এ দেশের এক নম্বর ভূতুড়ে রেলওয়ে স্টেশন
শিক্ষক, মুর্শিদাবাদ
ভূতুড়ে বাড়ি, ভূতুড়ে বনবাদাড়, কি ঝোপঝাড়, বা অফিস-কাছারি, ভূতুড়ে পুকুরঘাট, নদীর পাড়, এমনকী ভূতে-পাওয়া আস্ত একটা গাঁ, তা’ও শুনেছি।
গল্পেও পড়েছি।
কিন্তু একটা জমজমাট রেলওয়ে স্টেশন, তার বাজার প্রায় রাতারাতি ‘ভূতুড়ে’ হয়ে যাওয়ার আখ্যান এই আমার প্রথম শোনা। দিন কতক আগে।
এক-দু’টো বছর নয়। টানা চার চারটে দশক ধরে সেই স্টেশনের এমন পরিচিতি!
তা’ও কী, স্টেশনটি খোদ বাংলায়!!
শুনে যা ঝটকা খেয়েছিলাম, কী বলি!
বিশ্বাস, অবিশ্বাস, তক্ক-বিতক্ক— এ সব বাদ দিন। কাহিনির অমন মুখড়া শুনে বাঙালি-কান যে ‘পাগলা দাশু’র মতো খাড়া হয়ে উঠবে, এ বুঝতে কেজি ক্লাসের বিদ্যে লাগে না।
গল্পটা জমিয়ে দিল ঝমঝমে বর্ষার রাত। লোডশেডিং। ফিকে চাঁদের আলো। আশপাশের শিড়িঙ্গি-শিড়িঙ্গি গাছের মাথা, জানলা-কপাট দেওয়া চেনাবাড়ির পাঁশুটে না-দেখা শরীর, আর আমার দু’কামরার ফাঁকা বাড়ি।
বলনে-ওয়ালা মানুষটিরও তারিফ করতে হয়। কারণ পুরো অভিজ্ঞতাটি তিনি শোনালেন ফোনে-ফোনে।
আমাকে নড়ার সুযোগটি পর্যন্ত দিলেন না, ঠায় মিনিট কুড়ি।
ভদ্রলোক আমার মতোই বেড়ানো-পাগল। থাকেন কলকাতায়। নাম সঞ্জয় ভৌমিক। পেশায় সরকারি চাকুরে। তাঁর সঙ্গে ফেসবুকীয় আলাপ এখন ফোনাফুনিতে প্রমোশন পেয়েছে!
সে রাতেও তেমনই নিরামিষ বেড়ানোর গপ্পো হচ্ছিল ওঁর সঙ্গে। হঠাৎ আমার কাছে বৃষ্টি আর লোডশেডিং-এর যুগলবন্দির আলাপ শুনে ভদ্রলোককে ভূতে পেল! তাতেই অমন মুখড়া।
ছাট আসছে দেখে জানলা বন্ধ করতে উঠেছিলাম। কথায় কথায় এমনই জমিয়ে দিলেন সে-পর্বও গেলাম বেমালুম ভুলে!
এই ধরতাইটা দিলাম এ্ক্কেবারে আপনাদের সুবিধের জন্য। এরপর থেকে ফোনালাপে যা ঘটল, হুবহু বলে যাচ্ছি।
মাঝের দফা থেকে নয় শুরু করি। তারপর আবার শুরু থেকে বলব।
|
যদি ক্যামেরায় কিছু ধরা পড়ে সেই আশায়
|
সঞ্জয়বাবু বলতে লাগলেন, ‘‘বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ভাই। বিশ্বাস করুন, ভূত-টুত আমি মানি-টানি না। নিখাদ অ্যাডভেঞ্চারের লোভে, গিয়েছিলাম ওখানে। তারপর যে অমন সব ফিলিং হবে, কে জানত?’’
আমি চুপ। শুনে যাচ্ছি শুধু।
‘‘মানুষের ম দেখছি না চারপাশে। গোটা প্ল্যাটফর্মটা ধু ধু। মিশমিশে কালো জাঁকিয়ে বসেছে সন্ধে নামতে না নামতে। হাত দশেক দূরে কিছু ঠাওর করতে গেলে চোখের দম লাগে। হঠাৎ মনে হল, খুব আস্তে আস্তে কিন্তু বেশ তীক্ষ্ণ একটা পিনপিনে সুর আমার কানের কাছে জেগে উঠল। কেউ কিছু বলে উঠল যেন! কী বলল বুঝে পেলাম না। ফিশফিশানি ধরার আগেই শব্দগুলো মিলিয়ে গেল নিমেষে। তারপরই মনে হল, ঘাড়ে কারও শ্বাস পড়ল যেন!
কেন জানি না ঠিক এই সময়েই মুঠোয় ধরা টর্চটাও ঠিক কাজ করছে না। হয়তো উত্তেজনায়! হাতটা ঠক ঠক করে কাঁপছে। জবজবে ঘাম নামছে গোটা শরীর বেয়ে। তার সঙ্গে বরফ-শীতল একটা সাপ যেন শিরদাঁড়া দিয়ে গড়ান দিচ্ছে নীচের দিকে।’’
|
পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টার
|
ততক্ষণে আমার জানা হয়ে গিয়েছে সঞ্জয়বাবু গিয়েছিলেন মুরগুমায়। পুরুলিয়ার কাছেই। বেড়াতে। সেখানেই শোনেন, বেগুনকোদর স্টেশনের নাম। যেখানে নাকি দিনের বেলাতেও ‘ভূত’ বেরয়।
শুনেই যৌবনের রক্ত চনমনিয়ে উঠেছিল আর কী!
প্রায় মশকরা করার মেজাজেই তাই শেষ বিকেলে বেরিয়ে পড়া রিসর্ট থেকে। সওয়ার চার চাকার। সঙ্গী লোকাল ড্রাইভার কাম পথ-প্রদর্শক ‘নেপালদা’। বেগুনকোদরের নাম শুনেই যিনি অ্যাবাউট টার্ন দিচ্ছিলেন। স্থানীয় ট্যুরিস্টদের এ তল্লাট বা তার আশপাশ, লাগোয়া অযোধ্যা পাহাড় তিনিই ঘুরিয়ে দেন। কিন্তু বেগুনকোদর! কিছুতেই না।
প্রায় কাকুতিমিনতি করে রাজি করানো হল। তখন ওঁর শর্ত একটাই, গাড়ি থেকে তাঁকে যেন নামতে না বলা হয়!
সঞ্জয়বাবু বলতে লাগলেন, ‘‘সন্ধে সাতটা নাগাদ মুরগুমার রিসর্ট থেকে বেরলাম! রাস্তা অন্ধকার। হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে মসৃণ পিচের রাস্তা আর দু’পাশে ঝোপঝাড়। শাল-পলাশের বন। হেডলাইটের আলোর গুঁতোয় বাইরেটা যতটা আলোকিত, ভেতরটা ঠিক ততটাই অন্ধকার। তেনারা তো এসব জায়গাতেই থাকেন! তখন একটা মস্তি-মস্তি ভাব ভেতরে।’’
ফোনের ওপার থেকে হাসি ভেসে এল।
আমি স্পিক-টি-নট! গল্পে জমে গিয়েছে।
বলে চললেন উনি, ‘‘অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদটা ষোলো আনা চাগিয়ে দিয়েছিল রিসর্টেরই ছোকরা, বুঝলেন। লোকাল ছেলে। তার মুখেই শুনলাম, স্টেশনটা ফাঁকা পড়ে ছিল একটানা ৪২ বছর ধরে। ছোট্ট একটা স্টেশন। পুরুলিয়া জেলার কোটশিলায়। শহর থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে। অযোধ্যা পাহাড়ের গা ঘেঁষে। একটা সময় কিন্তু স্টেশনের এমন হতকুচ্ছিৎ অবস্থা ছিল না। বরং বেশ বড়সড় স্টেশন হিসেবে পুরুলিয়ায় যথেষ্ট নাম বেগুনকোদরের। এখানে থামত প্যাসেঞ্জার ট্রেন। ছিল স্টেশন-লাগোয়া কর্মচারীদের কোয়ার্টার। বাজার-হাটও। ছবিটা পুরো পাল্টে যায় একটা ঘটনার পর।’’
গলা খাঁকারি দিয়ে ফের বলা ধরলেন সঞ্জয়বাবু।
‘‘একদিন খুন হয়ে গেলেন স্টেশনমাস্টার এবং তাঁর স্ত্রী। পরে তাঁদের দেহ উদ্ধার হয় স্টেশনের পাশের বড় একটা কুয়ো থেকে। কেন খুন করা হয়েছিল তাঁদের? কারা করেছিল? - সে সব আজ আর জানা যায় না। কিন্তু তার পর থেকেই যত সব ভূতুড়ে কান্ড! এ সব ঘটনা শুনে শহর থেকে ছেলেপুলের দল ইদানীং অ্যাডভেঞ্চার করতে আসে। ও দিকে একটা বিজ্ঞান মঞ্চ দাবি করেছিল, ভূত দেখাতে পারলে নগদ ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেবে। খবরের কাগজে তার রিপোর্টও বেরিয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত ভিকট্রি স্ট্যান্ড-এ কাউকে উঠতেও দেখা যায়নি মশাই।’’
চাপা হাসলেন সঞ্জয়বাবু।
|
স্টেশন মাস্টারের ঘর
|
আমি নিজেকে সঞ্জয়বাবুর জায়গায় বসিয়ে দেখছিলাম, এ যদি আমিও শুনতাম, নির্ঘাৎ একই কান্ড করতাম। কোনও এক ‘নেপালদা’কে নিয়ে সান্ধ্য-অভিযান!
সঞ্জয়বাবু বলে চললেন, ‘‘সেই শুরু বুঝলেন! তারপর থেকেই ছবিটা আমূল বদলে যায়। নানা কাহিনি উড়তে থাকে বেগুনকোদরকে ঘিরে। রাত নামলে ওখানে নাকি হঠাৎ হঠাৎ দেখা যেতে থাকে অদ্ভুত সব আলো। বাতাসে ভাসে বিচিত্র গন্ধ। অশরীরী ডাক শোনা যায়। শুধু রাতের অন্ধকারে নয়, দিনেরবেলাতেও । ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত এক স্টেশনে পরিণত হল জমজমাট বেগুনকোদর। রেলকর্মীরা পালিয়ে বাঁচেন। বন্ধ হয়ে যায় স্টেশনে ট্রেন থামা। পোড়ো বাড়ির চেহারা নেয় বেগুনকোদর। এমনকী পরিচিতি পায় ভারতীয় রেলের এক নম্বর ভূতুড়ে স্টেশন হিসেবে।’’
সঞ্জয়বাবু বলছিলেন, ১৯৬৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এমনই দশা চলে। তারপর, ২০০৯ সালে ফের শুরু। বেগুনকোদরের সেকেন্ড ইনিংস। পুরনো স্টেশন বাড়িটাকেই রং করে খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ভূতুড়ে ছাপ্পা এখনও তার কাটেনি।
‘‘গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম । প্রথমে সিঁড়ি ভেঙে স্টেশনের উঁচু দাওয়ায়। কাউন্টার থেকে প্ল্যাটফর্ম টিকিট নিতে হবে। কোথায় কী! টিকিট কাউন্টার বন্ধ! রিসর্টের সেই ছোকরা বলেছিল, বিকেল ৫টা ৫০-এ রাঁচি-চন্দ্রপুরা-ধানবাদ প্যাসেঞ্জার এসে থামে ! ব্যস, সারাদিনে ওই একবারই! বাকিটা সময় এমন শুনশানই। রেলের কর্মী যা অল্পবিস্তর আছেন, দিনের আলো থাকতেই তাঁরা বিদায় নেন।’’
আমার এ দিকে বৃষ্টি ঘন হয়ে নেমেছে। গরাদ ছাপিয়ে জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে। তবু যেন পা চলছে না শুনতে শুনতে। বাইরে ছায়া ছায়া বাড়ির গায়ে কালো জমছে আরও।
সঞ্জয়বাবু মাঝে মাঝে থামছেন খানিক। আবার বলছেন।
‘‘অনেকক্ষণ হাঁকডাক করলাম ফাঁকা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে। কারও সাড়া পাওয়া গেল না। আর তখনই কী সব যেন কান্ড ঘটে গেল চারপাশে। অন্ধকারের একটা বলয় আমায় ঘিরে ধরল বুঝি! হাওয়ার গায়ে ফিশফিশ। কানের কাছে না-বোঝা শব্দের ঝাপটা। থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বোঝা-না বোঝার অগোচরে তখন। জবুথবু দশা। বন বন করে মাথাটা পাক দিতে লাগল। ওপর থেকে ঝপাস করে কী একটা খসে পড়ল! ফর ফর করে ডানা ঝাপটিয়ে পলকে পালালো সে। বাদুড় বুঝি! ঝিঁঝিঁর ডাক কানে ভাসছে। শরশরে হাওয়া। ঘর্মাক্ত শরীর। পিঠে হিলহিলে ঠান্ডা সরীসৃপ। ঠায় কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই।’’ |
স্টেশনের পাশেই পরিত্যক্ত আবাস
|
সঞ্জয়বাবু শেষ করলেন। গোটা স্টেশনের ছবিটা যেন তখন আমায় পাকিয়ে ধরেছে। গরাদে বৃষ্টির তোড়। জামা সপসপিয়ে উঠছে। নাম-কে-ওয়াস্তে কানে ফোনটা ধরে রেখেছি শুধু! একটা হুঁ-হ্যাঁও করিনি বহুক্ষণ।
ওপার থেকে ভেসে এল সঞ্জয়বাবুর গলা, ‘‘তো এই হল বেগুনকোদর! যাবেন নাকি একবার। চলুন যাই তবে দু’জনে।’’
ভদ্রলোকের গলা কেমন শরশরে হাওয়ার মতো শোনায়।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে জানলার পাশে।
গরাদটাকে হঠাৎ টিকিট-কাউন্টার মনে হল! বৃষ্টির ফোঁটার গায়ে ফিশফিশানি শব্দ। কথা ভাসছে কানে। আমি শুনছি, বুঝেও যেন বুঝছি না। শিউরে শিউরে উঠছি শুধু।
‘‘হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো… শুনছেন?… কী হল?… শুনতে পাচ্ছেন না…! গল্পটা কিন্তু শেষ… কিছু তো বলুন…’’
ঝমঝমে বৃষ্টির তোড়ে ঝুপ করে একটা কী খসে পড়ল!
ঘরের একমাত্র কুপিটা নিবে গেল।
ফোনটা ছিটকে পড়ল মাটিতে।
বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ঝাঁঝালো স্বরে ডেকে চলেছে জমাট অন্ধকারে।
|
বন্ধ টিকিট কাউন্টার
|
ছবিঃ সৌজন্যে |
সঞ্জয় ভৌমিক ভারত সরকারের অডিট এবং এ্যাকাউন্টস দপ্তরে সিনিয়র অডিট অফিসার হিসাবে কর্মরত |
দারুণ জমাটি লিখেছেন
ReplyDeleteঅনেকের অনেক চেষ্টায় স্টেশনটি দুর্নাম ঘুচিয়েছে। প্রান ফিরে পেয়েছে আবার। আর, সস্তা পাবলিসিটির জন্য আবারও কিছু লোক ভূতের গল্প ফাঁদছে। শিক্ষকরা সমাজকে বিজ্ঞান মনস্ক করে তোলে বলে জানি। এখানে দেখি উল্টো ব্যাপার। শিক্ষক নিজেই ভূতুরে গল্প ফেঁদে বসেছেন।
ReplyDelete