ভারত নিয়ে ফাদারের মধ্যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন তাঁর মামা ১ম পর্ব
কৌশিক দাশগুপ্ত
শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক
তাঁর লেখা বইতে পাওয়া যায় ভরত মুনির ভাবনা।
একদিকে তিনি আইজেনস্টাইনের চূড়ান্ত ভক্ত। তাঁর সত্যজিৎ-প্রীতি বহুজনের জানা। অন্য দিকে ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র সাকসেস তাঁকে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে মারে কলকাতা থেকে ঢাকা।
তিনি খ্রিস্টিয় যাজক! অথচ ‘সোসাইটি অফ জিসাস ইন রোম’-এর এক্সিকিউটিভের পদের শ্লাঘনীয় ডাক ফিরিয়ে তিনি নতুন করে ফিরে আসেন কলকাতায়। সে ১৯৯৯-এর গল্প।
’৬১-তে যখন প্রথমবারের জন্য কলকাতায় এলেন, তখনও এক কাণ্ড! ক’টা বছর তাঁকে সময় দেওয়া হয়েছিল, হয় মন্ট্রিয়লে ফিরে যাও, নয়তো থেকে যাও এ শহরে। ঘড়ির কাঁটা ৫ মিনিট পেরোয়নি, তিনি ভোট দিয়েছিলেন ‘সিটি অফ জয়’-এর পক্ষে!
কত যে এমন জাম্প-কাট করতে করতে লাট্টুর মতো পাক খাওয়া যায় তাঁর বর্ণিল জীবনের সড়কে!
ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ! অগস্ট ২৬-এর সাত সকালে বহু বহু জনের মনটাকে গুমোট মেঘে ছেয়ে দিয়ে তিনি ছায়াপথে পাড়ি দিলেন চিরদিনের মতো! তুড়ি মেরে একটা আস্ত জীবন ছায়াছবিকে বিলিয়ে দিয়ে!
'পথের পাঁচালী'
চলে যাই গোড়ার গল্পে।
১৯৩৫-এ জন্ম কানাডায়।
বয়স যখন দুই-ও পেরোয়নি, বাবাকে হারান। মা একাই বড় করতে থাকেন চার সন্তানকে। শোনা যায়, গাস্তঁর নিজের ‘যাজক’ হওয়ার সাধ কিশোরবেলা থেকেই।
ক’টা বছর যেতে না যেতেই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। রেডার-বিশেষজ্ঞ মামা তখন শ্রীলঙ্কায় কর্মরত। তাঁর কাছেই বোধহয় প্রথম শোনা তাঁর ভারতের কথা। এ দেশ নিয়ে মাতুলের শ্রদ্ধা ধীরে ধীরে ডানা মেলে ভাগ্নের মধ্যে। মামার ঘরে একদিন একটা স্টাফ করা বাঘের চামড়া চোখে পড়ে তাঁর। সে’ও এই উপ মহাদেশের। কৌতূহলের কামড় সেই যে তাঁকে পাকড়ে ধরল, আর ছাড়ান পেলেন কই!
দ্বিতীয় দফায় ফ্ল্যাট হলেন রবিঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’-তে। সে এক মুগ্ধতার মায়া কাজল বুঝি!
ভারতে তাঁকে যেতেই হবে।
জেসুইট মিশন-এর সঙ্গে যুক্ত হলেন। তার পাঁচ বছর পর কলকাতায়। কাজ চাইলেন এ শহরেই। মিশনের কড়া হুকুমদারি তখন, কাজ পেতে হলে থাকতে হবে এখানে, নয়তো ফিরে যেতে হবে দেশে। সময় ৫ বছর।
৫ মিনিট গেল না, গাস্তঁ থেকে যাওয়াতেই রায় দিলেন।
সিনেমা নিয়ে তাঁর ভালবাসা ইস্কুলে প্রাইমারির কোটা পেরোতে না পেরোতেই। প্রত্যেক শনিবার একটি করে ছবি দেখানো হত স্কুলে। গোগ্রাসে গিলতেন সে সব। তারপর কলেজ। যুক্ত হলেন ফিল্ম ক্লাব-এ। বিদেশি ছবি তখন থেকেই পেড়ে ফেলল তাঁকে। ফরাসি ফিল্মতাত্বিক আন্দ্রে বাজাঁ-র প্রভাব তাঁর ঘাড়ের ওপর শ্বাস ফেলছে। কিন্তু আইজেনস্টাইন তাঁর মাথা চক্কর খাইয়ে দিলেন। ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’! ছবিটি দেখার পর গাস্তঁর মনে হল, বাজাঁ-র বাস্তবতার ধারণা এক্কেবারে ‘আইডিয়ালিস্টিক’।
ভাবুন একবার, এই মানুষটিই পরে কিন্তু ক্যাথলিক পাদ্রী হবেন!
জীবন কী বিচিত্র, তাই না!
ফিল্মের নেশা তখন তাঁকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। ভারতীয় ছবি তাঁকে দেখতেই হবে। এ দিকে যুবক গাস্তঁ তখন জেসুইট। মন্ট্রিয়লের চার্চ-কর্তৃপক্ষের কড়া হুকুম, সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া নৈব নৈব চ!
নিউইয়র্ক বন্দর থেকে ভারতগামী জাহাজে ওঠার আগের রাতে হঠাৎই সুযোগ পেয়ে গেলেন সত্যজিতের ‘অপু ট্রিলজি’ দেখার। তিনটি ছবি একটানা দেখে গেলেন। তারপর সে এক অদ্ভুত ঘোর!
সজল শ্যামল দরিদ্র বাংলার ঐশ্বর্যশালী মানবিক দুয়ার যেন খুলে গেল তাঁর চোখের সামনে! নিশ্চিন্দিপুরের অপু-দুর্গার চুরি করে আচার খাওয়ার দৃশ্য দেখে মন্ট্রিয়লের রোবের্জের মনে হল, আচারের স্বাদ হয়তো তিনি পেলেন না, কিন্তু অপাপবিদ্ধ শৈশববেলার আনন্দভৈরবী তাঁকে যেন ম ম গন্ধে ভরিয়ে দিল!
কলকাতায় এলেন।
রায়-মুগ্ধতায় আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো তখন। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে রাখলেন, তাঁর কাজের সঙ্গে সম্যক ধারণা না নিয়ে কিছুতেই দেখা করা নয়।
ন’টা বছর পেরিয়ে মোলাকাত হল প্রিয় পরিচালকের সঙ্গে। আলাপ ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে গড়ালো। যা রয়ে গেল সত্যজিতের চিরবিদায় অবধি।
শেষাংশ পরের পর্বে
সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নিতে তাঁর বাড়িতে ফাদার
ছবিঃ সৌজন্যে rediff.com, filmforum, communication for development, diplollife-blogger
No comments:
Post a Comment