Sunday, August 30, 2020

জীবন যে রকম ১৮ -ভারত নিয়ে ফাদারের মধ্যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন তাঁর মামা ২য় পর্ব - কৌশিক দাশগুপ্ত



ভারত নিয়ে ফাদারের মধ্যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন তাঁর মামা  
২য় ও শেষ পর্ব

কৌশিক দাশগুপ্ত
শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে থিয়েটার আর্টস-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেলেন গাস্তঁ। কলকাতায় ফিরে গড়ে তুললেন তাঁর স্বপ্নের ইমারত, চলচ্চিত্রের এক আঁতুড়ঘর, তাঁর ‘চিত্রবাণী’। সত্যজিৎকে পেলেন পাশে। ১৯৭০-এ তাঁর হাতে গড়ে এই প্রতিষ্ঠানটিই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ফিল্ম ও মিডিয়া স্টাডি ইনস্টিটিউট। যার আদলেও সেই অদ্ভুতের সুর। ইভান ইলিচের 'ডিস্কুলিং সোসাইটি' বইটি তাঁকে এমন ভাবে প্রভাবিত করেছিল যে, তিনি এমন একটি ফিল্ম স্টুডিয়ো কল্পনা করেছিলেন, যেখানে শিক্ষক বা ছাত্র থাকবেন না। থাকবেন শুধু নিজ ক্ষেত্রে সক্রিয় চিত্র পরিচালকেরা এবং শিক্ষানবিশের দল। ২৬ বছর ধরে রোবের্জ ছিলেন চিত্রবাণী-র অধ্যক্ষ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ফিল্ম স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে পড়াতেন। ইউজিসি-র অডিয়ো ভিস্যুয়াল রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা-ডিরেক্টরও তিনি। পরে যা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধীনে ‘ইলেকট্রনিক মাল্টিমিডিয়া রিসার্চ সেন্টার’-এ পরিণত হয়ে যায়। ইউজিসির বহু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে এই চিত্রবাণী-র প্রযোজনায়। ভবিষ্যতের বহু চিত্র পরিচালকের পাঠশালা ছিল ফাদার গাস্তঁর এই মায়াকানন।
 
'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না'
গাস্তঁর একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল, পশ্চিমি সমালোচকদের চোখে তিনি কখনই ভারতীয় ছায়াছবিকে দেখেননি। তাঁর ‘চিত্রবাণী’ বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্র। দেখিয়েছেন, ভারতীয় নাট্য ঐতিহ্যয় কী ভাবে একেকটি ভাব বা রস গড়ে তোলার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। আখ্যান সেখানে এই রসসৃষ্টির একটি উপাদান মাত্র। দেখিয়েছেন, কখনও কখনও যখন আখ্যান আবেগকে তার কাঙ্খিত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারছে না, তখন প্রয়োজন সঙ্গীতের, নৃত্যের বা অন্য কোনও শিল্পকলার। ব্যাপারটি এই কারণেই বলা, পশ্চিমি নাট্য বা চলচ্চিত্রের ভাবনায় আখ্যানই তো কাহিনির গতি এবং আবেগের নিয়ন্ত্রক। বাহুল্যের কোনও জায়গা সেখানে নেই। তার উল্টো পথে ভারতীয় ঘরানাটি বুঝেছিলেন বলেই অপু-দুর্গার আচার খাওয়ার দৃশ্যটিতে তাদের উচ্ছ্বাস বোঝাতে আটটি ক্লোজআপের ব্যবহার কিছু পশ্চিমি পরিচালকের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলেও গাস্তঁ তাতেই মজে থাকেন। ভারতীয় ভাবধারায় ডুবে থাকা দর্শক, এমনকী সমালোচকের কাছেও সেই উচ্ছ্বাসটি যখন নির্ভুলভাবে প্রতিষ্ঠা পায়, তিনি ভাবনাটি ধরতে পারেন। বাঙালি জীবনের ছায়াটিকে মেলাতে পারেন। ঠিক এখান থেকেই ‘শোলে’র বা ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র সাফল্য তাঁকে ছুটিয়ে মারে। লক্ষ লক্ষ দর্শকের মাদকতাকে তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে না দিয়ে তাঁদের কাছাকাছি হয়ে অন্বেষণের নোটবুক খুলে বসেন।
 
'শোলে'
সিনেমা তাঁর কাছে কখনই এলিটদের বিনোদনের সংকীর্ণ একটি ক্ষেত্র নয়। বরং ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে তুলে তুলে তিনি বলেছেন, চলচ্চিত্রকে পৌঁছতে হবে সবার কাছে। এবং তাকে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হয়ে থাকলে চলবে না, হয়ে উঠতে হবে সামাজিক রাজনৈতিক শিক্ষার হাতিয়ার। একসময় সিনেমা দেখার অবশ্যম্ভাবী রূপটি ছিল একসঙ্গে অনেকে বসে স্বাদ নেওয়া। তাতে একটা আদানপ্রদানের বা ভাব-বিনিময়ের এক ধরনের সেতু থাকত। আজকের হাইটেক যুগ সেই সেতুতে ফাটল এনেছে। প্রান্তবেলায় এ কথাও তাঁকে ভাবিয়েছে। সিনেমা কী ভাবে আঞ্চলিকতার বীজ বুকে নিয়েও, তার স্বাতন্ত্রতা বজায় রেখেও ‘ইউনিভার্সাল’ হয়ে উঠতে পারে, এই আজকের আগ্রাসী দুনিয়াতেও, গাস্তঁর ভাবনার বিচরণ ছিল সেখানেও। গাস্তঁকে নিয়ে একটা মজার অধ্যায় দিয়ে নয় শেষ করি। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ তখন রাষ্ট্রপতি। সময়কাল ষাটের দশক। বাংলা ভাষার একটি কোর্স শেষ করলেন গাস্তঁ। সেই উপলক্ষেই সার্টিফিকেট হাতে তুলে দিতে একটি সভায় ডাকা হল তাঁকে। সেখানে যে মানপত্রটি দেওয়া হয়েছিল, তাতে ভুলক্রমে নামটি হয়ে গিয়েছিল ‘ফাদার গৌতম রোবের্জি’! ক্ষুণ্ণ হওয়া দূরে থাক, গাস্তঁ তাকেই প্রাণ ভরে মাথায় তুলে নিয়েছিলেন জীবনে প্রথমবার বাঙালি হওয়ার ‘তকমা’টি পেয়ে! এই হলেন ফাদার। ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ। ছবিঘর অন্তপ্রাণ, বলা ভাল তার একনিষ্ঠ এক পূজারি এই অগস্টে তাঁর অগস্ত্য-যাত্রায় চলে গেলেন! আর কোনও জাম্প, কাট, জাম্প, কাট নেই তাঁর। চিরদিনের জন্য প্যাক-আপ! বিদায় ফাদার! বিদায়!
 
 
চিত্রবাণী
শেষ
 
ছবিঃ সৌজন্যে Signis, InUyth.com 

No comments:

Post a Comment