Wednesday, December 30, 2020

জীবন যে রকম ৩০ - সেই সন্ধে ও আরও এক কত অজানারে-র জন্ম - পার্থ চৌধুরী


সেই সন্ধে ও আরও এক কত অজানারে-র জন্ম

পার্থ চৌধুরী
সফটওয়্যার কারিগর
 
ছেলেবেলায় বসে আঁকো প্রতিযোগিতা-য় মুখের বদলে ডাব এঁকে এসেছিলেন কারণ প্রত্যেক মানুষের মুখে সেই কাঁচা বয়েসেই কোনও না কোনও সবজি দেখতেন| পুরস্কার পাননি। কারণ বিচারকরা বুঝতে পারেননি ছেলেটি সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে আছে, (আর আজকে সমাজ, সভ্যতা সবুজ সবুজ করে হেদিয়ে পড়ছে!)| ডাবটা যদি গোল না এঁকে চৌকো আঁকতেন, তাহলে হয়তো দ্বিতীয় পিকাসো হতেন| কিংবা নিশ্চিত দ্বিতীয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় হতেন, যদি অঙ্কে অষ্টআশির বদলে অপ্রত্যাশিতভাবে বারো না পেতেন| জগদ্বিখ্যাত গায়ক হওয়া হয়ে ওঠেনি কেবল কতগুলো বলগা ছাড়া সুরকে বাগ মানাতে পারেননি বলে| হাজারও মানুষ আধ্যাত্মিকতার সন্ধানে জুতোর শুকতলা খইয়ে ফেলে, আর তিনি কিনা বেলুড় মঠে প্রথম প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন দর্শনার্থীদের জুতো সামলাতে| জুতোর পাহাড় টপকে এক ধাপ এগোলেই তিনি হয়তো হতেন দ্বিতীয় মহাসাধক| যাঁর লেখক হওয়া নিতান্তই আকস্মিক। কেবল শ্রদ্ধার মানুষটিকে স্মরনীয় করার তাগিদে| তা’ও কেবল মাত্র একটা স্ট্যাচু তৈরির টাকা না থাকায়, কিম্বা দেশপ্রেমিক এক কর্পোরেশনের কাউনসিলার এক সাহেবের নামে স্বাধীন ভারতবর্ষের রাস্তার নামকরণে চরম অরাজি হওয়ায়| নিয়তিকে ধন্যবাদ, বার বার এতগুলো দ্বিতীয় হওয়া থেকে সযত্নে বাঁচিয়ে আমাদের এক অদ্বিতীয় শংকর উপহার দেওয়ার জন্য| বছর কয়েক আগের কথা। এক রবিবার। অগস্টের একুশ। সন্ধেবেলা আমাদের ইন্ডিয়া সেন্টার-এর সিদ্ধার্থদা (বসু) হাওয়াটা তুললেন, শংকর কদিনের জন্যে নিউ ইয়র্কে এসেছেন| প্রতিদিন-ই তাঁর কিছু না কিছু আছে, তবু আমাদেরই আর একজন, অভিজিৎ, যার শংকরের সঙ্গে পারিবারিক সূত্রে আলাপ আছে, তাঁকে ফাঁকফোকর খুঁজে লিপিলেখা-য় আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে| জানা নেই ঘটনাটা ঘটবে কিনা, তবু একটা হেডকাউন্ট চাই| চোখ বুঁজে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম| বেশি ভাবতে গেলেই সমস্যা বেরিয়ে পড়বে| সোমবার জানা গেল, তিনি মঙ্গলবার আসবেন। কিন্তু একে বয়েস হয়েছে, তায় পরের দিন ইউ এন-এ বক্তৃতা আছে। সুতরাং সাড়ে ছ’টায় আসবেন আর আটটা-র মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে| অফিসের দিন। সাড়ে ছ’টার বদলে সাড়ে সাতটায় হলে একটু সুবিধে হত। কিন্তু রিস্ক নিয়ে লাভ নেই| যে মানুষটি উনিশশো সাতষট্টি থেকে দু’হাজার এগারোর মধ্যে মাত্র চারবার আমেরিকায় এসেছেন, তাঁকে এবারে ফসকালে পরের বার কবে পাব, কে জানে!
‘সীমাবদ্ধ’ ছবির শ্যুটিং
মঙ্গলবার। তেইশে অগস্ট। অফিস থেকে বেরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে নর্থ হোয়াইট প্লেনসে ইন্ডিয়া সেন্টারে পৌঁছলাম সেই মানুষটাকে দেখার আকাঙ্ক্ষায়। যাঁর ‘এক ব্যাগ শংকর’ পাওয়ার জন্যে ক্রিকেট না খেলে বাড়িতে বসে অঙ্ক করেছি| সত্যজিৎ রায় যাঁর ‘জনঅরণ্য’ আর ‘সীমাবদ্ধ’ নিয়ে সিনেমা করার পর দাদাকে উত্তেজিত হয়ে বলতে শুনেছি, “কত বড় লেখক হলে সত্যজিৎ রায় তাঁর গল্প নিয়ে ছবি করে জানিস? বিভূতিভূষণ! তারাশঙ্কর! রবীন্দ্রনাথ! তার বাইরে শুধু শংকর আর সুনীল!” যাঁকে দেখলাম, তাঁকে অবলীলায় আমার পাড়াতুতো কাকাবাবু বলে চালিয়ে দেওয়া যায়| এই মানুষটা নাকি পঁচাশি-ছিয়াশি খানা বই লিখেছেন| মাথার পেছনে জ্যোতি নেই, নেই ড্যান ব্রাউন কিম্বা জেমস প্যাটারসনের চাকচিক্য| সোফার কোণে বসে এক পা ঝুলিয়ে, এক পা সোফায় ভাঁজ করে তুলে, বিবেকানন্দ সম্বন্ধে তাঁর নতুন বই সম্পর্কে সবিস্তারে আড্ডা মারছেন| সেলিব্রিটি দেখার উৎসাহ লোপ পেল, তবে স্নিগ্ধ মানুষটিকে বেশ ভাল লেগে গেল| ক্রমে লোকজন জুটল। এবং শংকর-কে আরামকেদারা থেকে উৎখাত করে একখানা চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হল| সামনে সারি সারি গুণমুগ্ধ। মাঝখানে লজ্জা নিবারণের জন্যে একটা টেবিল| অনানুষ্ঠানিক আড্ডার সময়ে প্রসঙ্গের অভাব ঘটেনি। হঠাৎ ক্লাসিক লেখক পাঠক কনফারেন্স শুরু হতেই প্রশ্নগুলো একটু শুকিয়ে গেল| অগত্যা, প্রশ্নের অভাবে প্রশ্নকর্তারা সেই প্রস্তরযুগ থেকে যা করে এসেছেন, অর্থাৎ, সাক্ষাৎকারদাতাকে নিজেকে বেচতে অনুরোধ করা, তাই দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হল, ‘‘আপনার সম্বন্ধে কিছু বলুন!” যে পরিস্থিতিতে বড় বড় লোক খেই পায় না, সেখানে শংকর দেখালেন বাগ্মিতা আর রসবোধের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ| ছেলেবেলার গল্প দিয়ে শুরু করলেন| শুরু করলেন দাদামশায়ের কথা দিয়ে| এক স্বাধীনচেতা মানুষ, যিনি অফিসে সাহেবকে টেবিলের ওপর পা তুলতে দেখে চড় কষিয়েছিলেন| যার ফলাফল চাকরির অন্ত। এবং সংসারে চরম দারিদ্রের আভির্ভাব| মায়ের নাম ছিল গৌরী। এবং তিনি ছিলেন সার্থকনামা| অবশ্য স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলের নামে মিলে যাওয়ায় তাঁর সে নাম বিয়ের পরে পালটে করে দেওয়া হল অভয়া| যদিও স্বামীর গাত্রবর্ণ বিপরীত মেরুতে| যথাকালে একটুর জন্যে মায়ের রং পাওয়াটা ফসকে গিয়ে মণিশংকর জন্মালেন বাবার রং নিয়ে| সেকালে দু’রকমের পাউডার পাওয়া যেত। সাদা এবং গোলাপী| ফর্সা না হলে সাদা পাউডার মাখা চরম অপরাধ গণ্য করা হত| দাদামশাই সাহেবকে চপেটাঘাতের পরে সম্ভবতঃ নিয়ম ভাঙ্গার কুফল ঠেকে শিখেছিলেন। তাই নাতির মুখ দেখতে উপহার আনলেন এক কৌটো গোলাপী পাউডার| সে পাউডার আর মাখা হয়ে ওঠেনি, মা সেই কৌটো বহুকাল সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন| তারপরে ক্রমে এল, ‘কী কী হতে পারতেন’-এর গল্পেরা, যার উল্লেখ গোড়াতেই করেছি| এমনি হাজারও ছোটবেলার গল্পের মধ্যে দিয়ে শংকর অনায়াসে বরফ গলালেন| লোকজন একটু নড়েচড়ে বসে দ্বিতীয় দফা প্রশ্নের ফুলঝুরি ছোটাল| বারওয়েল সাহেবের কথা উঠতে শঙ্করের দৃষ্টি নম্র হয়ে এল| গলার আওয়াজে হালকা হাসির জায়গা নিল শ্রদ্ধা এবং হরষ-বিষাদ|
‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে উত্তমকুমার ও শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়
যদিও “কত অজানারে”-তে সবই পড়েছি, তবু মুগ্ধ হয়ে আরেকবার শুনলাম তাঁর জীবন পালটে দেওয়া মানুষটির গল্প। তাঁর লাইব্রেরিতে শেলী, কিটসের প্রথম স্বাদ, জীবনের প্রথম উত্তরণ| ভালবাসার মানুষটিকে অমর করে রাখার জন্যে কী ভাবে লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম উপন্যাস, জমা দিয়ে এলেন সম্পাদকের হাতে| ‘কত অজানারে’ প্রকাশের পরে যখন ভবিতব্য বাঁধা হয়ে গিয়েছে, ডালহৌসি-তে এক বৃষ্টিভেজা সন্ধায় প্রথম প্রোথিত হল বিখ্যাত উপন্যাস ‘চৌরঙ্গী’র অঙ্কুর| জিজ্ঞেস করলাম, ‘চৌরঙ্গীর গল্পটা কী করে মাথায় এল?’ ততক্ষণে শংকর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় ফিরে এসেছেন, মুচকি হেসে বললেন, “সে জনসমক্ষে বলার নয়!” সুতরাং, ‘কত অজানারে’-র পরের বই-এর জন্মের ইতিহাসটা অজানাই থেকে গেল| অনুবাদ সাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠল। এবং শংকর আর একটি হাসির তুবড়ি ছাড়লেন| তৎকালীন এক প্রখ্যাত সম্পাদক দীপ্তেন সান্যাল নাকি বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন, কারণ তা’হলে নাকি সাহেবরা জানতে পেরে যাবে কে কোথা থেকে টুকেছে| যদিও মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে জানালেন রবীন্দ্রনাথের ভাল অনুবাদ হয়নি, কারণ এমন লোক জোটেনি যিনি একাধারে রবীন্দ্রনাথকে বোঝার মতো বাংলা জানেন এবং সঙ্গে তাঁকে অনুবাদ করার মতো ইংরেজি জানেন| যদিও বাঙালি লেখক, যাঁরা ইংরেজিতে লেখেন তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং তাঁদের সাধুবাদ দিলেন পশ্চিমের মানুষের কাছে ভারতীয় সাহিত্যিকদের সহানুভূতির দেউড়ি থেকে তুলে এনে শ্রদ্ধার বৈঠকখানায় বসানোর জন্যে| প্রশ্ন এল, ‘বড় লেখকের লক্ষণ কি?’ অবলীলায় উত্তর দিলেন, ‘‘সহজ লেখা, কিন্তু যা পাঠককে সময়ানুবর্তিতায় বাধ্য না করে বরং তার উপলব্ধির রঙে রাঙ্গা হয়ে ওঠে|’’ যদিও তাঁর চরিত্ররা অসম্ভব রকমের জীবন্ত, এবং তাঁদের প্রায় সবাইয়ের জন্ম দৈনন্দিন জীবনে দেখা মানুষদের নিয়ে, শংকর নির্দ্বিধায় জানালেন যে, তিনি কখনও কোনও আত্মীয়র চরিত্র লেখায় ব্যবহার করেননি| কারণ, তাতে গল্পের একটা দুটো চরিত্র বাড়ত বটে, কিন্তু বহু সম্পর্ক ছিন্ন হত। সময় প্রায় শেষ। লেখককে এবার ছুটি দিতে হবে। তাই শেষ মরিয়া প্রশ্ন, ‘লেখক হিসেবে আপনার নিজের লেখার থেকে কি প্রত্যাশা?’ বাংলার মাটির একরাশ গন্ধ ছড়িয়ে শংকর বিদায়ের আগে তাঁর শেষ উত্তরে সর্বজনকাম্য যশ, খ্যাতি, মান-কে কিস্তিমাত করে শুনিয়ে দিয়ে গেলেন— “প্রত্যেক মানুষের বুকের ভেতরে একটা প্রদীপ থাকে| যদি আমার লেখার মধ্যে দিয়ে কয়েকজনের বুকের ভেতরের সেই প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে যেতে পারি, তবে সেই আমার পরম পাওয়া!”
অফিসঘরে তিনি
 ছবিঃ সংগৃহীত 

No comments:

Post a Comment