![]() |
মস্কোর যে চার্চটির আকৃতির সঙ্গে মিল হংসেশ্বরীর |
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiwHiuJIhseGIFd13m2ZexnL30W_HPTnyCvgPCi7wjtVOO_e2OGIrv_jmkWaPgrMGTE3Q4uxytpkwOace7_us42X7m1eY06hlhCxYs5wKXY6rbmWua7pnw9yYdTL1XeoYsCF8bLF-IatN0/s0/Koushik+Dasgupta+1.jpg)
কৌশিক দাশগুপ্ত
অনুবাদক, লেখক
এই লেখার একটি প্রাককথন লাগে। হংসেশ্বরী মন্দির। ক’দিন আগেই এই একই বিষয় নিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেই লেখায় মন্দির-নির্মাণের নানা কার্য-কারণ নিয়ে বলা হয়েছে। এরপর আরও একটি জরুরি সংযোজন আমাদের হাতে আসে। ইতিহাসের বিচারে, সংরক্ষণের স্বার্থে যার গুরুত্বও যথেষ্ট।
বলা যেতে পারে, এ এক অন্য ব্যাখ্যান। তাই-ই এই লেখার আয়োজন।
—সম্পাদক
তিনটি প্রশ্ন। হংসেশ্বরী মন্দির ঘিরেই।
শুরু করা যাক, সেই প্রশ্নাবলী দিয়ে।
ষোড়শ শতকের এক জগদ্বিখ্যাত রুশ গির্জা কেন ছায়া ফেলে বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ের ২০০ বছরের পুরনো মন্দিরে?
রুশ অর্থোডক্স খ্রিষ্ট ধর্মের সাথে তন্ত্রসাধনার কি সম্পর্ক আছে?
বাবার বেদখল সম্পত্তি ফিরিয়ে আনার জন্য জমানো টাকা দিয়ে মন্দিরই বা কেন গড়লেন ভূতপূর্ব জমিদার?
এই সব উত্তরের হদিশ পেতেই বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির নিয়ে আবার করে একবার ফিরে দেখা। কিন্তু তারও আগে চলুন একটু পেছন পানে হাঁটি।
১৮১৪।
সময়টা খেয়াল করুন।
রাজা রামমোহন রায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানের কাজ ছাড়ছেন। এর একবছরের মধ্যেই একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি শুরু করবেন উপনিষদের অনুবাদ।
ঠিক সে’বছরই বাঁশবেড়িয়ায় শেষ হচ্ছে হংসেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণকাজ। স্বামীর আরব্ধ কাজ শেষ করছেন জমিদার-সন্ন্যাসী নৃসিংহদেবের স্ত্রী শংকরী দেবী। যা নির্মাণে সে সময়ের হিসেবেই খরচ হয়েছিল প্রায় ৫ লক্ষ টাকা।
অথচ এ টাকায় মন্দির তৈরি হওয়ার কথাই ছিল না। ছিল বেদখল জমিদারি সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করার কথা।
তাহলে? হলটা কী? সোজা কথায়, এ হল বাংলার মাটির ভেলকি! যে ভেলকিতে ১৮১০-এ কটকের কালেক্টরীর ভূতপূর্ব দেওয়ান ও জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ ৩০ বছর বয়সে সন্ন্যাস নেন। আঠারো শতকের মধ্য ভাগে দুর্গাচরণ মিত্রের কাছারিতে হিসেবের খাতায় বেমালুম শ্যামা সঙ্গীত লিখে ফেলেন কোনও এক রামপ্রসাদ সেন...
এও সেই ধারারই আরেক কিসিম! ফিরি তার ইতিহাসে।
সাল ১৭৪০। গোবিন্দ দেব রায় হঠাৎ মারা গেলেন। তখন নৃসিংহদেব মাতৃগর্ভে। সুবে বাংলার নবাব তখন আলিবর্দী খান।
এর দু’বছরের মাথায় বর্ধমানের জমিদারের পেশকার মানিকচন্দ্র নবাব আলিবর্দীর কান ভাঙালেন। তিনি বললেন, গোবিন্দ রায় ‘অপুত্রক অবস্থায়’ মারা গিয়েছেন। কথাটি স্বভাবতই অর্ধসত্য। গোবিন্দরায়ের জীবনাবসানের তখন বছর দুই পার। মানিকচাঁদ নবাবের কাছে বেমালুম চেপে গেলেন সে কথা। ততদিনে পিতা গোবিন্দরায়ের মৃত্যুর পর জন্ম নিয়েছেন তাঁর পুত্র।
এ দিকে নবাবের খাজনা আদায় বাকি। তার কী গতি হবে?গতি করলেন সুযোগসন্ধানী শ্রীমানিকচন্দ্র নিজে। খরিদি দলিল, দানপত্র সমেত নাবালকের জমিদারির একটা বড় অংশ বেমালুম হাতিয়ে নিলেন তিনি। গঙ্গার ওপারের হালদা পরগনা হস্তগত করলেন ‘গোপাল ভাঁড়’-এর পৃষ্ঠপোষক নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। পরে যিনি মীরজাফর-জগৎশেঠদের সঙ্গে মিলে সিরাজের সাথে ‘বেইমানি’ করবেন।
এক প্রবল আত্মিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে নৃসিংহদেবের বেড়ে ওঠা। একদিকে তছরুপ হওয়া জমিদারির অংশ তাঁর ফিরিয়ে আনার তাগিদ। কারণ জমিদারি এসে ঠেকেছে ছোট্ট কুলিহান্ডা এস্টেট-এ। আবার অন্যদিকে বেইমানি ও অর্থ লালসার প্রতি তীব্র অবিমিশ্র ঘৃণা।
সে এক দমবন্ধ পরিবেশ যেন! এই সংকট তাঁকে ঠেলে দিতে লাগত বিদ্যা ও ধর্মচর্চার দিকে।
১৭৬৪।
বক্সারের যুদ্ধ।
মীরকাশেমের পরাজয়।
তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় ‘নবাবী নটে গাছটি’ সম্পূর্ণ মুড়িয়ে গেল।
এরও বেশ কিছুকাল পরের ঘটনা। ১৭৭৩। বাদশা শাহ আলমের দেওয়া দেওয়ানি পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন সুবে বাংলার খাজনা আদায়ের মালিক। নৃসিংহদেব কোম্পানির কাছে আর্জি জানালেন তাঁর লুঠ হওয়া জমিদারি তাঁকে ফেরত দেওয়া হোক। গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস ২৪ পরগনার বেদখল মহালগুলিই শুধু রাজার হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন।
বাকিটুকুর জন্য হেস্টিংসের উত্তরসূরি লর্ড কর্ন্ওয়ালিসের দ্বারস্থ হতে হল। গভর্নর জেনারেল রাজাকে বললেন, লন্ডনে কোম্পানির 'কোর্ট অফ ডিরেক্টরস’-এর কাছে আর্জি জানাতে। কিন্তু সেখানে আপিল করতে বিস্তর টাকাকড়ির প্রয়োজন।
এদিকে ছোট জমিদারির আয় কম হলে কী হয়, রাজার ঠাটবাট বজায় রাখতে গিয়ে খরচা তো বে-লাগাম।
এই পরিস্থিতিতে পড়ে নৃসিংহ ঠিক করলেন কাশীবাসী হবেন।
তাতে খরচ কমবে। জ্ঞানার্জন হবে। তার সাথে সাধুসঙ্গও।
১৭৯২-এর নভেম্বরে বিশ্বস্ত পরিজনদের হাতে রাজ্যপাট ছেড়ে তিনি শেষে কাশীবাসিই হলেন। তারপরই হল উলটপুরাণ।
শাক্ত নৃসিংহ সেখানে শৈব ও তান্ত্রিক সাধুদের আখড়ায় গিয়ে ভিড়লেন।
মজলেন তন্ত্র সাধনায়। একদিকে তন্ত্রসাধনা, অন্য দিকে কাশী খন্ডের অনুবাদে মেতে উঠলেন রাজা।
এর মধ্যেই নায়েবের কাছ থেকে একটি চিঠি এসে পৌঁছল নৃসিংহদেবের কাছে।
তার বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনায় খাজনার অনেক টাকা জমেছে কোষাগারে।
ফলে বেদখল সম্পত্তি উদ্ধারের এই হল সুবর্ণ সুযোগ!
এবার কী করলেন নৃসিংহদেব?
১৭৯৯।
স্থানীয়রা দেখলেন, বাঁশবেড়িয়ার ঘাটে চুনা পাথর বোঝাই সাত সাতটি বিশাল নৌকো এসে ভিড়ল। কী ব্যাপার? না, মন্দির তৈরি হবে! ডিসেম্বরে রাজার বজরাও নোঙর ফেলল ঘাটে।
আসলে বেদখল জমিদারি পুনরুদ্ধারের ভাবনা তখন শিকেয়। কারণ মোক্ষচিন্তা রাজার মনকে করেছে জবরদখল। হইহই করে শুরু হয়ে গেল হংসেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণ কাজ।
সে এক আশ্চর্য নির্মাণ। স্থাপত্য ভাবনা নৃসিংহদেবের একান্ত নিজস্ব। তাঁর তন্ত্রচিন্তা থেকেই যার জন্ম বলা যেতে পারে। আগের লেখাটিতে যার ব্যাখ্যা আছে। এখানে আবারও স্মরণ করিয়ে দিই।
তন্ত্রমতে শরীরের ছ’টি নাড়ি। তাদের প্রতীক রূপে উঠে যাবে ছ’টি সিঁড়ি। মেরুদন্ডের ভিত্তিমূলে অবস্থিত প্রাণশক্তির মূলে যে কুলকুণ্ডলিনী, তিনিই গর্ভগৃহে বিরাজিত হবেন দেবী হংসেশ্বরী রূপে। বসবেন হাজার পাপড়ির পদ্মের উপর। এই হল মূলাধার। তার ওপরে সহস্রারে শিব। কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে ইড়া পিঙ্গলার মধ্যে দিয়ে প্রাণবায়ু সুষুম্না নাড়ির ছ’টি চক্র পথ ধরে সহস্রারে উত্থিত হয়। পাশব যৌনশক্তিকে ওজঃ বা আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত করাই তন্ত্রসাধকদের লক্ষ্য।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেই এক ভুলভুলাইয়া। ভুলভুলাইয়ার একটি অংশে একটা ছোট্ট কুঠুরিতে বসে আছেন শ্বেত পাথরের শিব।
এখন গাইডের সাহায্য ছাড়া তার কাছে পৌঁছানো অসম্ভব।
এ আর কিছুই নয়। অন্য ভাবে দেখলে বলা যেতে পারে, এই ‘গাইড’ এখানে গুরুরই প্রতিরূপ! গুরুর প্রদর্শিত পথ ধরে কুলকুণ্ডলিনীর শক্তিকে উত্থিত করে মস্তিষ্কের সহস্রারে পৌঁছে দেওয়াটাই তাঁর কাজ। যেখানে অবস্থান করেন শিবরূপী ঈশ্বর।
৭০ ফুট উঁচু পাঁচতলা মন্দিরের ১৩ টি চূড়া র শীর্ষদেশগুলি পদ্মকোরকের আকৃতিতে তৈরি।
দোতলা অবধি কাজ দেখে যেতে পেরেছিলেন নৃসিংহদেব।
১৮০২-তে হঠাৎ তাঁর দেহাবসান। তখন তাঁর আরব্ধ কাজ শেষ করার ভার কাঁধে তুলে নিলেন ছোট রানী শংকরী।
অবশেষে ১৮১৪-তে ৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করে শেষ হল মন্দির নির্মাণের কাজ।
মন্দিরটি আকার বা গঠন-প্রকৃতি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত মস্কোর সেন্ট বাসিল ক্যাথিড্রালের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিলে যায়!
এখন প্রশ্ন হল, এই সাদৃশ্য কি কাকতালীয়?
নাকি বিদ্যোৎসাহী নৃসিংহ কোথাও দেখেছিলেন ওই বিখ্যাত চার্চটির চিত্ররূপ?
এও তো হতে পারে, আগুনের শিখার মতোই মিনারগুলি কোথাও’বা তাঁর উত্তুঙ্গ মোক্ষচিন্তাকে ধাবিত করেছিল আকাশপানে?
এই পুরো বিষয়টি আজ হয়তো বা রহস্য হয়ে বয়ে চলেছে দিনের পর দিন।
যদিও রুশ সম্রাট আইভান দ্য টেরিবেল-এর যুদ্ধজয়ের স্মারকের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির দ্যোতক এই মন্দিরটির অবস্থান কিন্তু একেবারে বিপরীত মেরুর।
জমিদারি পুনর্দখলের খোয়াবকে এই মন্দিরের ভিতের পাথরের তলায় চাপা দিয়েছিলেন নৃসিংহদেব। নিজের হাতে। যেখানে সাফল্যের সোপানে রাখা জয়ধ্বজার অস্ফালন, উল্লাস কোনওটাই নেই। বরং আছে ধর্মচিন্তায় নিমগ্ন, বিষয়-সম্পত্তির প্রতি নির্মোহ এক জমিদারের কাহিনি।
বাঁশবেড়িয়া হংসেশ্বরী মন্দিরের মিনারগুলি তাই ত্যাগধর্মের গৌরবে আজও বোধহয় কোথাও জগদ্বিখ্যাত মস্কোর ক্যাথিড্রালকে ‘দুয়ো’ দিয়ে দাঁড়িয়ে।
আকার-আকৃতি, সে তো বাইরের কথা।
আসল নির্মাণ তো অন্দরের।
সেখানে বিরাজমান এক অধ্যাত্ম-চিন্তা।
নয় কি?
ঋণঃ The Bansberia Raj by Shumbhoo Chunder Dey
![]() |
মস্কোর সঙ্গে কী ভাবে যে মিলে যায় বাঁশবেড়িয়া |
![]() |
জমিদার ঠিক করলেন কাশীবাসী হবেন |
Mondirer itihaas jene khub upokrito holam.Valo laglo.Dhonyobad.
ReplyDeleteদারুণ
ReplyDeleteThank you
ReplyDelete