Saturday, November 21, 2020

জীবন যে রকম ২৮ - ‘সাডেন ডেথ’ যাদের ছিটকে দিয়েছে মাঠ ময়দানের ওপারে - সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়

‘সাডেন ডেথ’ যাদের ছিটকে দিয়েছে মাঠ ময়দানের ওপারে 
সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
সাডেন ডেথ! ফুটবলের এই নিয়মটা একটা খেলার নিমেষে নিষ্পত্তি ঘটিয়ে দেয়। এবং নির্দয় ভাবে। খানিকটা তেমনই নিয়ম কেমন যেন বেনিয়মি মেজাজে আস্ত ময়দানি জীবনকে ওলটপালট করে দেয় মাঝে মাঝেই! এ লেখায় তারই কিছু ঘটনা বলব। শুধু আমার ক্রীড়া সাংবাদিকতার জীবনে বলে নয়, যে ঘটনাগুলো, যে দিনগুলো ভারতের সব স্পোর্টস জার্নালিস্ট, এমনকী ক্রীড়া-প্রেমিকদের কাছেও চরম বেদনার। প্রচন্ডই হতাশার। দুমড়েমুচড়ে চলে যাওয়া ‘আমফান’-এর ধ্বংসাত্মক কান্ডের পরের দিনগুলোয় শ্মশানের হাহাকারের মতো! এক-একটা ভয়ঙ্কর মৃত্যুসংবাদ! আচম্বিতে। মুহূর্তের জন্য যা কিনা আমাদের হাতের অক্ষরকে শুষে নিয়ে চলে যায় যেন! এই ২০২০-তে এসেও তার ঝাপটা যেন চলেছে, তো চলেছেই। এখনও পর্যন্ত যার শেষতম শিকার হল প্রাক্তন মোহনবাগানী, এক কালে ভারতীয় দলের অন্যতম সেরা স্টপার সত্যজিৎ ঘোষ। যে কথা সুব্রত ভট্টাচার্য বলেছেন আগের লেখায়। আমি ফিরে যাব পিছনের দিনগুলোয়।
বল পায়ে ময়দানের ‘মারাদোনা’ কৃশানু দে
কৃশানু দে
আশির দশক আর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক। দেশের সর্বোৎকৃষ্ট বলপ্লেয়ার, আদর করে 'ভারতের মারাদোনা' বলা হত যাঁকে। নাকতলার সেই সদা হাসিখুশি মানুষটা, মাত্র ৪১ বছর বয়সে দূরারোগ্য পালমোনারি এমবোলিজমে অকস্মাৎ চলে গেলেন। টানা একরাত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষে। পর দিন সকালেই। ফুসফুসে রক্তজমাট বেঁধে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার এই রোগটি বিরল। বিশেষ করে খেলাধুলো করা মানুষের তো বটেই! ভারতীয় ফুটবলের সেই কালো দিনটা ছিল ২০ মার্চ, ২০০৩!
জুনিয়রের সঙ্গে সেই সংঘর্ষের মুহূর্তে সুব্রত পাল
ক্রিস্টিয়ানো সেবাস্তিয়ানো লিমা জুনিয়র
২০০৪। ফেড কাপ ফাইনাল। বেঙ্গালুরুতে ডেম্পো-র প্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান। ম্যাচের ৭৮ মিনিটে নিজের দ্বিতীয় গোলটা করতে মরিয়া ডেম্পোর ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড জুনিয়র। তখনই প্রচন্ড স্পিডে এগিয়ে আসা জুনিয়রের সঙ্গে ভয়ঙ্কর জোরে বাগান-গোলকিপার সুব্রত পালের সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা। কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লেন জুনিয়র। মিনিট কয়েকের ভেতর মাঠেই মারা গেলেন তিনি। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলেও মাত্র পঁচিশ বছরের জুনিয়রকে সেখানে ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ভারতীয় ফুটবলে কোনও খেলোয়াড়ের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর করুণ দিনটা ছিল ৫ ডিসেম্বর, ২০০৪!
কেন যে শেষ হয়ে গেলেন সত্যেন
ভাট্টা পরমবথ (ভিপি) সত্যেন
আজীবন কেরল পুলিশ দলে খেলা মানুষ। ওই সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সাফ ফুটবল সোনাজয়ী প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক। ভিপি সত্যেন। ময়দানে একমাত্র মোহনবাগান জার্সি গায়ে চড়িয়েছিলেন নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে (১৯৯১-৯৫)! এই মালয়ালি তারকা সেন্টার-ব্যাক মাঠ ছাড়ার কয়েক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ২০০৬ সালের ১৮ জুলাইয়ের সকালে চেন্নাইয়ের পালাভরম স্টেশন ক্রসিংয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সত্যেনের বয়স তখন মাত্র ৪১!
ময়দানের অন্যতম সেরা কমপ্লিট ফুটবলার সুদীপ
সুদীপ চট্টোপাধ্যায় আধুনিক ফুটবলে ভারতের অন্যতম সেরা আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার। সুদীপ চ্যাট্টোপাধ্যায়। ২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হাওড়ার শিবপুরে নিজের বাড়িতে নিশ্চিন্তে পেয়ারা খাচ্ছিলেন। আচমকা তার একটা টুকরো শ্বাসনালীতে আটকে গেল। তারই কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যান সুদীপ! ৪৭ বছর বয়সি তরতাজা মানুষটাকে হাসপাতালে ভর্তি করেও কোনও লাভ হয়নি!
মাত্র ৩৯-এই শেষ মণিতোম্বি সিং
মণিতোম্বি সিং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে এক মরশুম মোহনবাগান অধিনায়ক। প্রাক্তন আন্তর্জাতিক ফুটবলার। মণিতোম্বি সিং। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে চলে গেলেন চলতি বছর, মানে এই ২০২০ সালের ৮ অগস্ট। ইম্ফলে নিজের গ্রামের বাড়িতে। বেশ কিছুদিন ধরে রোগভোগের পর। ১৯৭১-এর দীর্ঘ ৩২ বছর পর প্রথমবার কোনও আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট জয়ী ভারতীয় দলের (ভিয়েতনামে ২০০৩ অনূর্ধ্ব-২৩ এল.জি. কাপ) অন্যতম ডিফেন্ডার ছিলেন এই মণিতোম্বি।
ভাবা যায় না কার্লটন চ্যাপম্যান নেই
কার্লটন চ্যাপম্যান ভারতীয় ফুটবলে কর্নাটক থেকে আসা শেষ প্রভাবশালী খেলোয়াড়। কার্লটন চ্যাপম্যান-ও এই ২০২০-তেই আচমকা হৃদরোগে শেষ। ১২ অক্টোবর মারা গিয়েছেন তিনি। বয়স মাত্র ৪৯! ১৯৯৫-২০০১ টানা ৬ বছর জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক চ্যাপম্যান টিএফএ-র ’৯০ সালের সেরা ফসল। এরপর ’৯০-এর দশকে ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে চ্যাপম্যানের নির্ভেজাল স্ট্রাইকারের ভূমিকায় খেলা, গোল করা, গোল করানোর পাশাপাশি ১৯৯৮-এ সল্টলেক স্টেডিয়ামে এশিয়ান কাপ উইনার্স কাপে ইরাকের আল জাওরার বিরুদ্ধে তাঁর হ্যাটট্রিক (ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল ৬-২ গোলে) লাল-হলুদ সমর্থকদের কাছে চিরস্মরণীয়! ভাবতেই অবাক লাগে সেই কার্লটন আর নেই।
কুলোথুঙ্গন, মনজিৎ, নরিন্দর
কুলোথুঙ্গন, মনজিৎ সিং, নরিন্দর গুরুং ২০০৩ আসিয়ান কাপ জয়ী ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠের কান্ডারি কুলোথুঙ্গন। বয়স মাত্র ৪০। ’৭০ দশকে ভারতীয় ফুটবল কাঁপানো জেসিটি-র সুদর্শন তারকা ফরোয়ার্ড মনজিৎ সিং। বয়স ৪২। ’৮০-র দশকে কলকাতা ময়দানের চোখধাঁধানো বলপ্লেয়ার নরিন্দর গুরুং। বয়স মাত্র ৪৭। এই তিন সুপারস্টার ফুটবলারই মাঠ ছাড়ার কয়েক বছরের মধ্যে অকালে জীবনের মাঠ থেকেও চিরবিদায় নিয়েছেন একই মর্মান্তিক কারণে। তিনজনই মারা যান আলাদা আলাদা গাড়ি দুর্ঘটনায়! যথাক্রমে ২০১৮, ১৯৯২ আর ২০০৭ সালে!


No comments:

Post a Comment