Monday, February 22, 2021

জীবন যে রকম ৩৪ - অলিতে গলিতে গণক জ্যোতিষীদের রমরমা আমেরিকাতেও - বসুধা মুখোপাধ্যায়

অলিতে গলিতে গণক জ্যোতিষীদের রমরমা আমেরিকাতেও
বসুধা মুখোপাধ্যায়
শিক্ষিকা
কুসংস্কারের গেরোয় এদেশেও যে এমন কান্ড ঘটে, দেশে থাকতে জানতামই না। ২৪টা বছর আমেরিকায় কাটিয়ে আজও বার বার বিস্মিত হই। ১৩ তারিখ, শুক্রবার-এর আতঙ্ক এমিলিকে অসুস্থ করে ফেলেছিল শেষ পর্যন্ত। বলব সে বৃত্তান্ত পরে। সেদিন সক্কাল সক্কাল এমিলি এসেছিল। আমার কলিগ, বন্ধু। ধ্বস্ত মুখ, উদ্ভ্রান্ত চোখ, অবিন্যস্ত চুল। ধপ করে সোফাতে বসে পড়ল। ওর নতুন কেনা লাল ফোর্ড গাড়িটা সেদিনই ওদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চুরি গিয়েছে। অনেক কষ্টের জমানো পয়সায় কিনেছিল শখের গাড়ি। গ্যারাজে এসে দেখে ওর স্বপ্নটা বেমালুম বেহাত। "আমি জানতাম আজ কিছু একটা হবে। খারাপ কিছু। খুব খারাপ আজকের তারিখটা।" আজকের তারিখ!? ঝাঁ করে মনে পড়ে গেল আমার। তাই তো! আজ তো ১৩ তারিখ! আর শুক্রবারও! ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ। সেরেছে! এক লহমায় মনটা ফিরে গেল ছোটবেলার কলকাতায়। পরীক্ষার দিন সকালে এক শালিক দেখলে ‘গল্প’ ছিল! চোখ তখন জোড়া শালিকের জন্য অস্থির। ব্যস্ত অন্ন্বেষণে। যতক্ষণ না আর একটাকে দেখা যায় এক সঙ্গে। তেমনই ছিল পয়া পেনে পরীক্ষা দেওয়ার তাগিদ। ছিল বিড়ালের রাস্তা কাটা, বেরোনোর সময় কারও বেআক্কেলে হাঁচি, টিকটিকির বেমক্কা ডেকে ওঠায় উদ্বেগ। তখন এই তুকতাক গুলোকে বাতিল জিনিসের তাকে তুলে রাখতে শিখিনি। জানতাম মানতে হয়। নইলে বিপদ হয়।

এখন জানি, পরপর দু’টো ঘটনা ঘটলেই তার মধ্যে সবসময় কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে না। কাক উড়ে যাওয়ার সঙ্গে তাল পড়ার সম্পর্ক নেই, তবু সম্পর্কগুলো তালগোল পাকিয়ে যায়ই। কাকতালীয়-য় বিশ্বাস যে দেশ-কালের সীমানা মানে না, সেটা বুঝলাম আমেরিকা এসে। ছোটবেলায় আমার সরল ভিতু শহরের নোনা ধরা প্রায়ান্ধকার গলিপথে এসব আষাঢ়ে বিশ্বাস মনের ভিজে দেওয়ালে শ্যাওলার মতোই লেগে থাকত। কিন্তু বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির তেজি আলোয় ঝকঝকে তকতকে পেল্লায় আধুনিক পশ্চিমি শহরের খাঁজে খাঁজেও যে সেগুলো তাদের শিকড় দিব্যি চাড়িয়ে দিয়েছে, কে ভেবেছিল! এসে দেখলাম তেরোই শুক্রের বক্র নজরের ভয়ে বাচ্চা বুড়ো সবাই জড়সড়। ৫-৬ বছর আগেকার কথা। আমার ক্লাসে একটা পরীক্ষা পড়েছিল ওই ১৩ তারিখ, শুক্রবার। সেই শুনে ছাত্ররা ইস্কুলবাড়ি মাথায় তুলল। পরীক্ষার দিন পাল্টাতে হবে! শেষ পর্যন্ত পাল্টাতেই হল। ওই তেরোর গেরো! বাইবেল অনুযায়ী যিশুর শেষ ভোজনের সময় উপস্থিত ছিলেন তাঁর ১৩ জন শিষ্য। ১৩ তম ব্যক্তি জুডাস ইস্ক্যারিয়টই রোমান শাসকদের হাতে তাঁকে ধরিয়ে দেন। আবার, হবি তো হ, যিশুকেও ক্রুশবিদ্ধ করা হয় কোনও এক শুক্রবারে! ইভ অ্যাডামকে যেদিন জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফল খাইয়েছিল, সে’ও নাকি ছিল এক শুক্রবার! ব্যস, আর কী? শাস্ত্রেই তো বলা আছে। বছরে অন্তত একবার তো শুক্রবার আর ১৩ তারিখের কোলাকুলি হবেই। সেটা কখনও তিন তিন বারও হতে পারে। যেমন ২০১৫-য় হয়েছিল। আর হলেই... ঘড়ির দিকে অনেকেরই ত্র্যস্ত, চকিত দৃষ্টিপাত। দিনটা ভালয় ভালয় কাটলে হয়। আমার ইস্কুলের ছাত্রদের মধ্যে তো এই তেরোর ত্রাস রীতিমত। বাড়িতে একটু বেশি বয়স্ক মানুষ থাকলে মানামানির বহরও বাড়ে। তেরোর ট্যারা নজরের ভয়ে ছাড়াও অন্য কুসংস্কারও দিব্যি রয়েছে খোশ মেজাজে।
আমরা যেখানে থাকি সেই ক্যালিফোর্নিয়া হল ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। বাড়ি ঘরদোর মাঝে মাঝেই দুলে ওঠাটা এখানে জল ভাত। তো, সে কারণেই ভূমিকম্পের ইনসিওরেন্স পলিসি রিনিউ করার ব্যাপারে প্রথম দিকটা একটু গড়িমসি থাকে। শেষে , 'যদি কিছু হয়'-এর ভয়ে গাঁটগচ্চা দিতেই হয়। এবারও সেই গল্প। মাস খানেক ধরে অনেক হিসেব নিকেশ, চিন্তা ভাবনা, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস স্টাডি করা চলল। শেষে এক অশীতিপর বৃদ্ধ মনে করিয়ে দিলেন প্রাচীন ফরাসি ভবিষ্যৎবক্তা নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যৎবাণী কথা। ২০২১-এ নাকি প্রচুর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে। সঙ্গে সঙ্গে পেন্ডুলাম হেলে গেল পলিসির দিকে। ভূমিকম্প কেন হয়, কী ভাবে হয়, সেইসব স্কুল পাঠ্য জ্ঞান কোথায় উড়ে গেল মধ্যযুগের অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ভয়ের হাওয়ায়। এ জিনিস আগে থেকেই ছিল। এখন কোভিড আতঙ্ক আর তার দোসর হয়ে আসা অর্থনৈতিক ডামাডোল মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে বহুগুণ। চাকরি খোয়ানো, জীবিকা হারানো, আগের তুলনায় অনেক কম মাইনের চাকরি করতে বাধ্য হওয়া, গৃহহীণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা মানুষের মাথার উপর খাঁড়ার মতন ঝুলছে। ফলে বাড়ছে খামখেয়ালি আগামীকে বাগে আনার মরিয়া চেষ্টা। জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপনে শুধু ভারতের খবরের কাগজ, ওয়েবসাইট আর হোর্ডিংই ছেয়ে থাকে না। আজ আমেরিকার অলিতে গলিতে গণক, জ্যোতিষীদের দেদার ব্যবসা। বাড়ছে তুকতাক, ভোজবাজিকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা। আমারই এক বন্ধু দম্পতি তাদের নতুন বাড়িতে ঢোকার আগে জানলা দিয়ে বেড়াল ঢুকিয়ে দিয়েছিল এই বিশ্বাসে যে, অশুভ শক্তি কিছু থাকলে সে বেড়াল পালিয়ে আসবে। বেড়াল পালিয়েছিল না পালায়নি তা জানি না, তবে এমিলির ভয়টা পালিয়েছিল শেষ অবধি। বেশ খানিকটা চিকিৎসার পর। কীসের ভয়? ওই যে সেই ১৩ তারিখ আর শুক্রবারের ভয়। গালভরা নাম আছে তার একটা। Triskaidekaphobia/ট্রিস্কাইডিকাফোবিয়া। আজ যেন কত তারিখ? কী বার আজকে?


2 comments:

  1. এই সমস্যা 'তো সারা পৃথিবী জুড়ে। ভিন্ন দেশে ভিন্ন রূপ। চমৎকার লিখেছিস। খুব সাবলীল, সহজ।
    তোর লেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকি...

    ReplyDelete
  2. ভালো লিখেছিস রে... ভাষার মারপ্যাঁচগুলো বেশ উপভোগ করলাম ❤

    ReplyDelete