দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ১
সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
সত্যিই! ভাই না পাশে থাকলে, দাদাকে পেতামই না!
বলব সে গপ্পো।
তার আগে বলি, জীবনে অনেক খতরনাক ইন্টারভিউ নিয়েছি। এটা যেন সব ক’টাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
প্রতি পদে মনে পড়ছিল বিখ্যাত বলিউডি সংলাপ, ‘‘ডন কো পাকড়ানা মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়!’’
২০১৫। জুন মাসের গোড়ার দিক।
৬ নম্বর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট।
আনন্দবাজার অফিস।
আমি তখন ওখানেই স্পোর্টস্ বিভাগে কাজ করি। স্পোর্টস এডিটর গৌতম ভট্টাচার্য।
নিজের চেয়ারে বসেছি মাত্র। পাশেই নিজের কিউবিকল থেকে গৌতমের ডাক, ‘‘সুপ্রিয়, একবার আয়!’’
গৌতম আমার স্কুলের সহপাঠী।
পারস্পারিক তুই-তোকারি সম্পর্ক সেই কোনবেলা থেকে।
গেলাম। বলল, ‘‘হাবিবের ওপর একটা বড় স্টোরি করব ভেবেছি। সামনের কয়েক সপ্তাহ পর থেকে শনিবারের ‘পত্রিকা’য়। সিরিজ যাবে। কম করে তিন-চারটে এপিসোড তো বটেই। দেবকে সকালে বলে দিয়েছি। ও তোর সঙ্গে ব্যাপারটা কো-অরডিনেট করে নেবে।’’
দেব, মানে, দেবশঙ্কর। দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। এখন এবিসি-র সম্পাদক। তখন এবিপি হাউস-এ গৌতমের অনুজ সহকর্মী। আনন্দবাজারের শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘পত্রিকা’র দায়িত্বে।
অ্যাসাইমেন্টটা শুনেই আমি উত্তেজনায় ফুটছি।
ওদিকে গৌতম বলে চলেছে, ‘‘কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় হাবিবের ফেলিসিটেশন। তার ঠিক আগে বড়ে মিঞাকে জেন-এক্সের কাছে ভালভাবে তুলে ধরতে চাইছি। পারবি তো জমিয়ে লিখতে?’’
বড়ে মিঞা। ময়দানে এক কালে এই নামেই ডাকা হত মহম্মদ হাবিবকে।
সংযম, শৃঙ্খলার সঙ্গে ছেলেমানুষি, আবেগ, পেশাদারিত্বের তুখড় মিশেলে এক বহুরঙা স্বপ্নের চরিত্র!
ময়দানের ঘাস, পাতা, ডাল, শাখায় জমানো তার ইতিহাস।
তাঁর ওপর স্পেশাল কপি লেখার বরাত পাচ্ছি!
কেউ ‘না’ বলে নাকি!
তবে ফুটবলটা আমার নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্টের ভেতর পড়ত না।
মানসদা (চক্রবর্তী) রূপায়ণের (ভট্টাচার্য) মতো বহু অভিজ্ঞ ফুটবল সাংবাদিক তখন যদিও আনন্দবাজার ছেড়েছে, কিন্তু ফুটবল ‘কভারেজ’-এর জন্য আরও ছেলেমেয়েরা তখন গৌতমের আস্তিনের তাস!
তা সত্ত্বেও এ লেখার জন্য ওর মতো খুঁতখুঁতে লেখক-সম্পাদক আমাকে বাছছে!
এটুকু ভেবেই ততক্ষণে হৃদয়ে টাইফুন!
বন্ধু-সম্পাদকের পরের কথায় মনের ভেতরকার সেই ঝড়টা তখন লোহিতকণায় ভাঙচুর শুরু করে দিল প্রায়!
‘‘হাবিবের ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে? না থাকলে জোগাড় করে ফোনে ওর সঙ্গে কথা বল। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স্ কর। তারপর সেইমতো হায়দরাবাদে দু-তিনদিনের জন্য চলে যা। একেবারে ডিটেল-এ হাবিবের ডেরা-টেরা ঘুরে, সব দেখেটেখে, ওর ইন-ডেপথ্ ইন্টারভিউ কিন্তু। না’হলে এই লেখা ইউজলেস্।’’
একটানা বলে থামল ও।
তবে সেখানেই শেষ নয়।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার বলল, ‘‘ফটো্গ্রাফার যাবে। উৎপল (সরকার)। টাটকা ছবিটবি প্রতিটা এপিসোডে না দিলে জমবে না। উৎপল অফিসে ঢুকলেই আমার কাছে পাঠাস!’’
গৌতমের কিউবিকল থেকে বেরিয়েই আমার প্রথম কাজ হল হাবিবের ফোন নম্বর জোগাড় করা। যেটা স্বভাবতই আমার কাছে ছিল না। আসলে আমার সঙ্গে ফুটবলের ‘যোগ’ তখন কতটুকু!
একটু ভেবে নিলাম। তারপরেই নীতুকে ফোন। ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম শীর্ষকর্তা। দেবব্রত নীতু সরকার। এককথায় হাবিবের মোবাইল নম্বরটা দিয়ে বন্ধু নীতু একটা অদ্ভুত কথাও বলল সঙ্গে।
‘‘জানতাম তোমার ফোনকল পাব’’, ফোনের অন্যপ্রান্তে নীতুর হাসি!
বুঝে গেলাম, গৌতমের কথা হয়ে গিয়েছে ওর সঙ্গেও।
তখনও কী আর ছাই জানি যে, সামনের কয়েক সপ্তাহে আমার কপালে আরও কত সহস্র 'অদ্ভুত' কথা শোনা আর কিম্ভুত ব্যাপার দেখার আছে!
পরদিন। বেলার দিক। ফোন করলাম হাবিবের নম্বরে। ধরলেন এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা। আমার পরিচয়, ফোন করার কারণ সব শুনলেন।
তারপরই বলে দিলেন, ‘‘নেহি, হাবিব কিসিকে সাথ জাদা বাত নেহি করতে হ্যায়। উসকা তবিয়ত আভি ঠিক নেহি চল রাহা হ্যায়।’’
পুরো কাকুতির স্বরে ওঁরে বললাম, ‘‘জাদা নেহি। সিরিফ পাঁচ মিনিট!’’
এরপর ঠান্ডা গলায় যা উত্তর এল, তার সারমর্ম এই, হাবিব নমাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছেন!
কিন্তু এইমাত্র না শুনলাম, হাবিব অসুস্থ! কারও সঙ্গে বিশেষ কথাটথা বলেন না!
আমি হাল ছাড়ছি না।
অবশেষে ওই ভদ্রমহিলা রাজি হলেন। দুপুর তিনটের পর দিনের আরেক দফা নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরলে কথা বলবেন বড়ে মিঞা।
পাক্কা সাড়ে তিনটে। ফের হাবিবের মোবাইলে ফোন লাগালাম।
কী আশ্চর্য! এবার যাঁর ম্রিয়মাণ গলা ফোনের ও ধারে পেলাম তিনিই স্বয়ং মহম্মদ হাবিব! চার দশক আগের ময়দানের মহাদাপুটে ফুটবলার। চির লড়াকু মহম্মদ হাবিব। ভারতীয় ফুটবলের বড়ে মিঞা!
গলার স্বর শুনেই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, বেশিক্ষণ কথা চালানো অসম্ভব। তাই যতটা সংক্ষেপে সম্ভব আমার ফোন করার কারণ বলতে তিনি প্রায় হা-হা করে উঠলেন!
‘‘নেহি নেহি। ইয়ে নামমুমকিন হ্যায়। আপ লোগ ইধার আ কে কেয়া করেগা? ইতনা বরস বাদ মেরা ইন্টারভিউ কিঁউ! যো পুছনা হ্যায় ফোন পে-ই পুছিয়ে না ভাই! অউর ম্যায় বলেগাহি কেয়া?’’
গড়গড় করে বলে চললেন হাবিব।
বুঝে গেলাম, এ যাত্রায় হাবিবের ডিফেন্স টপকানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সাফ বললাম, ‘‘হায়দরাবাদে আপনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা না বলে কলকাতা থেকে ফোনে এই ইন্টারভিউ কী করে সম্ভব! আপনি স্যার বরং আজকের দিনটা সময় নিন। একটু ভাবুন। কাল আপনাকে আবার দুপুরের দিকে ফোন করব।’’
শুনেটুনে কী ভাবলেন কে জানে!
শুধু বললেন, ‘‘ঠিক হ্যায়। লেকিন মুসকিল আচে।’’
বলেই ফোনটা কেটে দিলেন।
(চলবে)
ছবিঃ উৎপল সরকার ও সংগৃহীত
পরের অংশ ২য় পর্বে
১৯৭৭। বড় ম্যাচ। সবুজ মেরুনের হাবিবের সঙ্গে ডুয়েলে লাল হলুদের শ্যামল ঘোষ |
৩ মার্চ ২০২১। কলকাতায়। ওঁর পিঠে হাত রেখে বহু যুদ্ধের বিশ্বস্ত সঙ্গী সুভাষ ভৌমিক। সামনে আলাপচারিতায় গৌতম ভট্টাচার্য |
No comments:
Post a Comment