জন্মভূমি আর প্রেমিকের ছবি বুকে সায়ানাইডে কামড় প্রীতিলতার
সুশোভন মুখোপাধ্যায়
শিক্ষক, সাহিত্যিক
কতটুকুই বা জীবন! মাত্র একুশ বছর।
কেউ ভাবতেই পারেনি শিশুবেলার শান্তশিষ্ট সেই মেয়ের বুকে জমেছিল কত আগুন!
দিনটা সেপ্টেম্বরের ২৩। ১৯৩২।
দেশকে ভালবেসে শত্রুর হাতে সমর্পণ নয়, বরং মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন তিনি!
তিনি প্রীতিলতা। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
আদরের নাম, রানী।
ছোটবেলা থেকেই অন্যদের থেকে আলাদা সে। ইস্কুলের দিদিমণি ঊষাদি যখন ঝাঁসির লক্ষ্মীবাঈয়ের গল্প বলতেন, রানী ভাবত, সে’ও একদিন এমনি করেই লড়াই করবে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। সামনাসামনি।
সময়টা একশো বছরেরও আগের।
ভারতের মাটিতে শাসক তখন ব্রিটিশরা।
তেমনই সময় প্রীতিলতা সত্যি সত্যিই অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিদেশি শাসকদের উপর।
আসব তার পরিণামের গল্পে। তার আগে বলে নিই, কে এই প্রীতিলতা! কেমনই বা ছিল তার বেড়ে ওঠা?
ওঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন দাশগুপ্ত। পরে তাঁরা ওয়াদ্দেদার উপাধি পান। ঊর্দু ভাষায় ওয়াদ্দেদারের অর্থ উ্চ পদস্থ কর্মচারী।
বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার। চট্টগ্রামের ধলঘাটের বাসিন্দা। চট্টগ্রামেরই পৌরসভার ছাপোষা কেরানি তিনি। মা প্রতিভাময়ী ঘরণী। সারাদিন হেঁশেল ঠেলেই দিন যায় তাঁর। তার উপর ছয় ছেলেমেয়ে। তাদের দেখভাল করা আছে। প্রীতিলতা তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান। সে মেয়ের জন্ম ইংরেজির ১৯১১ সাল। মে মাসের ৫ তারিখ।
ইচ্ছা করলেই আর পাঁচটা মেয়ের মতোই দিন কাটাতে পারতেন তিনি।
পড়াশোনায় মেধাবী। ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারিণী। তারপর কলকাতার বেথুন কলেজ। ফিলজফিতে অনার্স। ডিসটিংশন পান তাতে। কলেজ শেষে চট্টগ্রামে ফিরে একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার চাকরিও জুটে যায় তাঁর।
তারপর আর কী! ‘সুখী সংসারী’ হতে বাধা ছিল কই!
কিন্তু প্রীতিলতা তো সে পথে চলার তরুণী নন।
তাঁর রক্তে দেশমায়ের শেকল ছেঁড়ার ডাক! তার ঝনঝনানি তিনি অস্বীকার করেন কী করে!
ঢাকায় থাকতে থাকতেই যোগ দিয়েছিলেন নানা রকম সামাজিক কাজকর্মে।
কলকাতায় এসে নদী যেন ভরা কোটালের স্বাদ পেল! দেখা হল বহু বিপ্লবীর সঙ্গে। তাতে রক্ত আরও ফুটন্ত, আরও টগবগে। ব্রিটিশ শাসকরা খোঁজ জানত তাঁর। তাঁর গতিবিধি তাদের প্রায় নখদর্পণে। ফলে কলেজ শেষে ‘দেশপ্রেম-এর শাস্তি’ জুটল প্রীতিলতার। বিএ পাশের সার্টিফিকেট আটকে রাখা হল তাঁর।
মরণোত্তর সার্টিফিকেট তিনি ‘পেলেন’, তবে তা কিন্তু ব্রিটিশ-বিদায়ের প্রায় পঁয়ষট্টি বছর পর। ২০১২-য়।
ফিরে যাই সে কালের কথায়।
যে বয়সে সে কালে, ‘বিয়ে’ নামক প্রতিষ্ঠানের ‘চাঁদমারি’-তে গেঁথে যেত বাড়ির কিশোরীরা, প্রীতিলতার তখন থেকেই অন্য পথে হাঁটার শুরু।
চট্টগ্রাম সশস্ত্র বিপ্লবীদের অন্যতম ঘাঁটি। বাংলার বাঘা বাঘা বিপ্লবীদের আনাগোনা সেখানে। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, নির্মল সেন, আরও আরও কত! শাসকের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন তাঁরা। প্রীতিলতাও নিজেকে জুড়ে দিলেন তাঁদের সঙ্গে।
প্রথম দিকে ছিলেন পিছনের সারিতে। কিন্তু তাতে তাঁর সইবে কেন! তিনি যে সামনের সারিতে থেকে নাছোড় লড়াইয়ে জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে চান। রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো!
তর্ক জুড়লেন নেতাদের সঙ্গে! কেন মেয়েদের সুযোগ দেওয়া হবে না! ছেলেরাই শুধু কেন যুদ্ধে যাবে, এ আবার কেমন কথা? গোটা বাংলার বিপ্লবী নারীদের হয়ে দাবি তুললেন তিনি, আমরাও যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চাই। অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে নামতে চাই পুরুষের সঙ্গে। সমানে সমানে।
তাঁর কঠোর জেদের কাছে হার মানলেন মাস্টারদা সূর্য সেন-এর মতো নেতারাও।
তাতেই যেন যুদ্ধ জয়ের অর্ধেক স্বাদ প্রীতিলতার।
তারপর? তারপর আর কী! পিছন ফিরে তাকানো নেই।
মাস্টারদার সঙ্গে একের পর এক অ্যাকশনে অংশ নেওয়া। পর পর তুলনাহীন সাহসিকতার নজির তুলে ধরা।
যত দিন যেতে লাগল প্রীতিলতার বীরত্বে সব্বাই মুগ্ধ।
এবার মাস্টারদা ঠিক করলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলি ইউরোপীয়ান ক্লাবে হামলা হবে।
বলে নেওয়া ভাল, ক্লাবটি ছিল অত্যাচারী ব্রিটিশদের ফূর্তিফার্তার সদরখানা! যেখানে নোটিশ ঝোলানো থাকত, ‘কুকুর ও ইন্ডিয়ানদের প্রবেশ নিষেধ’। বিপ্লবীদের লক্ষ নখড়ামির মস্তিপনায় ‘কামানদাগা’।
কিন্তু অ্যাকশন তো হবে, নেতৃত্ব দেবে কে? এগিয়ে এলেন প্রীতিলতা। মাস্টারদা রাজি।
দিন ঠিক হয়ে গেল সেপ্টেম্বরের ২৩। সময় রাত ১০ টা ৪৫।
গৃহস্তরা যখন রাতের খাওয়া সেরে শোওয়ার আয়োজনে, প্রীতিলতা তখন বেয়াদপের মজলিশে হামলা করতে প্রস্তুত। পরনে পাঞ্জাবি তরুণের ছদ্মবেশ। এক হাতে অস্ত্র। অন্য হাতে পটাসিয়াম সায়ানাইড। সঙ্গে আরও আটজন নির্ভীক সৈনিক।
আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় ক্লাবের পাহারাদাররা হকচকিয়ে গেল। তারপর পাল্টা গুলি চালালো তারাও। ব্রিটিশ পক্ষে হতাহত হল ক’জন। এ দিকে গুলি বিদ্ধ হয়ে গেলেন প্রীতিলতা। মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি।
তাঁকে হায়েনার মতো ঘিরে ধরল পুলিশ বাহিনী।
বিপদ বুঝে, দলের বাকিদের নেত্রী প্রীতিলতা নির্দেশ দিলেন ‘‘পিছু হঠো।’’
তারপর নিজে, গ্রেপ্তার এড়াতে মুখে পুরে দিলেন পটাশিয়াম সায়ানাইড।
পর দিন, ধলঘাটের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তাঁদের ঘরের মেয়েটির সেই কীর্তির কথা শুনে!
প্রীতিলতার শরীর তন্ন তন্ন করে তল্লাসি চালিয়ে পাওয়া গিয়েছিল কিছু বুলেট। ক’টা কাগজপত্র। আর রামকৃষ্ণ বিশ্বাস নামের এক যুবকের ছবি।
কে এই যুবক?
যুবক রামকৃষ্ণ ছিলেন চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র। ব্রিটিশ শাসকেরা আলিপুর জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল তাঁকে।
তার আগে বলি। সুদূর চট্টগ্রাম থেকে বিশ্বাস-পরিবারের লোকেরা নিয়মিত আসতে পারত না। কেন? তাঁদের সঙ্গতি নেই। সেই দায় কাঁধে তুলে নেয় প্রীতিলতা। তিনি তখন কলকাতায়। বহুবার রামকৃষ্ণের বোন সেজে আলিপুর জেলে যেতেন তিনি। পুলিশি রেকর্ড বলছে, এক-দু’বার নয়, গিয়েছিলেন চল্লিশ বার।
শোনা যায়, এই দেখা হওয়ার মধ্য দিয়েই দু’জনের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে!
জীবন কী অদ্ভুত, না?
ভালবাসায় বন্দি এই যুগলের একজনের প্রাণ গেল ফাঁসির দড়িতে! অন্যজন দেশের জন্য আত্মাহুতি দিলেন স্বেচ্ছায়! ভালবাসায়। পরিণতিহীন এই প্রেমকে প্রীতিলতা হয়তো আমৃত্যু বহন করেছিলেন। তাই প্রেমিক রামকৃষ্ণর ছবি তিনি কাছছাড়া করেননি শহীদ হওয়ার সময়ও!
বুকের খাঁচায় প্রাণের দেশ আর ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দেওয়া প্রেমিককে নিয়ে সায়ানাইডে কামড় দিয়েছিলেন প্রীতিলতা। একুশ বছরের যোদ্ধা, ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রথম নারী-শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার!
এই ক্লাবেই ফূর্তির মজলিশে 'কামান' দাগে প্রীতিলতার দল |
এই সেই স্নাতক হওয়ার সংশাপত্র |
এ মূর্তি বাংলাদেশে |
এখানে শহীদ হন প্রীতিলতা |
ছবিঃ সৌজন্যে wikiwand
ওপরের এই লেখাটি প্রকাশিত হয় ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০। তারপর থেকে পাঠকদের একটা বড় অংশ নথি দিয়ে জানাতে শুরু করে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের শহীদ দিবসটি ২৩ তারিখ নয়। ২৪ তারিখ। তা নিয়ে খোঁজখবর শুরু করি আমরা। তাতে যা পাই, তা ব্যাখ্যা সহকারে লিখলাম এই ব্লগেই অন্য লেখায়। তার লিংক- https://alternativebengalchapter.blogspot.com/2020/09/blog-post_24.html
-সম্পাদক
বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস |
Darun lekha... Kaku... Valo ekti history jana holo....
ReplyDeleteআপনাদের প্রতিবেদনে দুটি তথ্য নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্
ReplyDeleteপ্রথম টি প্রীতিলতার সাথে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সম্পর্ক নিয়ে।
নিশ্চিতভাবে না জেনে এই মন্তব্য সঙ্গত নয় । মনে রাখতে হবে চট্টগ্রাম থাকাকালীন কখনো এদের দুজনের সাক্ষাৎ হয়নি। ফাঁসির আর দিন পর্যন্ত প্রীতিলতা রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত ও বিপ্লবী কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সত্যি। কিন্তু তার চেয়ে বেশী কিছু র প্রমাণ কোথাও নেই।
দ্বিতীয়ত, পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্যে কল্পনা দত্তের নাম নেত্রী হিসেবে ঠিক হয়েছিল। কল্পনা হঠাৎ গ্রেফতার হয়ে যাবার কারণে প্রীতিলতাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়।