দূর্গতিহারিণী - দুগ্গা পুজো ও এক আশ্চর্য দ্বীপের কাহিনি - সুশোভন মুখোপাধ্যায়


দুগ্গা পুজো এক আশ্চর্য দ্বীপের কাহিনি
সুশোভন মুখোপাধ্যায়
শিক্ষক, সাহিত্যিক

উত্তাল সাগরের মাঝে সবুজ একটি দ্বীপ। কতটুকুই বা!
এ দিকে তিন কিলোমিটার, তো ও দিকে ছয়।
সেই ছোট্ট দ্বীপে সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে যখন বেজে ওঠে দুর্গা পুজোর ঢাকের বাদ্যি, তখন কেমন লাগে বলুন তো!
হ্যাঁ, সত্যিই সমুদ্রেঘেরা এই দ্বীপে প্রতি বছর দুর্গাপুজো হয়। ঢাকে কাঠি পড়ে। কলা বউ স্নানে যায়। সন্ধিপুজো, ধুনচি নাচ, পুষ্পাঞ্জলি সব হয়। বিসর্জনের দিন সিঁদুর খেলা সেরে প্রতিমা নিরঞ্জন সাগরের জ‌লে!

আন্দামান। দ্বীপের নাম নীল।
সিপাই বিদ্রোহে লড়াই করা এক ব্রিটিশ সেনানায়ক জেমস নীলকে মনে রেখে যে দ্বীপটির নাম। নামে নীল হলেও আসলে ঘন নীল সাগরের মাঝে যেন সবুজের এক ছোট্ট বিন্দু এই নীল। মনে হয়, এক টুকরো সবুজ বাংলা কোল পেতে রেখেছে এই দ্বীপটিতে।

আন্দামান বেড়াতে গেলে নীল দ্বীপে যান প্রায় সবাই, কিন্তু ট্যুর প্রোগ্রামের গন্ডিতে সমুদ্র পাড়ের রিসর্টে আর মন ভাসানো সাগরবেলাতেই দিন গড়িয়ে যায় তাদের অনেকের, আড়ালে পড়ে থাকে সবুজ গাঁ আর তার সরল সরল মানুষগুলো।

আর দুগ্গাপুজো, তার উৎসব?
সে তো পরিযায়ীর মতো! আসে। যায়।
তার খবর যে রাখে, সে রাখে।

আসছি সে কথায়। তার আগে একটু পরিচয় দিই নীলের!

ঝকঝকে রাস্তা। দু’পাশে সবুজ খেত। গাছে গাছে টইটই। বাগান। ডাইনে, বাঁয়ে, এ ধারে, ও ধারে নিপাট মানুষের পল্লী। তাদের এলানো জীবন। ইস্কুল। দোকানপাট।

আমাদের উপরি পাওনা ছিল নীলের হাট। সবজি নিয়ে চাষীরা হাজির। উচ্ছে, বেগুন, পটল মুলো সবই আছে। তবে বেতের বোনা ধামা কুলো নেই, কিন্তু মাছের রকম দেখলে মাথা ঘুরে যায়!

এ বিলাস অল্প কমালে অন্য স্বাদ অপেক্ষায়
গিয়েছিলাম দুগ্গা পুজোর কিছুটা পরে।

বিকেলবেলা।
পড়ন্ত সূর্যের আলো গায়ে জড়িয়ে একেবারে নীল দ্বীপের মাঝে। মন্ডপ কাছেই। গাঁয়ের মন্দিরতলা যেমন, অনেকটা তেমন। ওখানেই সম্বৎসর নামগান হয়। কীর্তন গা‌নের আসর বসে। দিনের শেষে এই ভক্তিরসটুকু সে গাঁয়ের বিনোদন। সন্ধে নামল চোখের সামনে। লোকজনের আনাগোনা জমছে। তার মাঝে হঠাৎই আলাপ পুজো-কমিটির সভাপতির সঙ্গে। গোপালবাবু। আমাদের পেয়ে তিনি বেজায় খুশি। কতকাল পরে যেন দেশওয়ালির সঙ্গে দেখা। ‘আপনারা সবাই এখানে বাঙালি?’ ছদ্ম বিস্ময়-মাখা চোখে উত্তর, ‘‘তা নয়তো কী? ’’ স্মিত হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলতে লাগলেন, ‘‘দেশবিভাগের পরে, সরকারি লোক খিদিরপুর থেকে জাহাজে তুলে আমাদের এখানে নামিয়ে দিয়ে গেল। বলল, তোমাদের এখানেই থাকতে হবে।’’
বলার ভঙ্গিটা এমন যে, ঝট করে কতগুলো ছবি সরে সরে গেল যেন।— হোসেন মিঞা। ময়নাদ্বীপ। পদ্মানদীর মাঝি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়!
গোপালবাবু বলতে লাগলেন, ‘‘দ্বীপ তখন জনশূন্য। জঙ্গলে ভরা। সরকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কিছু রাস্তাঘাট আর জলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আমাদের বলা হল, যত পারো জমি নাও। চাষ করো।’’ ‘করলেন চাষ?’ ‘‘করব না? খাব কী? জঙ্গল কেটে শুরু হল চাষ-আবাদ। যত পারি, জমি দখল করি। লোক কম, জমি অঢেল।’’ ‘ভাল লাগতো?’ ‘‘একটুও না। জনশূন্য এই দ্বীপের মাঝে আমরা কিছু পরিবার। সরকারি জাহাজ আসত সাহায্য দিতে। আর কেউ কোথাও নেই, প্রাণ কাঁদত সবুজবাংলার জন্য। তারপর আমরাই এই দ্বীপকে বানিয়ে ফেললাম এক টুকরো শ্যামল বাংলা। স্কুল, হাসপাতাল, থানা, একে একে সব হয়েছে। তারপর বুঝলেন, সবাই ভাবলাম, দু্র্গাপুজোটাই বা হবে না কেন!’’ কথার গায়ে বঙ্গজ মন, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা হয়ে ভাসতে থাকে। প্রতিবছর এখানেও শরৎ এলে ঢাকের বাদ্যি বাজে। তার আগে এক চালা প্রতিমা তৈরি। ছোট্ট মন্দির-চত্বরে ম্যারাপ বেঁধে পুজোর বোধন। দ্বীপে পুজো ওই একটাই।
রাতে হোটেলে ফিরলাম। খাওয়া শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। গোপালবাবুর কথাগুলোই মাথায় চক্কোর মারছে। রাত নেমেছে। দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু বন্ধ হওয়াটা নাম-কা-ওয়াস্ত। চোখের সামনে দেখছি, তালাটি দেয় না কেউ। সাইকেল, স্কুটার খাড়া পড়ে রইল সড়কে। তাজ্জব! সকালে চায়ের দোকানে গিয়েছি। দোকানির সঙ্গে আলাপ জমল একটু পরেই। রাতের কথাটি তুলে বললাম, ‘‘আপনাদের এখানে চুরি-টুরি হয় না বুঝি!’’ হাসলেন। ‘‘চুরি! দ্বীপে তো হাজার তিনেক মানুষের বাস। আমরা সবাই সবাইকে চিনি। একবার চোর বদনাম হলে মুখ দেখাতে পারবে! আর সাইকেল, স্কুটার চুরি করে পালাবে কোথায়? থাকতে হবে তো এই দ্বীপেই।’’
বক্সীগঞ্জের পদ্মাপার নয়, এই যা ফারাক
শুনতে শুনতে কেমন আনমনা হয়ে পড়ছিলাম!

কোন ফাঁকে হাতব্যাগটা ফেলে রেখে চলে এসেছি, মনে নেই।
খানিক পরেই দেখি ভদ্রলোক নিজে এসেছেন গুটি গুটি। ব্যাগটা হাতে!
সেই সকালের হাসির ফাঁকে এক টুকরো কৌতুক তখন। বললেন, ‘‘পরীক্ষা করছিলেন বুঝি। বললাম না, এ দ্বীপে চোর খুঁজে পাবেন না। মিলিয়ে নেবেন, যতবার আসবেন!’’
একটা অদৃশ্য চপেটাঘাত যেন পড়ল শহুরে গা‌লের ওপর! অবিশ্বাসের দেমাক এ ভাবেই তবে বিষিয়ে দেয় সরলম‌না প্রাণকে!

চলে গেলেন উনি! কানের কাছে স্পষ্ট শুনলাম, দূরে ঢাক বাজছে। কানে আসছে। ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ... ঠাকুর যাবে বিসজ্জন...’ অতি চেনা তালে যদি ‘বিষ’-এর বিসজ্জন হত! বেশ হত না! সেই মুহূর্তে সাগরঘেরা ওই ছোট্ট নীলে নিজেকে কেমন অচেনা, অজানা, বেতালা মনে হত লাগল আমার। ছবিঃ প্রতিবেদক

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

No comments:

Post a Comment