![]() |
বঙ্গভঙ্গের আর এক নায়ক দিয়েগো মারাদোনা |
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj-Q9Xymzw935spVBKImjLaNz8RIGnbVA5bXk7tuKCxCAYIxwWxhsOTC7pqHdJ7xb1TEP5q2VXr0Cye_CO1xrREbSczwift7-WH1eSz0T75_0W16BQUQkoXS7eyBZVRkjE9dZVDjNhDTF0/s780/Supriyo+Mukherjee+3.jpg)
সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
কী আশ্চর্য সমাপতন!
তাঁর ভাবাদর্শের পূর্বসূরি কিউবার ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বামপন্থী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এবং তাঁরই মতো ‘বেয়াড়া’ জীবন কাটানো একই আঙিনার দোসর, ব্রিটিশ জাতীয় দলের মহানায়ক জর্জ বেস্ট সবারই চলে যাওয়া তাঁরই মতো, একই দিনে!
নভেম্বরের ২৫।
চলে গেলেন বাঙালির হৃদয়ের ধন মা-রা-দো-না!
বর্ণিল জীবনে এমন অবাঞ্ছিত, অনাঙ্ক্ষিত দিনলিপির ইতি কি এভাবেই টানতে হল ফুটবল-সম্রাট! বাঙালির একচেটিয়া ব্রাজিল-প্রেমের বলয়ে ফাটল ধরানো আর্জেন্টেনীয় দ্য গ্রেট দিয়েগো মারাদোনা?
তাঁর ছায়াযুদ্ধের এক গুরুজন, অপর সম্রাট নাসিমেন্টো পেলে ট্যুইট করেছেন, ‘‘এই জন্মে আর হল না। আকাশে একসঙ্গে দু’জনে খেলব!’’
টেনিস কোর্টের কিংবদন্তী রজার ফেডেরার ব্লগ-এ লিখেছেন, ‘‘আমার ফুটবল রোমান্স শেষ হয়ে গেল! দিয়েগো মারাদোনাই ছিল আমার কাছে ফুটবল-প্রেম!'’’
দুনিয়া কাঁপানো গল্ফার টাইগার উডস পোস্ট করেছেন, ‘‘ফুটবলজগত হারাল তার সেরা ম্যাজিশিয়ানকে!’’
![]() |
ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার |
বলিউডের শাহেনশা অমিতাভ বচ্চন টুইটে লিখেছেন, ‘‘মারাদোনা নেই, আমার কাছে আর ফুটবলও নেই!’’
একালের বলিউডি জেন-নেক্সট্-এর অন্যতম হার্টথ্রব রনবির সিং বলছেন, ‘‘ফুটবল তার ঈশ্বরকেই হারাল!’’
শেষ সংলাপটি শুধু খেয়াল করুন! মারাদোনার প্রেম-বৃত্তের উৎকৃষ্টতম নমুনার একটি।
’৮৬ সালে দিয়েগোর ‘হ্যান্ড অব গড’ যখন দুনিয়াতে শোরগোল ফেলে দিচ্ছে, তাঁর এক বছর আগে জন্মেছেন টিনসেল টাউনের আজকের এই মেগাস্টার রনবির!
বাইশ গজের আর এক হৃদ-কাঁপানো নায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণ-কথাটিও কী কম গুরুত্বের!
মহারাজ লিখেছেন, ‘‘আমার হিরো চলে গেল! আমি আমার হিরোকে হারালাম! তার জন্যই আমি ফুটবল দেখতাম!’’
মহারাজের বয়স যখন ১০, গোটা দুনিয়ার কাছে দ্বিতীয় বারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপে নামা এক সম্রাট জানান দিচ্ছেন, ‘‘আমায় দ্যাখো, আমায় দ্যাখো। আমি এসে গিয়েছি।’’
’৮৬-তে যাঁকে নিয়ে রূপকথা লেখা হবে!
এ সব কথালাপের পরেও কেন জানি না, মনে হচ্ছে, ভাত-চচ্চড়ি-পোস্তর বাঙালি-ঘরে এই বাক্যগুলো সদর দরজায় এসেই থমকে গিয়েছে!
বাঙালি-মনে মারাদোনা পিঁড়ি পেতেছেন তার হেঁসেলে। সেখানে শুধু তিনি ফুটবলের জাদুকর নন, তিনি একচেটিয়া ব্রাজিল-প্রেমী ফুটবল-পাগল বাংলার ঘরে ঘরে লাতিন আমেরিকার আরও একটি দেশের প্রতি অনুরাগের জন্মদাতা। আরেক বঙ্গভঙ্গের নায়ক! যে ‘ভঙ্গের’ এক পারে পুরনো প্রেমিক ব্রাজিল, অন্য পারে আর্জেন্টিনা। একটি পেলের দেশ। অন্যটা ‘নবকুমার’ মারাদোনার। আকাশছোঁওয়া সাফল্যের চূড়ায় বসেও শৈশবের বস্তিবাসী বন্ধুদের ভুলতে না-পারা এক ক্ষ্যাপাটে মানুষের।
বেয়াড়া, বোহেমিয়ান, অসংযমী জীবনের কখনও দর্শক, কখনও চোরা প্রেমিক, কখনও ভুক্তভোগী গেরস্ত, তো কখনও কল্পবিলাসী জীবনে তীব্র ঔৎসুক্য প্রকাশ করা একটি জাতির কাছে হয়তো’বা তিনি আর এক নিভৃত প্রাণের দেবতা!
অথবা মাঝরাতে ফুটপাত বদল করা সেই সব যুবকদের আরও একটি চন্দ্রাহত তারা!
তিনটে সাল মনে পড়ছে।
২০০৮। ২০১৫। ২০১৭।
মারাদোনা-বাঙালি যোগের তিন-তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বছর।
তিনবারই পশ্চিমবাংলায় মাটি স্পর্শ করেছিলেন ফুটবলের এক ঈশ্বর!
২০০৮।
এই বঙ্গে বাম সরকার ক্ষমতায়। সেই সময় মারাদোনাকে কলকাতায় দুই প্রধান উদ্যোগীদের একজন ছিলেন তৎকালীন বামনেতা-সাংসদ শমীক লাহিড়ী, এক এনজিও প্রধান ভাস্বর গোস্বামী।
দিন কয়েক আগে ‘আনন্দবাজার’-কে দেওয়া একটি লেখায় শমীক নিজে সে কথা লিখেওছেন।
বলেছেন, প্রাথমিক ভাবে ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ও দেশেরই সেবেস্তিয়ান ও হ্যারিসের। হ্যারিসের দাদা ছিলেন জাতীয় দলের খেলোয়াড়। ওঁদের মাধ্যমেই এরপরের যোগযোগ মারাদোনার প্রথম স্ত্রী ক্লদিয়ার সঙ্গে। উনিই মারাদোনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেন।
শেষমেশ ডাউনটাউনে সম্রাটের দরবারে শমীকদের ড্রাইভ করে নিয়ে যান মারাদোনার ছোট জামাই।
পাঁচ মিনিট নয়। ঘণ্টা দুই ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন মারাদোনা। তারপরই কনট্র্যাক্ট পেপারে সইসাবুদ। এবং প্রথমবারের জন্য তাঁর কলকাতায় আসা (ক্রীড়ামন্ত্রী তখন সুভাষ চক্রবর্তী)। বিমানবন্দরে কাতারে কাতারে দর্শক দেখে ১৯৮৬-৮৭ সালে ইতালির নাপোলির হয়ে জিতে আসার সম্বর্ধনার কথা মনে পড়া। মহেশতলায় একটি ক্যাম্পে যাওয়া। জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করা। সল্টলেক স্টেডিয়ামে বাংলার ক্রীড়ামন্ত্রী একাদশ বনাম ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ম্যাচে অংশ নেওয়া। শুধুমাত্র অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও মাঠে বল পড়তেই শার্ট-প্যান্ট পরে মাঠে নেমে যাওয়া। ওই বছরই ওঁর মোহনবাগান তাঁবুতে যাওয়া।
মোহন-তাঁবুতে সেদিন আমিও ছিলাম।
তাঁবু ঘুরে মাঠে মারাদোনা। দুর্গাপুর থেকে মোহনবাগান একাডেমির বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেদের কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ওদের মাঠেই আলাপ করানো হয় ফুটবলের রাজার সঙ্গে।
বাগান-মাঠে মারাদোনার ‘এন্ট্রি’টা আজও মনে পড়ে।
ঘাসে হাত ছোঁওয়ালেন সম্রাট।
মাঠে নামলেন। দুধসাদা হাফ শার্ট, কালো ট্রাউজার।
ইডেন গার্ডেন্সের দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই অতি-পরিচিত ভঙ্গী!
ডান হাতের মুঠো ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে বুকে থাবড়া মেরে চলেছেন।
হাসির হুল্লোড় গ্যালারিতে।
লোকজন বলতে লাগল, এ যেন ’৭৭-এর কলকাতায় খেলে যাওয়া তাঁর চির প্রতিদ্বন্দ্বী পেলেকে বলতে চাওয়া, ‘‘তুমি ওখানে খেলে গিয়েছ। আজ দেখো আমিও এখানে। এই কলকাতায়।’’
এর আগের ঘটনা যদ্দুর জানি, ভাস্করদের সঙ্গে কথায় কথায় মারাদোনাকে আনার ব্যাপারটি বলেন সম্ভবত মোহন-কর্তা টুটু বসুর পুত্র সৃঞ্জয়।
২০১৫।
আবার মারাদোনা। এবং কলকাতা। সল্টলেক স্টেডিয়াম।
খেলা হল শ্যাম থাপা একাদশ বনাম মারাদোনা একাদশ।
২০১৭।
প্রথমবারের মতো সৌরভ মহারাজ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা দিয়াগোর। বারাসাতের একটি অ্যাকাডেমিতে।
একের পর স্মৃতি উছলে উঠছে। আর কেন যেন বারবার ফিরে যাচ্ছি ’৭৭-এ!
আমি তখন বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট স্কুলে। ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। পেলের কসমস কলকাতায় এল মোহন-একাদশের হয়ে খেলতে। এখনও মনে পড়ে, শহর জুড়ে সেদিন কী ভাবে ফুটপাত-দখল করে ফেলেছিল কাতারে কাতারে মানুষ। বিপদ বুঝে শেষ মুহূর্তে রুট বদলে পেলেকে পৌঁছে দেওয়া হয় পূর্ব নির্ধারতি এক পাঁচ তারা হোটেলে।
গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে দেখতে স্বপ্নালু ঘোরে ডুবে যাচ্ছিলাম বারবার।
আর ২০০৮-এ তো আমার অ্যাসাইমেন্ট। মারাদোনা-অভিযানের। হার্ড-কোর প্রফেশনাল এক কাগজের ক্রীড়া সাংবাদিক হয়ে।
তারপর তো কম দেখলাম না, এ জীবনে! কিন্তু আজও অবাক হয়ে ভাবি, আবেগ কেন পিছু ছাড়ে না এই ভিনদেশি তারাটির জন্য। আর কেনই’বা এত বছর সাংবাদিকতা করেও দু’টো নামের ঠোকাঠুকি টের পাই মনের গভীরে— এডসন আরেন্তাস ডো নাসিমেন্টো আর দিয়েগো আরমান্দো ফ্রাঙ্কো!
আমার শৈশব থেকে যৌবন। পুরোটাই তো ব্রাজিল আর ব্রাজিল। সেখানে এক ঈশ্বর, অদ্বিতীয়ম। পেলে, পেলে এবং পেলে।
১৯৫৮, ১৯৬২। পর পর দু’বারের চ্যাম্পিয়ন হলুদ-সবুজ ব্রিগেড। ঈশ্বর তখন মন্ত্রমুগ্ধ করে বাকহারা করে দিয়েছেন আমার মতো বাঙালি কিশোর, যুবা, এমনকী প্রৌঢ়দেরও। খেলার ছিটেফোঁটো তখন দেখতে পাই না টিভিতে। কোথায় টিভি! রেডিয়োতেও ও সব খেলা শোনা যায় না। শুধু কাগজে পড়ে পড়েই প্রেম ব্রাজিল আর পেলের প্রতি।
’৬৬-তে ইংল্যান্ড প্রায় গুন্ডামি করে শেষ করে দিল টানা তিনবার ব্রাজিলের জুলে রিমে কাপের দখলদারি। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়লেন আমাদের ঈশ্বর। বহু পরে ‘জায়েন্টস্ অব ব্রাজিল’ সিনেমায় সে দৃশ্য স্বচক্ষে দেখে কত জন যে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছে সে দিনের ইংল্যান্ড দলকে!
’৭০-এ ঠেকানো গেলানো না। তৃতীয় বারে জন্য চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল।
সে যেন কালো মানুষের স্বাধীনতার উল্লাস। সে উল্লাসের ছোঁওয়া আমাদের ভেতরেও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিচ্ছে। ভাবথানা এমন যেন, ব্রাজিল তো সুদূরের কোনও দেশ নয়, এ তো আমাদের এই তেরঙ্গা মাতৃভূমি!
এত আবেগ! এত আবেগ!
সেই আবেগেই কেমন করে চোরা ভাগ বসতে লাগল ’৮২-তে।
তারপর ’৮৬-তে পুরো ফ্ল্যাট আমাদের অনেকেই।
ড্রিবল, ড্রিবল, ড্রিবল।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় গোলটা আজও বারবার দেখি ইউটিউব-এ।
অবিশ্বাস্য। অকল্পনীয়।
সেমি ফাইনালে বেলজিয়ামের গোলটাই বা বাদ দিই কী করে! পর পর সাতজনকে কাত করে মারাদোনার গোল!
পুরনো ঈশ্বরের সিংহাসনে নতুন ঈশ্বরের ঠাঁই তখন থেকেই।
ততদিনে মারাদোনার নতুন ‘ঠেকা’ নাপোলি-তে বিচিত্র সব কান্ডের ভেলকি ঘটে চলেছে। পরের পর অবিশ্বাস্য কারিকুরিতে প্রতিপক্ষের জাল ফুঁড়ে দেওয়ার অজস্র নমুনা।
গোটা দুনিয়াকে যেন শাসন করতে লাগলেন তাঁর নয়া সম্রাট। আজও মনে পড়ে একটি ইংরেজি ম্যাগাজিনের মধ্যিখানের পাতায় মারাদোনার তখনকার ব্লো-আপ। নীচে ক্যাপশন, ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাট হিজ্ ফিট’!
একজন ফুটবলারের আবেগ যে কী চূড়ান্ত হতে পারে, তার একটি নমুনা দিই শেষে।
১৯৮৫।
নেপল্স-এ পা রাখলেন মারাদোনা। নাপোলির জার্সি গায়ে দেবেন, তাই।
দক্ষিণ ইতালির ছোট্ট শহরটায় সত্তর হাজার মানুষ ভেঙে পড়ল রাস্তায়। সমস্যা ভারাক্রান্ত হয়েও তাঁদের গলায় সে দিন ফুটন্ত আবেগ— ‘‘আমাদের মেয়র নেই। ঘরবাড়ি নেই। জল নেই। চাকরি নেই। নিরাপত্তা নেই। কিন্তু আমাদের মারাদোনা আছে।’’
ভাবি শুধু আপদমস্তক বেনিয়মি এবং খতরনাক জীবন কাটানোর পরও এই আবেগের জন্ম কী করে দিয়ে গেল লোকটা!
বঞ্চনা, হতাশা, রাগ, অধিকার, লড়াইয়ের অপর নাম কী করে হয়ে যেতে পারল দিয়াগো মারাদোনা!
কূল পাই না ভেবে।
ভাবনার তরী ভাসে। কিন্তু যুক্তি দিয়ে তো আর ‘ধারাস্রোত’ রোখা যায় না।
মন যে শাসন মানে না!
হৃদি ভেসে যায় বার বার...! নয়নের জলে!
![]() |
সম্রাট এবং মহারাজ |
![]() |
এভাবেই সেদিন মাঠে |
![]() |
এই যে আমি |
খুব ভালো, সত্যি ফুটবল যেন গোটাটাই মারাদোনাময়।
ReplyDeleteইতিহাস তো পাতার পর পাতা লেখা হয় কিন্তু এই ইতিহাস সাক্ষাত দৃশ্যমান।
ReplyDelete