মা’কে দাহ করতে গিয়ে শ্মশানে তাঁকে কাঁদতে দেখেও আমরা হেসেছি ৩য় পর্ব
দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
সাংবাদিক, কলকাতা
সাহিত্যিক মনোজ বসুর বাড়িতে প্রথম দেখা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলীসাহেবের। ভানু ওঁকে বললেন, ‘‘আপনার সাহিত্যের আমি খুব ভক্ত।’’
উত্তরে তাঁকে চমকে দিয়ে মুজতবা আলী গড়গড়িয়ে ‘ঢাকাই কুট্টি’ বলতে থাকলেন!
সে অবশ্য অন্য কথা।
ফেরা যাক, জেদী, জেহাদী, একরোখা মানুষটির আরও গল্পে।
কী ভালবাসতেন উত্তমকুমারকে! একেবারে ছোট ভাইয়ের মতো। উল্টো দিকে উত্তমকুমারও তাই। ডাকতেন ‘ভানুদা তুই’। ওঁদের ঘিরে নানারকম ভাল গল্পের শেষ নেই।
‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি করতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাঁরা অর্থের জোগান দেন, উত্তমকুমার তাঁদের একজন।
গৌতমবাবু আমায় বলেছিলেন, ‘‘ভ্রান্তিবিলাস ছবি করতে গিয়ে বাবাকে সোনার গিনি দিয়ে অ্যাডভান্স করেছিল উত্তমকাকু! উল্টো দিকে ‘ছোটিসি মুলাকাৎ’-এর পর উত্তমকাকুর যখন হার্ট অ্যাটাক হল, বাইরের কারও দেখা করা বারণ। বাবা ঠিক ম্যানেজ করে চলে গিয়েছিল। কেউ রুখতে পারেনি।’’
সেই সম্পর্কে ছিটে লাগল ওই জেদী-নাছোড় মনটার জন্যই।
সময়টা ষাটের শেষাশেষি। ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ভেঙে ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি হল। উত্তমকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়রা চলে গেলেন ও দিকে। এ দিকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রইলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমাররা। ‘কালো তালিকা’য় নাম পড়ল ওঁদের। এই সময়ই ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ রিলিজ করবে। তাতেও বাধা দেওয়া হতে পারে খবর পেয়ে একজোট হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার, অজিত লাহিড়ী, সৌমেন্দু রায়রা। বিজলী সিনেমা-য় গণ্ডগোল হতে পারে শুনে ঠায় আট ঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতেন ওঁরা। এই সময়েই প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয় ওঁর। গৌতমবাবু বলছিলেন, ‘‘উত্তমকাকুর সঙ্গে বিচ্ছেদ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বাবা। পরে অবশ্য সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।’’ কত ঘটনা! কত ঘটনা!
সুধীরলাল চক্রবর্তীর কথা বলি। প্রাণপ্রিয় শচীনকর্তা বম্বে চলে যাওয়ার পর সুধীরলালের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয় তাঁর। তখন সুধীরলালের খুব নাম। ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ বেরিয়ে গিয়েছে। উনি থাকতেন লেক মার্কেটের কাছে। পাড়ার ছেলেরা একবার চড়াও হয় ওঁর ওপর। তাদের শায়েস্তা করতে সবচেয়ে আগে যে মানুষটি এগিয়ে যান, তিনি ভানু বন্দ্যেপাধ্যায়।
দাদাগিরি, জুলুমবাজি, রোয়াব কোনওদিন তোয়াক্কা করেননি।
১৯৫২-৫৩ সালের কথা।
বামনেতা রাম চ্যাটার্জির তখন খুব দাপট।
চন্দননগর থেকে তিনি তাঁর ভগ্নিপতি আর জনা চার-পাঁচ স্যাঙাত নিয়ে চড়াও হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। কী ব্যাপার, না ফাংশনে যেতে হবে।
বললেন, ‘‘পারব না। কাজ আছে।’’ উত্তর এল, ‘‘যদি জোর করে নিয়ে যাই, আটকাতে পারবে?’’
গাড়ি-বারান্দার কার্নিশে কয়েকটা মার্বেলের টব ছিল, সেটা দেখিয়ে উনি জবাব দিলেন, ‘‘তোমার মাথায় কি মাসল আছে, দেখি। ওগুলো মাথায় যদি মারি, কী করবে?’’
তুলসী চক্রবর্তীর গল্পটা যেমন। হাতিবাগান পাড়া। গাড়ি নিয়ে স্টার-এ ‘পরিণীতা’র শো করতে যাচ্ছেন ভানু বন্দ্যেপাধ্যায়। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখলেন, একদল চ্যাংড়া ছোঁড়া তুলসী চক্রবর্তীর ধুতি, জামা ধরে টান মারছে। মাথায় চাঁটিও। সোজা গাড়ির দরজা খুলে নেমে গিয়ে এক-একটাকে চড়-থাপ্পড়, কিল, ঘুঁষি। মার খেয়ে নিমেষে পিঠটান দিল চ্যাংড়ার দল!
অপমান দেখলে সইতেন না। অবজ্ঞা দেখলে রুখে দাঁড়াতেন। আপস করার হাজার হাজার মাইল দূর দিয়ে হাঁটতেন।
এমনও সময় গিয়েছে, হাতে কোনও কাজ নেই। একটু ঝুঁকলেই কিছু একটা জুটে যায়। কিন্তু মাথা নোওয়াতে তিনি যে নারাজ!
যাত্রা দল করলেন। সে সব দিনের কথা বলেছিলেন নীলিমা দেবী, ‘‘যে মানুষ নরম বিছানা ছাড়া শুতেন না, তিনিই কিনা গ্রামেগঞ্জে গিয়ে শতরঞ্চি পেতে গাছের তলায় ঘুমোতেন। দিনের পর দিন ফুলুরি, মুড়ি, জিলিপি খেয়ে কাটিয়েছেন। একবার একটা আধভাঙা বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বুকের ওপর সিলিং-এর চাঙড় খসে পড়ল। তাতেও পরোয়া নেই।’’
এই এত কিছু সহ্য করার মাঝে যখন বম্বে যাওয়ার অফার আসত, ফিরিয়ে দিতেন। বারবার। কলকাতা তিনি ছাড়বেন না। কোনওক্রমে বন্ধু-পরিচালক সত্যেন বসুর ‘বন্দিস’ বা দুলাল গুহর ‘এক গাঁও কী কাহানি’ করেছেন। বাকি সব ফিরিয়েছেন।
কার না কার অফার ছেড়েছেন!
গুরু দত্ত, বিমল রায়, শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তী...!
ওদিকে ওঁর প্রতি আরব-পারে শ্রদ্ধা-প্রশংসার রকম শুনবেন?
‘পাশের বাড়ি’র রিলিজের ষোলো বছর বাদে হিন্দি ভার্সান ‘পডোসন’ হল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোলটা করলেন মেহমুদ। তখন বম্বে-তে একটা ফাংশানে গিয়েছেন ভানু। শোনামাত্র রাহুলদেব বর্মনকে নিয়ে তাঁর হোটেলে চলে আসেন মেহমুদ। পরামর্শ নিতে।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কেষ্ট মুখোপাধ্যায়। তার অনেক পরে ‘সাগিনা মাহাতো’-র শ্যুটিং, তখন বম্বেতে। দেখা হতে জাপটে ধরে তখনই বলেছিলেন, ‘‘দাদা, কী করেছেন ওফ! ওটাই আপনার বেস্ট।’’
তবু তাঁকে নড়ানো যায়নি। হেলানো যায়নি। আপসও না।
জীবনকে কী চোখে দেখলে এমন সিধে থাকা যায়!
নিজের ওপর কতটা বিশ্বাস থাকলে, এমন একবগ্গা লড়াই লড়া যায়।
ভাবনার প্রতি কতটা সৎ হলে, এতটা সাহস দেখানো সম্ভব!
সেই মানুষকে কেমন আজও ‘রসিকতা’ আর ‘কমিক’-এর বাক্সে বন্দী রাখল বাঙালি!
একটা সময় সিরিয়াস ‘রোল’ করার জন্য ছটফট করতেন ভানু বন্দ্যেপাধ্যায়। কিছুতেই পেতেন না।
এক্কেবারে শেষ দিকে এসে পেলেন ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’।
যাঁরা সে-ছবি দেখেছেন, তাঁরাই বুঝেছেন, অন্য ধারায় কী ভাবে নিজের জাত চিনিয়েছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
আড্ডায় বসে প্রায়ই একটা কথা বলতেন, ‘‘আমার দশা ক্যামনে শুনেন। মা মারা গ্যাছে। শ্মশানে গেছি। চোখে জল। একটা লোক কাছে আইয়া কইল, ‘আরে ভানুদা কী হইসে?’ কোনওক্রমে কইলাম, মা মারা গ্যাছে। শুইন্যা হাসতে হাসতে চইল্যা গ্যালো। যাইতে যাইতে কইল, ‘দ্যাখ, ভানুরে কাঁদলে কেমন লাগে!’ বুঝেন একবার, হালা, নিজে যখন শ্মশান যামু, লোকে দেইখ্যা বলবে, ওই দ্যাখ, ভানুর মাথাটা কেমন নড়তাসে!’’
ঠাট্টা করতেন। ঠাট্টা! আর বলতেন, বারবার বলতেন, ‘‘ছিলাম বাঁড়ুজ্জে, হলাম ভাঁড়ুজ্জে। কী আর হইব!’’
কত কষ্ট যে চাপা ছিল এই ‘ঠাট্টা’র আড়ালে!
বুঝি’বা দমচাপা দলা দলা অনেক কান্না! কে তার খবর রাখল!!
সময়টা ষাটের শেষাশেষি। ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ভেঙে ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি হল। উত্তমকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়রা চলে গেলেন ও দিকে। এ দিকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রইলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমাররা। ‘কালো তালিকা’য় নাম পড়ল ওঁদের। এই সময়ই ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ রিলিজ করবে। তাতেও বাধা দেওয়া হতে পারে খবর পেয়ে একজোট হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার, অজিত লাহিড়ী, সৌমেন্দু রায়রা। বিজলী সিনেমা-য় গণ্ডগোল হতে পারে শুনে ঠায় আট ঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতেন ওঁরা। এই সময়েই প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয় ওঁর। গৌতমবাবু বলছিলেন, ‘‘উত্তমকাকুর সঙ্গে বিচ্ছেদ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বাবা। পরে অবশ্য সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।’’ কত ঘটনা! কত ঘটনা!
মুজতবা আলী ভালবাসতেন তাঁর 'ঢাকাই কুট্টি' |
তুলসী চক্রবর্তীর সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় |
'বসুশ্রী'র আড্ডায় উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মাঝে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় |
শেষ
ছবিঃ সৌজন্যে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার
মূল ছবির ডিজাইনঃ জয়দীপ সেন
(যে কথা না বললেই নয়ঃ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা আমি আগে লিখেছি। তবু প্রতিবারই নতুন করে লিখতে গিয়ে মনে হয়, মানুষটিকে চেনা ঘটনার মধ্যেও অন্য ভাবে আবিষ্কার করছি। ২০১৯ সালের পুজোয় ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ একটি লেখা চায়। তখন যে লেখাটি লিখি তাকেই অল্প পরিমার্জন করে এখানে রাখছি, আমাদের ‘আর্কাইভ’ চিন্তাটির কথা মাথায় রেখে— লেখক)
অসাধারন
ReplyDeleteThank you so much
Deleteখুব ভালো দেবশঙ্কর দা, এইরকম কাজের আশায় বসে থাকি মুখিয়ে কখন আপনি আপলোড করবেন। একটা অনুরোধ যদি তুলসী চক্রবর্তী ও কেষ্ট মুখার্জি কে নিয়ে কিছু একটা করা যায়, এই লেখা গুলো পড়তে পড়তে ভিষণভাবে মনে হচ্ছিলো তাই আবদার করে ফেললাম। চালিয়ে যান স্যার আমরা আছি পাশে...বাংলা দেখুক নীরবে কত কঠিন কাজ মানুষের কাছে কতটা সহজে তুলে ধরা যায়....স্যালুট স্যার।
ReplyDeleteভালো থাকবেন
সুস্থ থাকবেন
Tomar kothay mathay rakhlam... Khub chesta korchhi go... dyakha jak
Delete