![]() |
বাল্মীকির রাম বীরপুরুষ কৃত্তিবাসী রাম গৃহস্থ বাঙালি ২য় পর্ব
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgfqnk-SOUQh091J3YyyEvY9AycGbkgQlenYBTNBBzKTIuDVcs9kzi4XMttst8Ol7l3W9AeQ7cTL7JvFLl1jEpr-FtB1tZaDJ5H6_KKTu9buuJqm2P7VxtB495Bn6SiIagrdwLfA2q_5S8/s352/Krittibas4.jpg)
সিদ্ধেশ্বর সাঁই
ভাষাবিদ, ডক্টরেট, প্রাক্তন শিক্ষক, দ্য স্কটিশচার্চ কলেজিয়েট স্কুল
রাজার অনুরোধ।
কৃত্তিবাস লিখতে বসলেন ‘রামায়ণ’।
জন্ম নিতে শুরু হল বাংলা ভাষায় ‘শ্রীরামপাঁচালী’ কাব্য। সাতকাণ্ডে। সরল পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে।
এ বিষয়ে কৃত্তিবাস নিজেই বলছেন, ‘‘সাতকাণ্ড রামায়ণ দেবের সৃজিত/ লোক বুঝাইতে কৈল কৃত্তবাস পণ্ডিত।।’’
যার প্রথম মুদ্রিত সংস্করণটি আসছে কিন্তু অনেক পরে। যে উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে দুই পুরুষ। উইলিয়ম কেরি ও জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। কৃত্তিবাসের প্রাচীন পুঁথি সংশোধন করে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি প্রেস-এ নতুন বসানো প্রিন্টিং মেশিনে কাঠের টাইপ ব্যবহার করে প্রথমবারের জন্য ছাপা হয় এই ঐতিহাসিক গ্রন্থ। সে ১৮০৩ সালের কথা।
পরে আরও একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন মোহনচাঁদ শীল।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের বটতলা সংস্করণ প্রকাশ করলেন তিনি।
তারও পর বিভিন্ন লিপিকারেরা ক্রমিক মূদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে যুগোপযোগী করার চেষ্টায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর বহু পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। ফলে বর্তমানে যে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাওয়া যায়, তাতে কৃত্তিবাসের মূল ভাষা কতটুকু রক্ষিত আছে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ।
এখানে আরও একটি কথা বলা খুব জরুরি।
কৃত্তিবাস মহর্ষি বাল্মীকির রামায়ণের কাহিনি-কাঠামো অপরিবর্তিত রেখেছেন বটে, কিন্তু মৌলিক কল্পনার সাহায্যে বাঙালি জাতির উপযোগী করে কাহিনি ও চরিত্রের নবরূপায়ণ করেছেন তিনি। বাল্মীকি রামায়ণের ধাঁচা থেকে কিছুটা সরে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন বাঙালি-জীবনের স্নিগ্ধতা ও কোমলতা।
ফলে এখানে কতগুলি অনিবার্য ফারাক তৈরি হয়েছে, বাল্মীকি ও কৃত্তিবাসে।
‘শ্রীরামপাঁচালী’তে দশরথ কর্তৃক সিন্ধুবধ কাহিনিতে রয়েছে পিতৃস্নেহের ব্যাকুলতা ও হাহাকার। ভরতমিলন কাহিনিতে ভ্রাতৃস্নেহের প্রাচুর্য। রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ কাহিনিতে রামচন্দ্রের বিলাপে দাম্পত্য প্রেমের মহিমা প্রকাশের যে ঘটনা-বিবরণ, সেখানে মহাকাব্যোচিত বস্তুনিষ্ঠতাকেও অতিক্রম করে ‘গীতিকাব্যের সুরমূর্চ্ছনা’ প্রবল। সবেতেই কেমন যেন বাঙালি ঘরানার প্রকাশ।
চরিত্র রূপায়ণেও বাল্মীকিকে পুরোপুরি অনুসরণ করেননি কৃত্তিবাস।
একে একে বলা যেতে পারে।
বাল্মীকির রামচন্দ্র শৌর্য-বীর্যসম্পন্ন যথার্থ বীরপুরুষ। তিনি নরচন্দ্রমা।
পক্ষান্তরে, কৃত্তিবাসের রাম নবদূর্বাদলশ্যাম। বড়ই কোমল। বড়ই করুণ। ঈশ্বরের প্রেমময় অবতার। কিংবা আদর্শ বাঙালি গৃহস্থটি।
অর্থাৎ কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাল্মীকি-রামায়ণের মতো বীরত্বব্যঞ্জক মহাকাব্য হয়নি।
বরং, গৃহস্থাশ্রমের ভক্তিমূলক কাব্য হয়ে উঠেছে সেটি।
বাল্মীকির কাহিনিতে অহিরাবণ, মহীরাবণ, বীরবাহু, তরণীসেনের মতো রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ ভয়ঙ্কর হিংস্র রণকাহিনি হয়ে উঠেছে।
পক্ষান্তরে, ‘শ্রীরামপাঁচালী’র রাক্ষসদের যুদ্ধ যেন ভক্তিমূলক অলৌকিক যুদ্ধকাহিনি।
বাল্মীকির চিত্রিত সীতা, কৌশল্যা, মন্দোদরীর মতো চরিত্রগুলি দেখবেন, কৃত্তিবাস কেমন বাঙালি নারীসুলভ ভক্তিভাব, স্নেহপ্রবণতা, ভীরুতা, কোমলতা দিয়ে ধরেছেন!
আরও একটি কাহিনিতে যাই।
যেখানে রামচন্দ্র পিতৃসত্যপালনের জন্য চোদ্দ বছর বনবাস যেতে উদ্যত হলে অনুজ লক্ষ্মণ তাঁর অনুগামী হতে ব্যগ্র। সীতাও তখন রামের সহগামিনী হতে চাইছেন। তাতে রামচন্দ্র অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সীতাকে তাঁর সহগামিনী হওয়া থেকে বিরত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, বাল্মীকির সীতা ক্রুদ্ধ হয়ে বলছেন, ‘হে রাম, আমার পিতা জনক তোমাকে আকৃতিতে পুরুষ কিন্তু প্রকৃতিতে নারী জানলে, কিছুতেই তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতেন না।'
সেখানে কৃত্তিবাসী সীতা কী উক্তি করেছেন?
তিনি বলছেন, ‘পণ্ডিত হৈয়া কহো নির্বোধের প্রায়। /কেন হেন জনে পিতা দিলেন আমায়।।"
লক্ষ করে দেখুন, বাল্মীকির সীতার উক্তি কতটা তীব্র, কতটা ব্যজ্ঞাত্মক। কিন্তু কৃত্তিবাসের সীতার বয়ানে ধরা পড়ছে তাঁর ক্ষোভ। তাঁর অভিমান।
এই পরিবর্তন বা ফারাক নজর করে কেউ কেউ একটি যুক্তি দেন।
তাঁরা বলেন, কৃত্তিবাস বাল্মীকি-রামায়ণ পাঠ করার মতো সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না। তিনি কথকঠাকুরদের মুখে রামায়ণ-পাঠ শুনে তাঁর ‘শ্রীরামপাঁচালী’ রচনা করেছেন। তাই এই ফারাক!
উক্তিটি সম্পূর্ণ ভুল। কৃত্তিবাসের যা পরিচয় আমরা পাই, তাতে দেখি তিনি ছিলেন একজন ঋদ্ধ সংস্কৃতজ্ঞ। ফলে তাঁদের এই কথার কোনও ভিত্তিই নেই।
আসল ব্যাপারটি অন্য।
বাল্মীকি-রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ করতে চাননি কৃত্তিবাস। তিনি চেয়েছিলেন ভাবানুবাদ করতে।
সেখানেই তিনি কিছু পরিবর্তনের সড়কে ঢুকে পড়েছেন।
বাল্মীকি রামায়ণের অনুকরণে সাতকাণ্ডে (বালকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরাকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ড ও উত্তরাকাণ্ড) রামায়ণ রচনা করলেও তিনি কোথাও কোথাও মূল রামায়ণের কিছু কিছু কাহিনি বর্জন করেছেন। এমনকী কিছু নতুন কাহিনি সংযোজনও ঘটিয়েছেন।
যেমন, বাল্মীকি রামায়ণের কার্তিকেয়ের জন্ম, অম্বরীশের যজ্ঞ, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের বিরোধ ইত্যাদি কাহিনিগুলি কৃত্তিবাস তাঁর ‘শ্রীরামপাঁচালী’-তে রাখেননি।
আবার মূল রামায়ণে নেই, অথচ কৃত্তিবাস তাঁর ‘শ্রীরামপাঁচালী’তে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, এমন ঘটনাও আছে। যেমন, গুহকের সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব, বীরবাহু তরণীসেনের যুদ্ধ, ১০৮ নীলপদ্ম দিয়ে শ্রীরাম কর্তৃক ‘অকাল বোধন’-এ দেবী দুর্গার আরাধনা, গণকের ছদ্মবেশে হনুমান কর্তৃক মন্দোদরীকে ভুলিয়ে রাবণের ‘মৃত্যুবাণ’ হরণ, রাবণের কাছে রামের ‘রাজনীতি শিক্ষা’, লবকুশের সঙ্গে রামের যুদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রকৃতপক্ষে, কৃত্তিবাসের কবিত্বের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, তিনি পুরাণকাহিনির যুগোচিত নব-রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। তাঁর ‘শ্রীরামপাঁচালী’-তে উপমাদি অলংকারের রসদ সংগ্রহ করেছেন গ্রামবাংলার নিসর্গপ্রকৃতি থেকে। যেমন ধরুন, উদাহরণ দিয়ে বলি।
"দশমুখ মেলিয়া রাবণ রাজা হাসে।/ কেতকী কুসুম যেন ফোটে ভাদ্রমাসে।।"
কিংবা ধরুন। রামচন্দ্রের দুর্ধর্ষ সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করানোর জন্য অকালে কুম্ভকর্ণকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কৃত্তিবাস তার উপমা দিচ্ছেন কী ভাবে?
‘কুম্ভকর্ণস্কন্ধে চড়ি বীরগণ নাচে। বাদুড় দুলিছে যেন তেঁতুলের গাছে।।’
এ যেন বাঙালির আঙিনার কথা! নয় কি?
ভাবে, ভাষায়, কাহিনিবিন্যাসে ও চরিত্রসৃষ্টিতে কৃত্তিবাস ছিলেন ‘একজন খাঁটি বাঙালি কবি’।
খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কৃত্তিবাসী-রামায়ণে অযোধ্যা, চিত্রকূট, ভরদ্বাজ ও অত্রিমুণির আশ্রম যেন এই বাংলাদেশেরই এক একটি বিশিষ্ট স্থান বা আশ্রম। কিংবা ধরুন, রামের জন্মের পঞ্চম দিনে ‘পাঁচুটি ব্রত’, ষষ্ঠ দিনে ‘ষষ্টীপুজো’, অষ্টম দিনে ‘অষ্টকলাই’, এইসব অনুষ্ঠানগুলি তো বাঙালিরই চিরন্তন অনুষ্ঠান।
এবার যদি চলে যাই সীতাদেবীর বিয়ের পর বৌভাতের অনুষ্ঠানে।
সেখানে কী দেখি?
অতিথিদের নিমন্ত্রণরীতি ও নিমন্ত্রিতদের ভোজ পরিবেশনের যে ক্রম, সেখানেও একেবারে বাঙালি ঘরেরই নিজস্ব ঢং। রাজা জনক অতিথিদের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছেন—
"গলে বস্ত্র দিয়া রাজা অতি সমাদরে।/ নিমন্ত্রণ একে একে সবাকার ঘরে।।"
বধূৎসবের ভোজ পরিবেশনের ক্রমটা দেখুন। সেখানেও বাঙালিয়ানা কতটা প্রবল!
"প্রথমেতে শাক দিয়া ভোজন আরম্ভ।/ তারপর সূপ আদি দিলেন সানন্দ।।/ ভাজা ঝোল আদি করি পঞ্চাশ ব্যঞ্জন।/ক্রমে ক্রমে সবাকারে কৈল বিতরণ।।/ শেষে অম্বলান্তে হৈল ব্যঞ্জন সমাপ্ত।/ দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত।।"
কী মনে হচ্ছে, বলুন! এখানেও খুঁজে পেতে কি অসুবিধে হয়, বাঙালিমনা কবিবরের হৃদয়? উত্তরের অপেক্ষা লাগে না। না এবং না।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, ‘কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি এ বঙ্গের অলংকার।’ কিংবা রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘এই বাংলা মহাকাব্যে কবি বাল্মীকির সময়ের সামাজিক আদর্শ রক্ষিত হয় নাই। ইহার মধ্যে প্রাচীন বাঙালী সমাজই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।’
![]() |
শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের তৈরি তাঁরই বংশ তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে কৃত্তিবাস ওঝার উল্লেখ সংগ্রহঃ সুশোভন মুখোপাধ্যায় |
এ সব যে কত বড় খাঁটি কথা, নিপাট বাঙালি কৃত্তিবাসের রচনা পাঠ করলে তা ছত্রে ছত্রে বোঝা যায়!
বিশেষ সহায়তা:জয়দীপ সেন, সুশোভন মুখোপাধ্যায়, কৌশিক দাশগুপ্ত
ছবিঃ সৌজন্যে wikiwand, hali.com
No comments:
Post a Comment