Friday, November 13, 2020

জীবন যে রকম ২৬ - ভূতুড়ে শহর বোডিকে নিয়ে আমেরিকায় গল্পের শেষ নেই - বসুধা মুখোপাধ্যায়

ভূতুড়ে শহর বোডিকে নিয়ে আমেরিকায় গল্পের শেষ নেই

বসুধা মুখোপাধ্যায়
শিক্ষিকা
বোডি। পোড়ো শহর। ভূতুড়ে পরিত্যক্ত শহর। মার্কিন দেশে এসে থেকে শুনে আসছি। লেখাও পড়েছি বিস্তর বোডি নিয়ে। বহু দিন থেকেই যাওয়ারও খুব শখ। আসলে ভূত-টুত নিয়ে ছোট্ট থেকেই আমার খুব ইন্টারেস্ট। মানি, কী না মানি সে পরের কথা। কিন্তু আগ্রহটা অস্বীকার করি কী করে! ছোটবেলায় ভাবতাম, ভূতপ্রেতের গল্প বুঝি আমাদের মতো দেশের কান্ডকারখানা। বড় হয়ে অবশ্য সে ভাবনা খানিক গিয়েছিল। আর আড়াই দশক এ দেশে কাটিয়ে, মার্কিনিদের সঙ্গে ঘর করে সে সব এক্কেবারে সাফা হয়ে গিয়েছে। আমেরিকানদেরও মুখে মুখে কত ভূতের গপ্পো, সে না শুনলে ভাবতেও পারবেন না। তো, বোডি তো যাব। শুনেই প্রায় চোখে পাকিয়ে সামলে দিল আমার এক বন্ধু। বলল, ‘‘খবরদার, ভুলেও ওখান থেকে কিচ্ছুটি নিয়ে এসো না যেন! তা’হলে সেই যে তোমার অভিশাপ লাগবে, সে শাপ ছাড়বে না তোমায়।’’ পাখি পড়ার মতো করে বলে দিল অ্যাসলি। ও আমার বহু দিনের বন্ধু। এমনকী কলিগও বটে। অ্যাসলি আমেরিকান। মধ্য তিরিশের এক নারী। যাব-যাব করে বোডি যাওয়া হয়ে উঠছিল না, তার অন্যতম কারণ সময়। ছুটিছাটা একটা তো বেশ বিশাল ব্যাপার। কিন্তু সেবার অন্য কিছু ভাবলুম না।
গিয়েছিলাম ম্যামথ লেক। বেড়াতেই। সান ফ্রানসিসকোয় আগে আমরা যেখানে থাকতাম, সেই ফ্রিমন্ট থেকে ম্যামথ গাড়িতে ঘণ্টা ছ’য়ের জার্নি। ম্যামথ-এ দিন চার-পাঁচ ছিলাম। ম্যামথ লেকটা সিয়েরা-নেভেদার পাহাড় শ্রেনির মাঝে একটা লেক। লেকটা তৈরি হয় আগ্নেয়গিরির উদ্‌গিরণ থেকে। বহু বছর আগে। ওখান থেকে বোডি ঘণ্টা এক, কী দেড়। শহরটা সিয়েরা-নেভাদার পূর্ব দিকে। ক্যালিফর্নিয়া আর নেভাদার বর্ডার-এ। লোকজন ম্যামথ থেকে বোডি যায়, সাইট সিয়িং-এ। সারাদিনের ট্যুর। পায়ে হেঁটে বোডি ঘুরতে ঘণ্টা তিনেক কেটে যায়। অনেকটা পথ। তার ওপর মাখায় চড়া রোদ্দুর। খুব ক্লান্তিকর। কিন্তু অসম্ভব ইন্টারেস্টিং। এক কালের জ্বলজ্বলে, ঝলমলে, লোকজনে গমগম করা একটা আস্ত শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত, জনশূন্য হয়ে জিরজিরে শীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে। দেখতে দেখতে মনে হয়, কোন প্রাচীন কালে চলে এসেছি। নিজেকেও এক-এক সময় অচেনা লাগে। হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে যেতে হয়। আর কিছু বলার আগে বোডির ইতিহাসটা একটু বলে নিই। নইলে ব্যাপারটা বুঝতে পারা মুশকিল। এ শহরের একটা বড়সড় ইতিহাস আছে। বোডির জন্ম বলতে গেলে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘গোল্ড রাশ’-এর সময়।
গোল্ড রাশ, নিশ্চই মনে আছে, সেই যে ১৮৪৮ সালের কথা। জেমস্‌ উইলসন মার্শাল বলে এক ভদ্রলোক যখন ক্যালিফোর্নিয়ার কলোমা-র সার্টাস মিল-এ সোনা আবিষ্কার করেন! প্রায় রাতারাতি মাতামাতি শুরু হয়ে যায় অঞ্চলটি ঘিরে। সারা আমেরিকার প্রায় ৩ লাখ লোক এসে জ‌ড় হয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকতে। বোডিতেও সোনা পাওয়া যায় ওই সময়েই। সে ১৮৫৯ সালের ঘটনা। তখন অবশ্য বোডি নামের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। এখানে সোনা আবিষ্কারের মূল হোতা ছিলেন ডব্লু এস বোডি নামের এক সাহেব। পরে তাঁর নামেই এই শহরের নামকরণ হয়। যদিও শহরের বাড়বাড়ন্ত দেখে যাওয়ার আগেই আচমকা তাঁর মৃত্যু ঘটে। সোনা আবিষ্কারের পরই একানে শুরু হয় উত্তোলনের কাজ। প্রথমে মাত্র কুড়ি জন শ্রমিক দিয়ে শুরু হয় সেই কর্মকান্ড। ধীরে ধীরে আরও শ্রমিক, আরও লোকজন আসতে থাকে। ছোটবড় নানা ব্যবসাপাতি জমতে থাকে। ১৮৭৯-৮০ সালে শহরের লোকসংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার। আর সেই সময়ই বোডির ছিল সবচেয়ে বেশি রমরমা। এখন সেই বোডি-ই মৃতপ্রায়! পোড়ো পোড়ো বাড়ি। অফিস। পোস্ট অফিস। কালো কালো দেওয়াল। মজে যাওয়া শুকনো কুয়ো। ১৯৬২ পর্যন্ত কোনওক্রমে গড়িয়ে গড়িয়ে এগোচ্ছিল মরা শহরটা। তারপর তা’ও শেষ। শেষমেশ বোডি-কে ‘ন্যাশনাল স্টেট পার্ক’ হিসেবে দেখভাল করছে ক্যালিফর্নিয়া স্টেট। দেখভাল মানে, নতুন শহর গড়ে তুলছে না। বরং উল্টোটা ঠিক একই ভাবে, মানে ওই জরাজীর্ণ ভাবেই রেখে দিয়েছে পোড়ো শহরটাকে। দেখলে মনে হয়, একটা শহরের কঙ্কাল যেন দাঁড়িয়ে আছে তার সময়কে বুকে নিয়ে! সময় এগিয়ে গেলেও, বোডি এগোয়নি। মাত্র পাঁচটা বাড়ি আছে এখন ওখানে। তা’ও ফাঁকা। একজন মানুষও নেই। লোকজন আসে, দেখে। আবার ফিরে যায়। জনশূন্য ভূতুড়ে বোডি বাকিটা সময় খাঁ খাঁ করে! অথচ গোল্ডরাশের ওই সোনালি সময়ে বোডিতে বাসিন্দা ছিল প্রায় ১০ হাজার। বোডি তখন সত্যি করেই সোনার রাজ্য। চারিদিকে ঘরবাড়ি। ফুর্তির আখড়া। চার্চ। দোকানপাট। ব্যাঙ্ক। শহরে প্রায় ৬৫ সেলুন খোলে। ৩২ মাইল লম্বা রেলরোড চালু হয় মূল ক্যালিফোর্নিয়া শহর থেকে ওই প্রান্তে যাবার জন্য। শীতে হাড়কাঁপানি ঠান্ডা পড়ত বটে, সেই সঙ্গে কনকনে হওয়া। লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ত খুব। মারাও যেত অনেকে। কিন্তু ধীরে ধীরে টাকার জোরে সব কিছুই ঠিক হতে থাকে। কিন্তু পয়সা আর চাকচিক্যর গন্ধ ধীরে ধীরে যত আরও বাড়তে থাকে আলটপকা ভিড় জমতে থাকে খুব। শুরু হয় নানা রকম ঝুটঝঞ্ঝাট। চুরি, ডাকাতি, মারামারি। সাধারণ লোকেরা সারাদিন সোনার খনিতে কাজ করে পয়সা অর্জন করে রাতের শহরকে নোংরা করে দিতে শুরু করে দিতে লাগল সেই সময় থেকেই। শুরু হল খুন খারাপি, রাহাজানি, বেলেল্লাপনা। সকালে উঠে নাকি তখন লোকজনের প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল, কাল রাতে কেউ কি মারা পড়েছে? শোনা যায়, এক ভদ্রলোক একবার ঠিক করেন বোডিতে এসে থাকবেন। ভদ্রলোকের একটি ছোট্ট মেয়ে ছিল। মেয়েটি অজানা আশঙ্কায়, অনিশ্চয়তায় কাল গুনে নাকি তখন তার ডাইরিতে লেখে, ‘‘গুডবাই গড!’’ হঠাৎই এরকমই হতকুচ্ছিত দিন এসে গিয়েছিল শহরে। আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন বোডির আকাশ ছিল ঝলমলে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছিল। গাইড গল্প শোনাচ্ছিলেন। একটু করে হাঁটলে রাস্তার ধারেই পুরনো দিনের গল্প লেখা। পড়ছিলামও সে সব। ধীরে ধীরে মনটা কেমন গ্রাস করে নিচ্ছিল একটা পুরনো সময়। ১৮৮২ সালেই নেমে আসে বোডির জনসংখ্যা ৩০০০-এ। অনেক ব্যবসা ধীরে ধীরে শহরটা দেউলিয়া হয়ে যায়। লোকে ছাড়তে থাকে তাদের সোনার শহর। বোডি তখনও অবশ্য হাল ছাড়েনি। ওখানকার বড় বড় সোনার খনিগুলো ১৮৮৭ সালেও একসঙ্গে মিলে বেশ জবরদস্ত ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে। প্রায় তিরিশটি সোনার খনি ১০০ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে সেই বাজারে। তখনই ঘটে যায় বড় বড় সব অগ্নিকান্ড! ভিত টলে যায় শহরটা তার জের বোধহয় আর নিতে পারেনি। ১৯৩২ সাল। শোনা যায়, একটি আড়াই বছরের বাচ্চা ছেলে দেশলাই নিয়ে খেলা করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনে। এবং সে বিপদ, বলে বিপদ! আগুন লেগে শহরের পঁচানব্বই শতাংশ বাড়ি পুরো ধ্বংস হয়ে যায়। এর মধ্যেই চলে এল ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’। কুখ্যত সেই ‘অর্থনৈতিক মন্দা’। তখন শহর ধুঁকে ধুঁকে একশা। তবু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্য‌ন্ত লোকজন কিছুটা হলেও থাকত শহরে। তারপর ধীরে ধীরে যেন কবরখানার মতো হয়ে যেতে থাকে সবটা!
লোকে বলে, শেষপর্যন্ত মাত্র ছ’জন লোক ছিল। তার মধ্যে তিন জন আত্মহত্যা করে। আর একজন নিজের স্ত্রীকে মেরে ফেলে বলে অন্য দু’জনে তাকে খুন করে।
তারপর থেকেই বোডিকে ঘিরে যত রাজ্যের গল্প। ভূতের। অতৃপ্ত আত্মার। আমাদের গাইড ঘোরাতে ঘোরাতে বলছিলেন সে সবই। উনি এমন ভাবে বলছিলেন, যেন সব কিছু যেন চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। টাইম মেশিনে আমরা পিছিয়ে গিয়েছি অনেকটা। অ্যালিসের কখাটা মনে পড়ছিল, ‘‘কিচ্ছু নিয়ে এসো না সঙ্গে। তা’হলেই অভিশাপ পেয়ে বসবে। আর যাবে না জীবন থেকে!’’ অভিশাপ! লোভ! লাগামহীন ফূর্তি। তার পরই ভয়ঙ্কর পতন! আচমকা। ক’টা বছরের ব্যবধানে মাত্র। সোনার চুড়োয় ওঠা একটা দেশ ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ল। ভেঙে পড়ল। তাসের ঘরের মতো। পুড়ে থাক হয়ে গেল তার সোনায় মোড়া সময়। এক কালের সোনার রাজ্য আজ তাই বিভীষিকাময়। বর্ণাঢ্য দিন যার অতীতের কাহিনি। পোড়া গায়ে সে শুধু দাঁড়িয়ে ট্যুরিস্টের জন্য শো-কেস হয়ে! সময় কী নির্মম, না?


No comments:

Post a Comment