ভূতুড়ে শহর বোডিকে নিয়ে আমেরিকায় গল্পের শেষ নেই |
বসুধা মুখোপাধ্যায়
শিক্ষিকা
বোডি। পোড়ো শহর। ভূতুড়ে পরিত্যক্ত শহর। মার্কিন দেশে এসে থেকে শুনে আসছি। লেখাও পড়েছি বিস্তর বোডি নিয়ে। বহু দিন থেকেই যাওয়ারও খুব শখ।
আসলে ভূত-টুত নিয়ে ছোট্ট থেকেই আমার খুব ইন্টারেস্ট।
মানি, কী না মানি সে পরের কথা।
কিন্তু আগ্রহটা অস্বীকার করি কী করে!
ছোটবেলায় ভাবতাম, ভূতপ্রেতের গল্প বুঝি আমাদের মতো দেশের কান্ডকারখানা। বড় হয়ে অবশ্য সে ভাবনা খানিক গিয়েছিল। আর আড়াই দশক এ দেশে কাটিয়ে, মার্কিনিদের সঙ্গে ঘর করে সে সব এক্কেবারে সাফা হয়ে গিয়েছে। আমেরিকানদেরও মুখে মুখে কত ভূতের গপ্পো, সে না শুনলে ভাবতেও পারবেন না।
তো, বোডি তো যাব। শুনেই প্রায় চোখে পাকিয়ে সামলে দিল আমার এক বন্ধু।
বলল, ‘‘খবরদার, ভুলেও ওখান থেকে কিচ্ছুটি নিয়ে এসো না যেন! তা’হলে সেই যে তোমার অভিশাপ লাগবে, সে শাপ ছাড়বে না তোমায়।’’
পাখি পড়ার মতো করে বলে দিল অ্যাসলি। ও আমার বহু দিনের বন্ধু। এমনকী কলিগও বটে। অ্যাসলি আমেরিকান। মধ্য তিরিশের এক নারী।
যাব-যাব করে বোডি যাওয়া হয়ে উঠছিল না, তার অন্যতম কারণ সময়। ছুটিছাটা একটা তো বেশ বিশাল ব্যাপার।
কিন্তু সেবার অন্য কিছু ভাবলুম না।
গিয়েছিলাম ম্যামথ লেক। বেড়াতেই। সান ফ্রানসিসকোয় আগে আমরা যেখানে থাকতাম, সেই ফ্রিমন্ট থেকে ম্যামথ গাড়িতে ঘণ্টা ছ’য়ের জার্নি। ম্যামথ-এ দিন চার-পাঁচ ছিলাম।
ম্যামথ লেকটা সিয়েরা-নেভেদার পাহাড় শ্রেনির মাঝে একটা লেক। লেকটা তৈরি হয় আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ থেকে। বহু বছর আগে।
ওখান থেকে বোডি ঘণ্টা এক, কী দেড়। শহরটা সিয়েরা-নেভাদার পূর্ব দিকে। ক্যালিফর্নিয়া আর নেভাদার বর্ডার-এ।
লোকজন ম্যামথ থেকে বোডি যায়, সাইট সিয়িং-এ। সারাদিনের ট্যুর। পায়ে হেঁটে বোডি ঘুরতে ঘণ্টা তিনেক কেটে যায়। অনেকটা পথ। তার ওপর মাখায় চড়া রোদ্দুর। খুব ক্লান্তিকর। কিন্তু অসম্ভব ইন্টারেস্টিং।
এক কালের জ্বলজ্বলে, ঝলমলে, লোকজনে গমগম করা একটা আস্ত শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত, জনশূন্য হয়ে জিরজিরে শীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে। দেখতে দেখতে মনে হয়, কোন প্রাচীন কালে চলে এসেছি। নিজেকেও এক-এক সময় অচেনা লাগে। হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে যেতে হয়।
আর কিছু বলার আগে বোডির ইতিহাসটা একটু বলে নিই। নইলে ব্যাপারটা বুঝতে পারা মুশকিল।
এ শহরের একটা বড়সড় ইতিহাস আছে।
বোডির জন্ম বলতে গেলে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘গোল্ড রাশ’-এর সময়।
তারপর থেকেই বোডিকে ঘিরে যত রাজ্যের গল্প। ভূতের। অতৃপ্ত আত্মার। আমাদের গাইড ঘোরাতে ঘোরাতে বলছিলেন সে সবই। উনি এমন ভাবে বলছিলেন, যেন সব কিছু যেন চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। টাইম মেশিনে আমরা পিছিয়ে গিয়েছি অনেকটা। অ্যালিসের কখাটা মনে পড়ছিল, ‘‘কিচ্ছু নিয়ে এসো না সঙ্গে। তা’হলেই অভিশাপ পেয়ে বসবে। আর যাবে না জীবন থেকে!’’ অভিশাপ! লোভ! লাগামহীন ফূর্তি। তার পরই ভয়ঙ্কর পতন! আচমকা। ক’টা বছরের ব্যবধানে মাত্র। সোনার চুড়োয় ওঠা একটা দেশ ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ল। ভেঙে পড়ল। তাসের ঘরের মতো। পুড়ে থাক হয়ে গেল তার সোনায় মোড়া সময়। এক কালের সোনার রাজ্য আজ তাই বিভীষিকাময়। বর্ণাঢ্য দিন যার অতীতের কাহিনি। পোড়া গায়ে সে শুধু দাঁড়িয়ে ট্যুরিস্টের জন্য শো-কেস হয়ে! সময় কী নির্মম, না?
No comments:
Post a Comment