Thursday, September 24, 2020

জীবন যে রকম ২৪ - ২৪ সেপ্টেম্বর নাকি ২৩ প্রীতিলতার শহীদ দিবস নিয়ে বিতর্ক ও আমাদের উত্তর - দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়



২৪ সেপ্টেম্বর নাকি ২৩ প্রীতিলতার শহীদ দিবস নিয়ে বিতর্ক ও আমাদের উত্তর

দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
সাংবাদিক, সম্পাদক (এবিসি)
২৪ কিছুতেই নয়। অন্তত ২৩ সেপ্টেম্বর। নয়তো তারও আগে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ‘শেষ লড়াই অভিযান’ বা ‘শহীদ দিবস’ নিয়ে তুমুল বিতর্কের পর এই একটা অনুমানে অন্তত আসা গেল। ‘অ্যাকশন ডে’ কিছুতেই ২৪ সেপ্টেম্বরের রাত হতে পারে না। অন্তত ২৩ তারিখ। শহীদ দিবস ইংরেজি মতে গেলে (মানে রাত ১২টা পেরিয়ে গেলেই তারিখ বদলায়) তা’ও ২৪ হলেও হতে পারে, বাংলা মতে অন্তত ২৩। কিংবা তার আগে। কেন বলছি, বিস্তারিত করছি এই লেখায়। তার আগে স্বীকার করি, এ নিয়ে যে বড় আকারের একটা সংশয় কাজ করে, সত্যি বলছি, তার কোনও ধারণাই ছিল না। জানতে পারলাম ব্লগ-এ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে নিয়ে আমাদের প্রতিবেদক সুশোভন মুখোপাধ্যায়ের লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পরে। যার শিরোনাম, ‘জন্মভূমি আর প্রেমিকের ছবি বুকে সায়ানাইডে কামড় প্রীতিলতার’। সে লেখার বিষয় ছিল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবন, তাঁর বেড়ে ওঠা। ১৯৩২ সালে অত্যাচারী শাসক ব্রিটিশদের নষ্টামির আড়তখানা ‘ইউরোপীয়ান ক্লাব’-এ হানা দেওয়ার বিবরণ। সংঘর্ষ। এবং শেষমেশ ‘শহীদ’ হওয়া প্রীতিলতাকে নিয়ে একটি মর্মভেদী কাহিনি।
কল্পনা দত্ত-এর বইয়ের প্রচ্ছদ
যেখানে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের শহীদ দিবস হিসেবে যে তারিখটি উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি হল সেপ্টেম্বরের ২৩! আমাদের সংগৃহীত নথি তাই-ই বলছে। লেখাটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সম্পাদকীয় বিভাগের বিভিন্ন সদস্য নানান পাঠকের কাছ থেকে ফোন বা হোয়াট্স অ্যাপ পেতে শুরু করেন। সেই সব ফোন বা হোয়াট্স অ্যাপ-এর জোরালো বক্তব্য ২৩ নয়, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ‘শহীদ দিবস’-এর তারিখটি হবে ২৪। প্রত্যেক পাঠকের মতামতই আমরা সম্মানের সঙ্গে নজরে রাখি ও বিবেচনা করি। ধৈর্য সহকারে শুনি। সেই অনুযায়ী পরের ধাপটিও তৈরি করি। তার ওপর এক্ষেত্রে অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুতর। এরমধ্যে আমাদের দপ্তরে জমা পড়েছে নানান নথির ফোটো কপি এবং লিংক! তার মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি যেমন— ১। বিপ্লবী কল্পনা দত্তের লেখা ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতি কথা’ ২। মুক্তির সংগ্রামে ভারত —আলেখ্য গ্রন্থ (তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ, প্রথম প্রকাশ ২৮ অক্টোবর, ১৯৮৬) ৩। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘ভোরের কাগজ’-এর ওয়েব ভার্সানে ২০১৯-এর ৩ মে –র একটি প্রতিবেদন, ‘সহপাঠী ও বিপ্লবী জীবনের সহযোদ্ধাদের স্মৃতিকথায় প্রীতিলতা’
কল্পনা দত্তের লেখায় অভিযানের তারিখ সেপ্টেম্বরের ২৪
প্রত্যেকটিই যথেষ্ট ওজনদার নথি। ফলে ততক্ষণে চক্কর লেগে গিয়েছে আমাদের সম্পাদকীয় দপ্তরে। সঙ্গে বিতর্কও। না, ব্যাপারটি এমন নয় যে, ২৩ না হয়ে ‘অ্যাকশন’ ২৪ হলে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বিপুল আত্মত্যাগ বা লড়াকু মনের তিলমাত্র এদিক ওদিক হয়, কিন্তু ‘অলটারনেটিভ বেঙ্গল চ্যাপ্টার’ যে একটি আর্কাইভ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়। সেখানে এ ভাবে পাঠক নিজের থেকে উদ্যোগী হয়ে দিনক্ষণ, নথি শুধরে দিতে চাইলে, চোখ বুজে থাকাটা তো ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’। ফলে বিতর্ক জারি থাকল। সঙ্গে নাড়াঘাঁটাও। এর মাঝেই ফোন করে ফেললাম ঢাকায় আমাদেরই বন্ধু, তথ্যচিত্র নির্মাতা প্রিয়াঙ্কা আচার্য্যকে। প্রিয়াঙ্কা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাধর্মী কাজ করতে ভালবাসে। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত 'ইয়াং ফিল্ম টেলেন্ট-২০১৯'-এ 'স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের নিয়ে কাজ করা সাংস্কৃতিক সংগঠন 'সূর্য সেন সঙ্ঘ'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নিয়ে ওর-ও কাজ করতে যাওয়া আমার অজানা নয়। সবটা জানিয়ে ওকে ‘টেক্সট’ করলাম। একটা জবাব এল, যা সংক্ষেপ করলে এমন দাঁড়ায়— ‘‘এরকম সংশয় আছে। কেউ বলেন, ২৪। কেউ ২৩। কারণ শহীদের নিষ্প্রাণ দেহটি পাওয়া যায় রাত ১২টার পর। এই সংশয় দূর করা সহজ নয়। একটা ধারণা করা যেতে পারে মাত্র। শুধু কল্পনা দত্ত নন, বিপ্লবী গণেশ ঘোষও ২৪ তারিখের পক্ষে রায় দিয়েছেন। যদিও বর্তমান গবেষকরা ২৩ তারিখটিকেই ‘শহীদ দিবস’ বলতে চান।’’
'মুক্তির সংগ্রামে ভারত' বইটিতেও সেই একই তারিখ
রাত ১২টার পর মরদেহ পাওয়ার দরুণ এই সংশয়, এই চিন্তাটি আমার মাথাতেও ছিল। টেক্সট এক্সচেঞ্জ করার সময় দু’জনে প্রায় একই সঙ্গে, এই কথাটা বলি। ফলে ওর সঙ্গে এই ব্যাপারে খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়ায়, তখনকার জন্য মনে হল, হয়তো সেই কারণেই এই বিতর্ক। তবু অস্বস্তি যেন পিছু ছাড়ছে না। মনে হচ্ছে, ওয়েদ্দেদার-পরিবার কী বলেন, সেটি জানা দরকার। ফলে দুপুর নাগাদ সেখানেও ফোন। শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যাঁর বড় পিসি, সেই রুমা দেবীকে। রুমা দেবী বলে দিলেন, তাঁরা কিন্তু ২৪ তারিখটিকেই ধরেন। তাঁর যুক্তি কী? ফোনে সংবাদ সংস্থা এপি-র একটি নিউজ ক্লিপিং উনি গড়গড়িয়ে পড়ে যেতে লাগলেন। যেটি খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখ। ওঁরা সেটি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে নিয়ে প্রকাশিত একটি বইতে ছেপেওছেন। সেটি নির্দেশ করে উনি বললেন, ‘‘যেহেতু ২৫ তারিখ খবরের কাগজ বলছে, গতকাল রাতের ঘটনা। তবে নিশ্চয়ই করে তারিখটা ২৪। ২৩ নয়।’’ ২৫ তারিখ যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু তার মানেই কি ২৪ তারিখ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ‘শহীদ দিবস’? এইখানেই আমার সাংবাদিকী মনে কিছু কিছু প্রশ্ন খোঁচাতে শুরু হল। কেন? বলে যাচ্ছি একে একে। ১। সময়কালটা খেয়াল করুন। ১৯৩২। ২। ইউরোপীয়ান ক্লাব ‘অ্যাকশন’-এ ক’টায় বেরিয়েছিলেন ওঁরা? এ নিয়ে দু’টো মত আপাতত পেয়েছি। ক. রাত ৯টায়, খ. রাত ১০টা ৪৫। তারও আগে হতেই পারে। কিন্তু সন্ধের পর নিশ্চিত। কেননা, ওটি যদ্দুর খবর পেয়েছি, ইংরেজদের নৈশভোজ-এর হুল্লাট ছিল। এবার যদি ২৪ তারিখটিকেই ‘অ্যাকশন ডে’ হিসেবে ধরে নিই এবং তা ২৫ তারিখ খবরের কাগজে প্রকাশের যৌক্তিকতা বিচার করি, কী পাই— ১। ২৪ তারিখ ঘটনাটি ঘটল সন্ধেবেলা। ২। এপি (বা অন্য কোনও সংস্থা বা কোনও সাংবাদিক বা কোনও ‘সোর্স’, যার খবর এখনও আমরা জানতে পারিনি) ওই সন্ধেতেই দ্রুত পাঠিয়ে দিল খবরের কাগজে। ৩। কাগজ সেটি কম্পোজ করল, তারপরের ধাপে প্রিন্টিং-এর জন্য যা যা করতে হয় করল। এবং তারপর ছাপল। ৪। ২৫ তারিখ সেটি কাগজে বেরল।
শৈলেশ দে'র লেখা 'আমি সুভাষ বলছি' বইটিতে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সালের আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন
আমার ২৬ বছরের সাংবাদিক জীবনের ন্যূনতম যা অভিজ্ঞতা, তাতে এই ব্যাপারটি মেনে নেওয়া একটু কষ্টকর হচ্ছে। কেন? বলি। ১৯৩২ সালে কোনও খবরের কাগজ সন্ধেবেলা খবর পেয়ে পরের দিন ধরিয়ে দিচ্ছে, এই ব্যাপারটি বেশ কষ্টকল্পিত। মধ্য নব্বই-এ আমি যখন সাংবাদিক হচ্ছি, তখনই সন্ধের খবর পরদিন ধরানোতে কতটা ঝামেলার ছিল, তার কিছুটা অন্তত জানি। তখন যে ভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর আসত, তার যে পরিকাঠামো ছিল, তাকে প্রিন্ট-এ নিয়ে যাওয়ার যে পদ্ধতি ছিল এবং তা যতটা সময়সাধ্য ব্যাপার, তার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ১৯৩২-এ এ জিনিস কল্পনা করাও বেশ মুশকিল। এ যুক্তি, এ অনুমান আমি আমার টিম-এবিসি’র কাছে রেখেছি। এবার আবারও যাব আপনাদের, মানে জনতার আদালতে। আপনাদের কি মনে হয়? ২৪-এর রাতে ‘অ্যাকশন’ ঘটালে ২৫ তারিখ সে খবর ছাপা হওয়া সম্ভব? আমাদের এখন ধারণা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ২৪ সেপ্টেম্বর নয়, হয়তো’বা ২৩ সেপ্টেম্বর ‘অ্যাকশন’টি ঘটিয়েছিলেন। বড়জোর, রাত ১২টার ইংরিজি মতটি মেনে ২৪টি-কে ধরা যায়। কিন্তু অ্যাকশন শুরুটি ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধেবেলা, এটি ভাবা একটু মুশকিল। ২৩ হওয়াটি তা’ও যুক্তিযুক্ত। হয়তো’বা তারও আগের কোনও তারিখ হতে পারে। কিন্তু ২৪ কী করে হয়!!! যেমন এর মধ্যেই একটি নথি পাওয়া যাচ্ছে, যা বলছে, তারিখটি ছিল ২২। পৃষ্ঠা ১৯৩, ‘হিস্ট্রি মডার্ন ইন্ডিয়া’, এস এন সেন, নিউ এজ (ছবিতে দেখুন)।
পৃষ্ঠা ১৯৩, ‘হিস্ট্রি মডার্ন ইন্ডিয়া’, এস এন সেন, নিউ এজ
যদিও ২২, না ২৩ নাকি ২৪— এ দিয়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের দেশভক্তি বা আত্মদানের কোনও রকমফের হয় না। ওটি শুধুমাত্র মহাফেজখানার নথির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। (পুনশ্চ- এই বিশেষ বিষয়টি নিয়ে কোনও তথ্য পেলে আমাদের জানান। আমাদের যুক্তি নস্যাৎ করতে চাইলে, তা’ও। আমাদের তরফেও বাড়তি কোনও তথ্য পেলে আমরা এখানে তার সংযুক্তিকরণ ঘটাব, এ কথা হলফ করে বলতে পারি— সম্পাদক) এবিসি-র এই ব্লগে প্রকাশিত সুশোভন মুখোপাধ্যায়ের যে লেখাটি নিয়ে বিতর্কের শুরু, তার লিংক- https://alternativebengalchapter.blogspot.com/2020/09/blog-post_22.html


No comments:

Post a Comment