেই ক্লাব গেল উঠে। এ দিকে তহবিলে তখন বিস্তর টাকাপয়সা। সে অর্থ তখন অনর্থ। অতএব? নামী হোটেলে এলাহী খাবারের হুকুম দিলেন অবন। তার সঙ্গে করলেন ক্লাব ‘ড্রামাটিক’-এর নাটকীয় শ্রাদ্ধ! চিত্রকর-সাহিত্যিক বোধহয় একেই বলে, জীবনের রং খুঁজতে ঢং লাগে না। আবার দরকারে ঢং চাপা দিতে আষ্টেপৃষ্টে এমনই রঙের পোঁচ ধরান, তখন তাঁর মনের তল পায় কার সাধ্যি!
সম্পাদনা সহযোগীঃ সুশোভন মুখোপাধ্যায় 
পরের অংশ ২য় পর্বে
জোঁড়াসাঁকোয় তাঁর সত্তর বছর জন্মদিনে এসরাজ বাজাচ্ছেন অবনীন্দ্রনাথ পাশে নন্দলাল বসু
ঋণঃ অবনীন্দ্র রচনাবলী, জোড়াসাঁকোর ধারে, দক্ষিণের বারান্দা, ঘরোয়া, বাবার কথা, উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা

4 comments: