মা’কে দাহ করতে গিয়ে শ্মশানে তাঁকে কাঁদতে দেখেও আমরা হেসেছি ২য় পর্ব
দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
সাংবাদিক, কলকাতা
তখন ভানু ঢাকায়।
ইউনিভার্সিটির ছাত্র। বিএ পড়ছেন। অধ্যাপক বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র।
তাঁকে ভালবাসার দলে আরও তিন মহান মানুষ। ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার, কবি মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমুদ্দিন, কবি শহীদুল্লাহ।
এঁদের প্রিয় পাত্রটি এমনই কাণ্ড বাঁধিয়ে বসলেন যে, পালিয়েই আসতে হল পদ্মাপার থেকে।
তা’ও আবার কী করে?
না, বন্ধু গোপাল মিঞার গাড়িতে, সিটের নীচে, পাটাতনে লুকিয়ে।
১৯৪১।
এক ব্রিটিশ ইনফরমার খুন হল। অনুশীলন সমিতি-র লোকজনদের হাতে। সেই দলের পাণ্ডা ছিলেন নাকি উনিই। তাতেই হুলিয়া জারি।
তখন পালিয়ে আসা ছাড়া উপায় কী!
বিপ্লবীদের সঙ্গে ভানুর যোগাযোগটা কিন্তু এক-আধ দিনের নয়। সেই ইস্কুলবেলা থেকে। বয়স যখন আট-দশ। ‘গুরু’ মানতেন দীনেশ গুপ্তকে। তাঁরই সাইকেলে চেপে-চেপে ঘুরতেন। বুকের আড়ালে লোকানো নিষিদ্ধ বইপত্তর। টিফিন বক্সে রিভলভার। সব বিপ্লবীদের পাচারের জন্য।
পরে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’-এর অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহের সঙ্গেও ওঁর যোগাযোগ ছিল প্রবল। তিনি যখন জেলে, বাড়ি থেকে প্রায়ই তাঁর খাবার নিয়ে যেতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছোট থেকেই এমন রোখা স্বভাব, ট্যারা-ট্যারা হাবভাব, কট্টরপন্থী রকমসকম। কার থেকে পেয়েছিলেন এসব? রক্তে ছিল? বাবা জিতেন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতি দেবী, সরকারি শিক্ষা বিভাগের চাকুরে। সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া। এঁদের পুত্র সাম্যময়। ডাক নাম ভানু। ভানু-পুত্র গৌতমবাবু একবার বলছিলেন, ‘‘বাবার এই ডাকাবুকো স্বভাবটা বিশেষ করে ঠাকুমার কাছ থেকে পাওয়া।’’ কী রকম? ‘‘১৯০৫ সালের গল্প। ঠাকুমা ছিলেন বেঙ্গল বোর্ডের প্রথম ভারতীয় ইন্সপেক্ট্রেস অব স্কুলস’। যাচ্ছিলেন দার্জিলিং। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুল করে ইংরেজ লেডি-দের কামরায় উঠে পড়েন। মেমেরা সাত তাড়াতাড়ি নেমে যেতে বললে, ঠাকুমা বলেন, ‘পরের স্টেশনে নেমে যাব।’ তাতে ওদের একজন কোনও কথাটথা না শুনে ঠাকুমার বাক্স-প্যাঁটরা সব দিল বাইরে ফেলে। তাতে ঠাকুমা সেই মেমকে এমন ঠ্যাঙানি দেন যে, সে তো অজ্ঞান। এবার গার্ড এসে ঠাকুমাকে হাজতে ঢোকাবে। ঠাকুমার এক ভাই ছিলেন জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি এসে তখন সামাল দেন। মারা যাওয়ার দু’দিন আগেও বাবা এ ঘটনা বলত।’’
বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর যে এত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন, তার সূত্রপাতও কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এরকমই এক রোখা স্বভাবের কারণে।
কলেজে হস্টেলের ছেলেরা সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন করল যাঁদের, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন বসুও।
খুব ঘটা করে পুজো। এলাহি খাওয়াদাওয়া। তারই মাঝে কোনও এক বিকলাঙ্গ ভিখারি কাঁদো-কাঁদো হয়ে দু’মুঠো খেতে চাইতে এল।
তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিল একদল ছাত্র।
দূরে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করল কলেজ-ছাত্র সাম্যময়, ওরফে ভানু।ফূর্তি তুঙ্গে উঠল একটু পরেই। শুরু হল খাবারদাবার ছোঁড়াছুড়ি। এবার মাথায় রক্ত চড়ে গেল সাম্যময়ের।
সোজা রান্নাঘরে ঢুকে টান মেরে মেরে খাবার ফেলে দিতে লাগলেন তিনি, ‘‘আমিও খামু না, কাউরে খাইতেও দিমু না।’’
বাধা দিতে এল ক’জন। তাদের ক’টাকে বেধড়ক পিটিয়ে হটালেন। ঘটনার জল বহু দূর গড়ালো। সবাই এককাট্টা সাম্যময়ের বিরুদ্ধে।
পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক সত্যেন বসু। ছাত্র সাম্যময়ের আদর্শপ্রীতির প্রতি তাঁর স্নেহময় আবেশের শুরু সেই প্রথম।
সেই শুরু।
ছাত্রের গলায় ঢাকাই কুট্টিদের নকশা শুনেও তিনি তারিফ করতেন।
সে সময় বহু যাত্রা সম্মিলনী থেকে তাঁর ডাক আসত। তেমনই একবার নেমন্তন্ন করতে লোকজন এল। তাঁদের বলে দিলেন, ‘‘আরে, আমায় কেন, ভানুকে নিয়ে যাও।’’ তারা তো নাছোড়। শেষে রসগোল্লা-টোল্লা খাইয়ে বিদেয় দিয়ে বললেন, ‘‘আমার কাছে গোল্লা পেলে, ভানুর কাছে গেলে রসটা পাবে।’’
ভানুর এই ঢাকাই কুট্টিদের কমিকস-এর ভক্ত ছিলেন আবার মুজতবা আলীও। সে অবশ্য অনেক পরের ঘটনা।
বলব পরের পর্বে।
ছোট থেকেই এমন রোখা স্বভাব, ট্যারা-ট্যারা হাবভাব, কট্টরপন্থী রকমসকম। কার থেকে পেয়েছিলেন এসব? রক্তে ছিল? বাবা জিতেন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতি দেবী, সরকারি শিক্ষা বিভাগের চাকুরে। সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া। এঁদের পুত্র সাম্যময়। ডাক নাম ভানু। ভানু-পুত্র গৌতমবাবু একবার বলছিলেন, ‘‘বাবার এই ডাকাবুকো স্বভাবটা বিশেষ করে ঠাকুমার কাছ থেকে পাওয়া।’’ কী রকম? ‘‘১৯০৫ সালের গল্প। ঠাকুমা ছিলেন বেঙ্গল বোর্ডের প্রথম ভারতীয় ইন্সপেক্ট্রেস অব স্কুলস’। যাচ্ছিলেন দার্জিলিং। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুল করে ইংরেজ লেডি-দের কামরায় উঠে পড়েন। মেমেরা সাত তাড়াতাড়ি নেমে যেতে বললে, ঠাকুমা বলেন, ‘পরের স্টেশনে নেমে যাব।’ তাতে ওদের একজন কোনও কথাটথা না শুনে ঠাকুমার বাক্স-প্যাঁটরা সব দিল বাইরে ফেলে। তাতে ঠাকুমা সেই মেমকে এমন ঠ্যাঙানি দেন যে, সে তো অজ্ঞান। এবার গার্ড এসে ঠাকুমাকে হাজতে ঢোকাবে। ঠাকুমার এক ভাই ছিলেন জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি এসে তখন সামাল দেন। মারা যাওয়ার দু’দিন আগেও বাবা এ ঘটনা বলত।’’
বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর সঙ্গে সস্ত্রীক ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় |
এরপর ৩য় পর্বে
ছবিঃ সৌজন্যে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
মূল ছবির ডিজাইনঃ জয়দীপ সেন
বিপ্লবী অনন্ত সিংহ |
(যে কথা না বললেই নয়ঃ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা আমি আগে লিখেছি। তবু প্রতিবারই নতুন করে লিখতে গিয়ে মনে হয়, মানুষটিকে চেনা ঘটনার মধ্যেও অন্য ভাবে আবিষ্কার করছি। ২০১৯ সালের পুজোয় ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ একটি লেখা চায়। তখন যে লেখাটি লিখি তাকেই অল্প পরিমার্জন করে এখানে রাখছি, আমাদের ‘আর্কাইভ’ চিন্তাটির কথা মাথায় রেখে— লেখক)
No comments:
Post a Comment