বাল্মীকির রাম বীরপুরুষ কৃত্তিবাসী রাম গৃহস্থ বাঙালি ১ম পর্ব
সিদ্ধেশ্বর সাঁই
ভাষাবিদ, ডক্টরেট, প্রাক্তন শিক্ষক, দ্য স্কটিশচার্চ কলেজিয়েট স্কুল
মূল রামায়ণ-এর কিছুটা তিনি বর্জন করেছেন। সংযোজনও ঘটিয়েছেন খানিক। চরিত্র-রূপায়ণেও তিনি বাল্মীকির চেয়ে অনেকটাই তফাতে। তাঁর রামায়ণ জন্ম নেয় রাজার অনুরোধে! তিনি কৃত্তিবাস ওঝা! ‘চর্যাপদ’ ও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য আবিষ্কারের পূর্বে যাঁকে ‘বাংলাভাষার আদিকবি’ বলা হত।
এ প্রসঙ্গে কবির বংশতালিকা গ্রন্থে অর্থাৎ ‘মহাবংশাবলী’ গ্রন্থের কাথা উল্লেখ করা যায়। ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সেখানে ধ্রুবানন্দ মিশ্র লিখেছেন, ‘কৃত্তিবাসঃ কবির্ধীমান্ সৌমঃ শান্তো জনপ্রিয়ঃ’। কুলজি গ্রন্থে কৃত্তিবাসকে সুপণ্ডিত ও ধীমান বলা হয়েছে।
দুই রামায়ণ-এ ফারাক ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার আগে একটু মুখড়া কিন্তু লাগে।
প্রথম কথা হল, এ কথা ভুললে চলে না, বাল্মীকি মহাকাব্য রচনা করেছেন। আর কৃত্তিবাস ওঝা রচনা করেছেন পাঁচালী-কাব্য। ‘পাঁচালী’ ও ‘মহাকাব্য’ কখনওই তুলনীয় হতে পারে না। যদিও তার জন্য কৃত্তিবাসের কীর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না। বছর বছর ধরে ‘শ্রীরামপাঁচালী’ বাংলার আমজনতার খুবই প্রশংসা পেয়েছে। পেয়ে চলেছে।
এখন প্রশ্ন হল, এই কৃত্তিবাস কবিবরটি ঠিক কোন সময়ের? তাঁর জন্মকালই বা কী? কী বা তাঁর বংশ-পরিচয়?
এখানে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম জীবনীকার জয়ানন্দর প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে পারি। তাঁর ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যে জয়ানন্দ লিখেছেন, ‘রামায়ণ করিল বাল্মীকি মহাকবি। পাঁচালী করিল কৃত্তিবাস অনুভবি।।’
আবার, কৃত্তিবাস তাঁর আত্মবিবরণীতে বলছেন, ‘আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য(মতান্তরে পূর্ণ)মাঘ মাস। তথিমধ্যে জন্মিলেন পণ্ডিত কৃত্তিবাস।।’
এ বিষয়ে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় নানারূপ জ্যোতিষ গণনার দ্বারা মনে করেন ১৩৮৬ থেকে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কৃত্তিবাস মাঘ মাসের সংক্রান্তিতে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রবিবারে সরস্বতীপুজোর দিন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যদি তরুণ-যৌবনে গৌড়েশ্বরের সভায় যান, তা’হলে সময়টা ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি হবে। তখন গৌড়ের সিংহাসনে ‘হিন্দুরাজা গণেশ’ অধিষ্ঠিত ছিলেন।’
এরকমই কথা বলে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্তে আসেন কৃত্তিবাস প্রাক্-চৈতন্যযুগের কবি।
অন্যদিকে কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণী থেকে অনুমান করা যায় যে, চন্দ্রদ্বীপের রাজা দনুজ রায়ের পাত্র নরসিংহ ওঝা রাজনৈতিক সংকট ও গোলমালে ভীত হয়ে বঙ্গদেশ ছেড়ে গঙ্গাতীরে ফুলিয়া গ্রামে (ফুলমালঞ্চ গ্রামে) এসে বসতি স্থাপন করেন। দনুজ রায় ছিলেন ত্রয়োদশ শতকের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। আর তাঁর পাত্র নরসিংহ ওঝার খোঁজ করলে কৃত্তিবাসের যে পরিচয় পাই, সেখান থেকে, অনুমান করা যায়, নরসিংহের পুত্র গর্ভেশ্বর। তাঁর পুত্র মুরারি। মুরারির পুত্র বনমালী ওঝার পুত্র কৃত্তিবাস। আর তাঁর জন্ম হচ্ছে চতুর্দশ শতকের শেষে বা পঞ্চদশ শতকের প্রথমে।
কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কৃত্তিবাসের সময় গৌড়েশ্বর ছিলেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ। কিন্তু রুকনুদ্দিন সিংহাসনে বসেন ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে। তা’হলে কৃত্তিবাস তো চৈতন্যপরবর্তী যুগের কবি হয়ে পড়েন। যে কথার সমর্থন অন্যত্র মেলে না।
ঘটকদের কুলজি-গ্রন্থে কৃত্তিবাসের যে বংশপরিচয় আছে, তার থেকেই তাই সঙ্গত কারণে অনুমান করা হয়েছে, হিন্দু রাজা গণেশের রাজত্বকালে অর্থাৎ পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে কৃত্তিবাস তাঁর ‘শ্রীরামপাঁচালী’ কাব্য রচনা করেন।
ঘটকদের কুলজি-গ্রন্থে কৃত্তিবাসের যে বংশপরিচয় আছে, তার থেকেই তাই সঙ্গত কারণে অনুমান করা হয়েছে, হিন্দু রাজা গণেশের রাজত্বকালে অর্থাৎ পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে কৃত্তিবাস তাঁর ‘শ্রীরামপাঁচালী’ কাব্য রচনা করেন।
এখান থেকেই এই গ্রন্থ নির্মাণের নেপথ্য-কাহিনিতে আসি।
সেই সময় রীতি ছিল, ‘গৌড়েশ্বর পূজা কৈলে গুণের হয় পূজা।’ কৃত্তিবাস তা জেনে প্রশস্তিমূলক সাতটি শ্লোক রচনা করেন। তার অনুলিপি নিয়ে গৌড়ে যান তিনি। দ্বারীর মারফত সেই লিপি তিনি গৌড়েশ্বরের কাছে পাঠান।
যা পেয়ে স্তম্ভিত রাজা। কিছুক্ষণের মধ্যে রাজদূতকে ডেকে পাঠান তিনি। আদেশ দেন, এখনই আগত ব্যক্তিকে তাঁর সম্মুখে হাজির করতে হবে। হন্তদন্ত হয়ে দ্বারে এসে রাজদূত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কাহার নাম ফুলিয়ার পণ্ডিত কৃত্তিবাস। /রাজার আদেশ হৈল করহ সম্ভাষ।।’’
কৃত্তিবাস পরিচয় দিলেন নিজের। তাঁর অন্দরে যাবার অনুমতি মিলল তখনই।
দূত তাঁকে নিয়ে গেলে রাজার কাছে। সেখানে পৌঁছে রাজার থেকে চার হাত দূরে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর স্বরচিত রাজপ্রশস্তিমূলক সাতটি শ্লোক আবৃত্তি করে শোনালেন। নানা ছন্দে রচিত সরস শ্লোককয়টির আবৃত্তি শুনে গৌড়েশ্বর অতিশয় প্রীত। কৃত্তিবাসের গলায় পুষ্পমাল্য পরিয়ে দিলেন তিনি। জনৈক রাজসভাসদ তাঁর মাথায় ছিটিয়ে দিলেন চন্দন।
এরপর রাজা তাঁকে পট্টবস্ত্র প্রদান করে সম্বর্ধনা দিয়ে জানতে চাইলেন, কবিবর কী দান গ্রহণ করতে চান?
তাতে সবিনয়ে কৃত্তিবাস বললেন, গৌড়েশ্বরদত্ত সম্মানই তাঁর শ্রেষ্ঠ দান। তিনি আর কিছু দান চান না।
কৃত্তিবাসের কথায় খুবই সন্তুষ্ট হলেন রাজা। এবং তাঁকে বাংলা ভাষায় ‘রামায়ণ’ রচনা করতে অনুরোধ করলেন।
শেষাংশ পরের পর্বে
বিশেষ সহায়তা:জয়দীপ সেন
ছবিঃ সৌজন্যে কৃত্তিবাস মেমোরিয়াল, Indianet zone, Alchetron
No comments:
Post a Comment