Wednesday, November 18, 2020

জীবন যে রকম ২৭ - সত্যও চলে গেলি আর যে নিতে পারছি না - সুব্রত ভট্টাচার্য

সত্য চলে গেলি
আর যে নিতে পারছি না 
সুব্রত ভট্টাচার্য
ফুটবলার, কোচ
সত্যজিতের চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না! ময়দানেও কেমন যেন একটা মৃত্যু মিছিল লেগে গিয়েছে! প্রদীপদা, চুনীদা। হঠাৎ করে কার্লটন চ্যাপম্যান। মণিতোম্বি সিং। এবার সত্যজিৎ। সত্যজিৎ ঘোষ। হার্ট অ্যাটাক। আমার পাশে দাঁড়ানো সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিক যার ঝটকাটা নিতে পারল না! প্রতিদ্বন্দী ‘অ্যাটাকার্স’-দের কাছে সবচেয়ে বড় পাঁচিল, মরণকামড়ে হেরে গেল। কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। খাঁ খাঁ করছে বুকের ভেতরটা। এ কী শুরু হল গোটা পৃথিবীতে। এত নির্মম সত্যি যে আর নিতে পারছি না। কবে চারপাশের এই সব কুৎসিত ছবিগুলো ‘মিথ্যে’ হয়ে যাবে! হায় রে সত্য! মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, সত্যিই কি আমি এখনও বেঁচে আছি! নাকি মরে বেঁচে থাকার রহস্যটা বুঝে উঠতে পারছি না। এই ভয়ঙ্কর নির্মম করোনা-বছরে অজানা মৃত্যুভয়ের নাগপাশ কি আমাকেও তিলে তিলে বেঁধে ফেলছে?
চিমাকে রুখতে নাছোড় সত্যজিৎ
সত্যজিৎ, বয়সে মোটামুটি আমারই কাছাকাছি। ষাট পেরিয়েছে বছর দুই আগে। আমি যেমন, তেম‌ন ও-ও অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে। শরৎচন্দ্রের জন্মের গাঁ হুগলির দেবানন্দপুরের বাসিন্দা। সত্যজিৎ হচ্ছে অনেকটা সেই ধরনের ফুটবলার, যে ’৮০-র দশকের প্রথমার্ধ জুড়ে বছরের পর বছর নীরবে মোহনবাগানের সেবা করে গিয়েছে। এবং প্রচারের আলো থেকে লক্ষ লক্ষ যোজন দূরে দাঁড়িয়ে! সময়কালটা একবার ভাবুন। ময়দানে তখন আজকের মতো বিদেশি ফুটবলারদের আকছার আনাগোনা নেই। মোহনবাগানে তো নয়ই। চিমা ওকোরি, এমেকা এজুগো, জামশিদ নাসিরির মতো ‘চিতা বাঘ’ ময়দান কাঁপাচ্ছে। উল্টো দিকে মফস্‌সলের দুবলা-পাতলা, অথচ সিংহহৃদয় যে স্টপার আমার পাশে দাঁড়িয়ে ওই ভয়ঙ্কর থাবাগুলোর সামনে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে, তার নাম সত্যজিৎ ঘোষ। ক'জন জানেন জানি না, সত্যর বাবা মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ চাকরি করতেন জিএসআই অফিসে। ছিলেন মান্নাদার (শৈলেন মান্না) সহকর্মী। কট্টর মোহনবাগানী। মান্নাদার থেকে ‘কমপ্লিমেন্টারি কার্ড’ নিয়ে খেলা দেখতে আসতেন সবুজ-মেরুন মাঠে। তরুণ সত্যজিৎও সুযোগ পেলেই বাবার সঙ্গে মোহনবাগানের ম্যাচ দেখতে আসত। আর তখন নাকি আমার খেলা বেশি মন দিয়ে দেখত। এ সব কথা সত্তর দশকের। সত্যর মুখ থেকেই শোনা। মোহনবাগান ড্রেসিংরুমের আড্ডায়। বহু বছর বাদে। ফুটবলে পা দেওয়ার প্রথম দিন থেকেই ওর স্বপ্ন ছিল, কখনও, কোনও একদিন সবুজ-মেরুন জার্সি পরবে! দুঃসমেয়ের কালো বৃষ্টিতে কাকভেজা ভাঙা মন নিয়ে এই লেখাটা লিখতে লিখতে আমার প্রথমবার বলতে ভাল লাগছে যে, বিরাশিতে এই অধমই মান্নাদাকে বলে সত্যজিৎ ঘোষকে মোহনবাগানে সই করিয়েছিল!
কালিকটে মফতলালকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান। ট্রফি নিয়ে (বাঁ দিক থেকে) সত্যজিৎ ঘোষ, শিশির ঘোষ, শ্যাম থাপা, উলগানাথন
বিনা কারণে নয় কিন্তু। ঘটনাটা বলি। ঠিক আগের বছর। ১৯৮১। মোহনবাগান অ্যাটাক-লাইনে তখন ‘এক সে বড় কর এক’ — মিহির বোস, জেভিয়ার পায়াস, শ্যাম থাপা, ফ্রান্সিস ডি'সুজা। কলকাতা লিগে রেলওয়ে এফসি ম্যাচ খেলতে নামলাম আমরা। সে দিন উল্টোদিকের ডিফেন্সে কার্যত একা দেওয়াল হয়ে বাগানী-সমর্থকদের একই সঙ্গে পীড়া ও তারিফের কারণ হল যে ছেলেটি, তার নাম সত্যজিৎ ঘোষ। ও তখন রেল-এ সই করে সদ্য ক্যাজুয়াল স্টাফ থেকে মেট্রো রেলের স্থায়ী চাকুরে। একদম ধাপে ধাপে এদেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল সত্য। '৭৯-তে কলকাতা ময়দান। চতুর্থ ডিভিশন। যাদবপুর অগ্রগামীতে খেলা শুরু। পরের বছরই প্রথম ডিভিশন। সালকিয়া ফ্রেন্ডস। ’৮১-তে রেলওয়ে এফসি। ’৮২-তে মোহনবাগান। টানা ’৮৬ অবধি। তবে শেষ দু’বছর ও খুব একটা বেশি ম্যাচ খেলেনি। আসলে ’৮৫-তে রাজস্থান ম্যাচে একটা বিশ্রি চোটের শিকার হয় সত্য। নইলে সত্যজিৎ ঘোষের মোহনবাগান-জীবন আমার প্রিয় ক্লাবের আরেক বিখ্যাত ‘সত্য’, সত্যজিৎ চ্যাটার্জির মতোই হয়তো বিরাট লম্বা হত! ১৯৮৫-র নেহরু কাপে চিরিচ মিলোভানের ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়ে ইন্ডিয়া জার্সি পেয়েছিল সত্যজিৎ ঘোষ। মিলোভান, আমার বিচারে ভারতে আসা সবচেয়ে দক্ষ বিদেশি কোচ। সেই বিচারেই বলছি, সে বছরই গুরুতর চোট পাওয়ার সময় কী দুর্ধর্ষ ফর্মে ছিল সত্য, একবার ভাবুন। নইলে মিলোভানের মতো জহুরি কোচের পছন্দ হয়! সত্যি, ফাটা কপাল কাকে বলে! তার আগের বছরও তো! ’৮৪-তে কাঁপানো টিম ইস্টবেঙ্গলের। গোলে ভাস্কর। ডিফেন্সে মনোরঞ্জন, বলাই, চিন্ময়, তরুণ দে, অলোক। হাফে গৌতম, সুদীপ, সুনির্মল। ফরোয়ার্ডে বিশ্বজিৎ, মিহির, দেবাশিস রায়, নরিন্দর গুরুং! এক একটা পজিশনে আগুন-খেকো সব। কিন্তু সেবছরই কলকাতা লিগ, ডুরান্ড কাপ জিতেছিল মোহনবাগান। ইডেনে লিগের বড় ম্যাচ আর ডুরান্ড ফাইনাল দু'বারই ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছিল সবুজ-মেরুন। মনে আছে, ইডেনে চোট পাওয়া মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে খেলেছিলাম আমি। বড় ম্যাচে সেটা যথেষ্ট ‘রিস্ক’ নেওয়া। যতই সাহস থাক, খানিকটা ‘নেগেটিভিটিও’ তো কাজ করে ভেতরে ভেতরে। সে দিন আমার পাশে কী ভাবে দাপিয়েছিল অকুতোভয় সত্য, আজও ভুলতে পারি না। সেবারই ডূরান্ডে ফাইনালের আগে অবধি আমি খেলতে পারিনি। ইন্ডিয়া ক্যাম্প ছিল। তার আগে পর্যন্ত সমরকে (ভট্টাচার্য) নিয়ে সত্য ডিফেন্স সামলেছিল দুর্দান্তভাবে। ফাইনালটাও দুর্দান্ত খেলেছিল। '৭৪-তে আমার মোহনবাগান-কেরিয়ার শুরু নঈমদার (সৈয়দ নঈমুদ্দিন) পাশে। ১৯৯০-এ শেষ মরশুমে আমার স্টপার-সঙ্গী জোসেফ। ১৭ বছরে কম করে ১৭ দু’গুণে ৩৪ জন স্টপারকে নিয়ে খেলেছি আমি। তার মধ্যে নঈমুদ্দিন ছাড়াও বিজয় দিগপতি, নিমাই গোস্বামী থেকে শুরু করে পি. (প্রদীপ) চৌধুরি, সমর ভট্টাচার্য, অচিন্ত্য বেলেল, সুদীপ চ্যাটার্জি, অমিত ভদ্র, সত্যজিৎ ঘোষ হয়ে স্বরূপ দাস, জোসেফের মতো সতীর্থ। তবুও নিঃসঙ্কোচে বলব, সবচেয়ে বেশি কমফোর্টেবলি খেলেছি সত্যকে পাশে নিয়ে। ঘরোয়া ফুটবল-আড্ডায় অনেকবার বলেছি, মোহনবাগানে আমার পাশে খেলা স্টপারদের মধ্যে সত্যজিৎ ঘোষ সবচেয়ে ভাল। শুনে অনেকে মুখ টিপে হেসেছে। তা হাসুক। কিন্তু আমি আমার ‘বলা’ থেকে আজও নড়ার কোনও কারণ দেখি না। আমাদের স্টপার-জুটির ডিফেন্স অর্গানাইজেশন-এ সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা কাজ করত, তা হল আমরা ছিলাম একে অন্যের ‘কমপ্লিমেন্টারি’। আবার মিলও প্রচুর। সত্যরও ‘হেড’ ছিল আমার মতো পাওয়ারফুল। পাশাপাশি ওর লম্বা দৌড়গুলো ছিল দারুণ স্পিডি। স্লাইডিং ট্যাকল মারাত্মক। দু’টো পা প্রায় হাওড়া-শেয়ালদা স্ট্রেচ করে দিতে পারত! ওকে আমার আরও ভাল লাগত ওর সততা, নিয়মানুবর্তিতা, শান্ত স্বভাবের জন্য। আর ছিল সাঙ্ঘাতিক দায়িত্ববোধ। প্র্যাকটিসে একদিনও কামাই দিত না। সত্যিকারের টিমম্যান বলতে যা বোঝায়, সত্য ছিল তাই। গ্রাম থেকে আসা অনেক ভাল ভাল ফুটবলারকে আমি নিজের দীর্ঘ খেলোয়াড় জীবনে দেখেছি। ময়দানে এসে বড় ক্লাবে ‘স্টার’ হয়ে ওঠার পর ‘পাল্টি’ খেয়ে গিয়েছে তাদের অনেকেই! সত্যজিৎ ঘোষের তা কখনও হয়নি। সত্য এখানেই বিরল। ব্যতিক্রম! যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস সত্য! তোকে কোনওদিনও ভোলার নয়। সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখাঃ সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়


No comments:

Post a Comment