মহেঞ্জোদড়োর বাঙালি আবিষ্কারকও আজ উপেক্ষিত
শিক্ষক, মুর্শিদাবাদ
সময়টা বিশ শতকের প্রথম দিক।
বর্ষার সময়।
বহরমপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছেন বাড়ির কর্তা।কৃতি পুরুষ তিনি।তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কর্ণসুবর্ণ এলাকার বাসিন্দা এক দিনমজুর। হঠাৎ কর্তার নজর গেল দিনমজুর লোকটির কাদা-মাখা পায়ের দিকে।
অদ্ভুত লালচে রঙের কাদা। দেখেই সন্দেহ হল তাঁর।
নিম্ন রাঢ়বঙ্গে তো সচরাচর এরকম মাটি দেখা যায় না। উঠোন থেকে ঘরে ডেকে আনেন সেই লোকটিকে। ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘আন হেঁসো!’
গতিক দেখে সেই দিনমজুর তো কেঁদে অস্থির। ক্ষুদ্র চাষি সে। কী না কী অপরাধ করল সে!
আর এদিকে কর্তা নিজের হাতে সেই অদ্ভুত রঙিন কাদা চেঁচে একটা কাগজে সংগ্রহ করলেন।
কলকাতায় আর্কিওলজি অফ ইন্ডিয়াতে পাঠালেন পরীক্ষার জন্য।
দেখা গেল তাঁর অনুমান অভ্রান্ত— ওই কাদা আসলে ষষ্ঠ শতকের রাজা শশাঙ্কের আমলের নিদর্শন।
এই কৃতি পুরুষটি আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
যাঁর প্রত্নতাত্বিক আবিষ্কার ও গবেষণালব্ধ ফল ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাচীনত্ব আরও কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেয়।
কিন্তু কে ছিলেন তিনি?
এই প্রজন্মের পড়ুয়াদের অনেকেই বলতে পারবে না।
অতি দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি।
আমরা তাকে চিনি মহেঞ্জোদড়োর আবিষ্কর্তা হিসাবে।
কিন্তু তাঁর জন্ম কোথায়? জানেই বা ক’জন।
প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে। বহরমপুরের ব্যস্ততম এলাকা কল্পনার মোড়, তার পাশেই রাধিকামোহন সেন রোড, সেখানেই রাস্তার ওপর এক বিশাল দোতলা বাড়ি।
অথচ আশপাশের অনেকেই জানেন না যে এই বাড়ি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিধন্য। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ঢাকার অন্তর্গত বিক্রমপুরের অধিবাসী ছিলেন।
সেখানে নবাব দরবারে উচ্চপদে বহাল ছিলেন। মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সময় দেওয়ানি দফতর ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। তখন থেকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষরা ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে মুর্শিদাবাদের অপর পারে ডাহাপাড়ায় বসবাস শুরু করেন।
|
ছয়ঘরিয়া গ্রামের বাড়ি সংলগ্ন মন্দির |
পরবর্তীকালে তিনি বহরমপুর থেকে বনগাঁর ছয়ঘরিয়া গ্রামে চলে আসেন। সেখানে আজও তাঁর বাড়ি রয়েছে। জীবদ্দশায় তিনি বহুবার এসেছেন এই বাড়িতে। কাজের সূত্রে সারা বছর দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ালেও পারিবারিক দুর্গাপুজোয় বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার বাড়িতে নিয়ম করে হাজির থাকতেন তিনি।
এমনকী নিজের হাতে গ্রামবাসীদের মধ্যে বস্ত্রদান, প্রসাদ-বিতরণ করতেন। প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে আজও প্রতি বছর বনগাঁর বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়।
রাখালদাসের পিতা মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি হিন্দু কলেজ থেকে শিক্ষালাভ করার পর বহরমপুরে ওকালতি শুরু করেন। যথেষ্ট নাম-ডাক তাঁর।
রাখালদাসের জন্ম? ১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল।
১৯০০ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ‘এন্ট্রান্স’ পাস করার পর ১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে এফ.এ. পাস করেন। তখন থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজে যুক্ত হন।
|
বনগাঁর ছয়ঘরিয়া গ্রামের বাড়িতে দুর্গাপুজো |
এরপর ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের সহকারি সুপার হিসেবে যোগ দেন। কর্মসূত্রে সিন্ধুপ্রদেশ যান এবং নদীর জরিপ শুরু করেন। ২৩টি বড়, ৫৫টি ছোট প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন।
আর তারপর?
১৯২২ সালে সেই বিখ্যাত ‘মহেঞ্জোদড়ো’-র আবিষ্কার।
কলকাতায় পড়তে যাওয়ার পর থেকেই বহরমপুরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন। তবে বিশাল বাড়িটা থেকে যায়।
একসময় ওই বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন কাশিমবাজারের মহারাজ। পরে সে বাড়ি বিক্রি হয়ে আবার হাতবদল।
ফলে ওই বাড়িতে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছুই নেই।
দুঃখের বিষয়, ওই এলাকায় যে একসময় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল সেটা উল্লেখ করে তেমন কোনও ফলকও নেই। নেই কোনও স্মৃতিচিহ্ন। কোনও রাস্তার নাম হয়নি তাঁর নামে।
প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস পুরাতন মুদ্রা, শিলালিপি ও তাম্রলিপি প্রভৃতির সাহায্যে প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে বহু অজানা তথ্য আবিষ্কার করেছেন।
এছাড়াও কুলশাস্ত্র, গৌড়ীয় শিল্পকথা, বাংলার ইতিহাস, জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, ঐতিহাসিক উপন্যাস, বিভিন্ন প্রাচীন শহর, কনিষ্ক ও গুপ্ত শাসনের ইতিহাসে আলোকপাত করেছেন। তাঁর নিরলস কঠোর পরিশ্রম ছাড়া এসব সম্ভব ছিল না।
১৯৩০ সালের মে মাসে দেহবসান হয় রাখালদাসের।
মাত্র ৪৫ বছর আয়ুকাল ছিল তাঁর।কর্মযোগী রাখালদাস স্বল্পায়ু জীবনে লিখেছিলেন ১৪টি একক গ্রন্থ ও পুস্তক, ৯টি উপন্যাস এবং বাংলা ও ইংরেজিতে তিনশোরও বেশি গবেষণামূলক প্রবন্ধ। প্রাচীন হস্তলিপি বিদ্যা ও লিপি উৎকীর্ণ বিদ্যায় রাখালদাসের অবদান অনস্বীকার্য।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘The Origin of the Bengali Scripts’ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে উৎসর্গ করেন এবং এ জন্য ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘জুবিলি গবেষণা পুরস্কার’ প্রদান করে।
তিনিই প্রথম আদি বাংলা লিপির প্রতি পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
তিনি হাতিগুমফা ও নানাঘাট অভিলেখ, খরোষ্ঠী লিপি ইত্যাদির ওপর আশিটিরও বেশি প্রবন্ধ লেখেন।
১৯১৪ সালে প্রকাশিত ভারতীয় মুদ্রা গবেষণার ক্ষেত্রে ‘প্রাচীন মুদ্রা, প্রথম পর্ব’ (বাংলায় লিখিত) ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান। এটিই ভারতীয় ভাষায় মুদ্রাতত্ত্বের ওপর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের জাদুঘরে সংরক্ষিত ভাস্কর্য ও মুদ্রার ক্যাটালগের মুখবন্ধ রচনা করেন।
‘Age of the Imperial Guptas’ বইটিতে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে বিকশিত গুপ্ত-কলার শৈলীগত বৈশিষ্ট্যাবলি চিহ্নিত করেন। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ‘Eastern Indian Medieval School of Sculpture’ নামক গ্রন্থটি ভারতীয় শিল্পকলার চর্চায় তাঁর অন্যতম অবদান।
প্রায় ৪০০-র মতো সুন্দর ছবি দিয়ে সাজানো এই গ্রন্থে রাখালদাস পূর্ব ভারতীয় কলার নির্মাণ কৌশল, উৎপত্তি ও বিকাশ, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণদের দেব-দেবীদের মূর্তিতত্ত্ব, ধাতব ভাস্কর্যের কৌশল, জৈন প্রতিমা ও পূর্ব ভারতের মধ্যযুগীয় স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করেন।
মহেঞ্জোদড়োর আবিষ্কার তাঁর জীবনের এক মাইলস্টোন।
তখন তিনি ভারতের পশ্চিম অঞ্চলের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এমন সময়ে তিনি গ্রিক বিজয়স্তম্ভের সন্ধান পান। সেই সূত্রে সিন্ধু অঞ্চলে গিয়েছিলেন। একটি ঢিবির শীর্ষদেশে বৌদ্ধ বিহারের খননকালে তিনি এমন কতগুলি নিদর্শনের সন্ধান পান যা তাঁকে হরপ্পায় সাহানির খুঁজে পাওয়া নিদর্শনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
নতুন উদ্যমে ১৯২২ সালে তিনি খননকার্য শুরু করেন।
এসময়ে মহেঞ্জোদড়োর প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শনগুলি আবিষ্কৃত হয়।
এই সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ বেশ কিছু প্রবন্ধ ও গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
সেগুলি হল: ‘An Indian City Five Thousand Years Ago’ (Calcutta Municipal Gazette, November, 1928); ‘মুহেন-জোদরো’(বসুমতী, ১৩৩১);’ Prehistoric, Ancient and Hindu India’ (১৯৩৪ সালে মরণোত্তর প্রকাশিত) এবং ‘Mahenjodaro - A Forgotten Report’ (১৯৮৪)।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষার পাঠ্যক্রম অনুযায়ী দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন।
বই দুটি হল ‘History of India’ (১৯২৪) ও ‘A Junior History of India’ (১৯২৮)। মধ্য এশিয়ায় সভ্যতার উষালগ্ন ও প্রাচীনকালে ভারতে বিভিন্ন জাতির আগমনকাল থেকে শুরু করে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে রাখালদাস বাংলার ইতিহাস আলোচনা করেন।
বাংলার ইতিহাসের ওপর দুখন্ডে লিখিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ আজও গবেষকদের অবাক করে দেয়।
রাখালদাস শশাঙ্ক, ধর্মপাল, করুণা, ময়ূখ, অসীম, ধ্রুব, পাষাণের কথা, অনুক্রম, হেমকণা প্রভৃতি বাংলা উপন্যাসগুলি লেখেন। এই উপন্যাসগুলি তাঁকে সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত করেছে। কর্মযোগী এই বাঙালির পেশাজগত জীবন একদম নিষ্কন্টক ছিল না।
তবুও তিনি সমস্তরকম চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে তিনি তাঁর লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন।
অথচ বাঙালির ইতিহাস চর্চার এই পথিকৃৎকে আজকের প্রজন্ম মনে রাখেনি।
যাঁর জন্য বাঙালির ইতিহাস নিয়ে এত গর্ব তাকে কি ন্যুনতম সম্মানটুকুও আমরা দিতে পারি না?
|
বনগাঁর ছয়ঘরিয়া গ্রামের বাড়ি |
বাড়ির বা দুর্গামন্ডপের ছবিঃ দেবাশিস মন্ডল
No comments:
Post a Comment