নিউ ইয়র্ক শহরের ডাকসাইটে সুন্দরী।
শহরের নাইটক্লাবের মধ্যমণি।
বাবা শহরের বিখ্যাত নাট্যকার।
আঠারো বছরে যে যুবতী পা রাখছে হলিউডে, সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছা নিয়ে, গোড়াতেই তাঁর সে শখ শিকেয় উঠছে। উল্টে বয়সে তিনগুন এক প্রবাদপ্রতিমের প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন তিনি। তারপর প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর কাটালেন বিবাহিত জীবন।
যুবতী? উনা চ্যাপলিন!
তাঁর প্রেমিক? আর কেউ নন, স্বয়ং চার্লস চ্যাপলিন।
যাঁরা জানেন, তাঁরা মানেন চার্লি চ্যাপলিনের প্রিয়তমা স্ত্রী এই উনাই। তিনিই স্বামীর শেষ জীবনের প্রেরণার উৎস। উনা পাশে না থাকলে, চার্লির শেষ বেলার কাজগুলো হয়তো’বা ছোঁওয়াও হত না।
স্বামীর চিরবিদায়ের পরও তিনি বেঁচেছিলেন আরও প্রায় ষোলো বছর।
১৯৯১-এর ২৭ সেপ্টেম্বর, তাঁর হিমশীতল নিথর দেহটি সমাহিত করা হয় জীবনসঙ্গীর পাশেই।
চোখ রাখা যাক, এই বিচিত্র নারীর আখ্যানে। তাঁর মায়াবী জীবনের গদ্যে। তাঁর আকুল প্রেমের তুমুল স্রোতে। তাঁর ফেলে চলে যাওয়া জীবনের কয়েকটি পাতায়।
বিয়ের দিনটা থেকেই না হয় শুরু হোক গল্প।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiEKMoMkJoWw1vaYiqzQxZzXiyVE7jux5G9iSaZ_ShhLZHK2uhXsBt0SdX7wutcF4sDafxnhcl9C_iokycA69CB_1E9gPBA3sKd4LOnK5XNG8GqCsDq0Y00L8HazVGN3L925d7KTTGeBKU/w421-h499/una1.jpg) |
প্রিয়তমা উনা
|
বিয়ে নয়, যেন শ্যুটিং! রেজিস্ট্রি করার সরকারি খাতায় সই করা শেষ হতে না হতেই পালাতে হল তড়িঘড়ি। পিছন পিছন পাপারাৎজির দল।
সান্তা বারবারার রাস্তায় নবদম্পতির গাড়ি ছুটছে টাইফুনের মতো। বর স্বয়ং স্টিয়ারিং-এ! আর তাঁকে আঁকড়ে ধরে বসে তাঁর নব বিবাহিতা স্ত্রী।
সে এক দৃশ্য বটে! তাবড় ফিল্মি কাহিনির পাশে পাল্লা দেওয়া টানটান গল্প।
তবে এমনটা হওয়ার মধ্যে আকস্মিকতা নেই। বরের নামটিই উত্তেজনা ছড়াতে যথেষ্ট। তার ওপর সেটি তাঁর চতুর্থ বিয়ে। আর কনের বাপের বয়সটি হল বরের সমান-সমান। সব মিলিয়ে কৌতূহলের পারদ তুঙ্গে।
কী সাংবাদিককুল, কী সাধারণ নাগরিক!
পুরো নাম উনা ও’নীল। বিখ্যাত নাট্যকার তাঁর পিতা। ইউজিন ও’নীল।
মেয়ে তখন সবে আঠারো। আর চার্লি হাফ সেঞ্চুরি পার। বিয়ে নিয়ে হইচই-এর আগাম আন্দাজ ছিলই, তাতে বর আর দু’জনেই চেয়েছিলেন টুক করে বিয়েটা সেরে অজ্ঞাতবাসে চলে যেতে।
সে আর হল কই!
বিয়ের প্রথম দিনটা যেমন পুরো বারুদে ঠাসা, তেমনি উত্তেজক তাঁদের প্রথম দেখা। তারপরে প্রেমের সুরুয়াতটিও।
চার্লি তখন তাঁর নতুন ছবি ‘শ্যাডো অ্যান্ড সাবস্ট্যান্স’ - এর জন্য নায়িকা খুঁজছেন। নতুন মুখ চাই। পরিচিত এক মহিলা মিস মিনা ওয়ালেশ ফোনে জানালেন, ‘‘নিউ ইয়র্ক থেকে সদ্য এসেছে একটি মেয়ে, নায়িকা হিসাবে বেশ মানিয়ে যাবে।’’
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgKmq0F7MqFMEr420GI1Pwn5M9OzlSjaga1RmeOSfqqc-vioze_PyATDX92HS4a55XCEGLy7nLUV3bwxY_6IIFVhkWKwMr_hKGWe2vmpQFy5e84hd-FuO3fuLDwjROEUESVfaXlexm6WPE/w508-h308/UNA_Chaplin_family_1961_ABC.jpg) |
সপরিবার উনা ও চার্লি |
সেই মেয়েই এই উনা।
সেই-ই তাঁদের প্রথম দেখা।
মিস ওয়ালেশ-এর বাড়িতে।
প্রথম দেখাতেই ডিরেক্টর নায়ক ফ্ল্যাট! পরে সেই অনুভূতি নিয়ে চার্লি বলেছেন, ‘‘ওর সম্পর্কে যা ভেবেছিলাম, তার থেকেও একেবারে আলাদা। জ্বলজ্বলে সুন্দরী। ব্যক্তিত্ব? কথা হবে না! সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বিনয়ী, নম্র! সবটা মিলিয়ে অসম্ভব অ্যাট্রাকটিভ!’’
তবে নিজের নতুন ছবির নায়িকা হিসেবে নয়, সে দিন তিনি পছন্দ করে ফেললেন তাঁর নিজের জীবন-নাট্যের সঙ্গীকে!
তখন অসম্ভব জনপ্রিয় চার্লি। একের পর এক ছবি হিট!
চার্লি মানেই আমেরিকা থেকে ইয়োরোপ। হাউসফুল আর হাউসফুল।
অথচ তাঁর বুকের ভিতর যেন মরুভূমির শূন্যতা।
পারিবারিক জীবন বলতে যে কিস্যু নেই। বাইরে যা হোক, অন্দরে, অন্তরে তিনি নিঃসঙ্গ। একাকী।
তখনই উনা। তখনই প্রেম। তখনই জীবনে নতুন একটা মোড়।
উনার মধ্যে প্রেমে পড়ার মতো কী দেখেছিলেন চার্লি?
নিজেই বলে গিয়েছেন সে কথা, ‘‘কী কৌতুকবোধ! কী সহ্য ক্ষমতা! ওর স্বভাবের বড় গুণ, শুধু নিজের মতো করেই ও ভাবে না। অন্যের চোখ দিয়েও দেখার চেষ্টা করে।’’
আর উনা?
নিউইয়র্কের অভিজাত পরিবারের মেয়ে। সদ্য স্কুল পাস। শহরের বিখ্যাত সব নাইট ক্লাবে অতি চেনা মুখ। দারুণ জনপ্রিয়। মঞ্চে অভিনয়ের হাত পাকাচ্ছেন। সিনেমা করার ইচ্ছে নিয়ে পা রেখেছেন হলিউডে।
তখনই ‘দুজনে দেখা হল’! এবং প্রেমের জোয়ারে ‘ভাসালো’ দোঁহারে!
বাবার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই উনা ঘর বাঁধলেন চার্লির সঙ্গে।
বিবাহিত জীবনে কেমন ছিলেন উনা?
অভিনয়কে কেরিয়ার করবেন বলেই তো চার্লির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া। বিয়ের পর সেই শখের ধারকাছও মাড়ালেন না। বলে নেওয়া ভাল, তিনিই চার্লির একমাত্র স্ত্রী, যিনি কখনও কোনও সিনেমায় অভিনয় করেননি, এমনকী চার্লির সিনেমাতেও নয়। এ নিয়ে দুঃখ ছিল কোনও? তবে শুনুন, কী বলছেন উনা!
চার্লির মৃত্যুর পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি ছিলাম অত্যন্ত সুখী স্ত্রী ও মা। চ্যাপলিনকে নিয়েই ছিল আমার জগৎ। ওকে ছাড়া আমি আর অন্য কিছু কখনই ভাবিনি।’’
প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের দাম্পত্য-জীবন। তার প্রতিটি পল যে সুরে সুরে বাজবে, তা তো হয় না। কত ঝড় এসেছে! ঝাপটা লেগেছে! অশান্তির দুলুনিও। কিন্তু হাজার কিছুর পরেও কখনই চার্লির হাত ছাড়েননি উনা।
এ নিয়ে ছোট বড় মাঝারি ঘটনা জুড়তে জুড়তে যাই। দেখবেন, টালমাটাল পানসি নৌকায় প্রায় লাট খেতে খেতেও দু’জনে কতটা আঁকড়ে ছিলেন দু’জনকে।
বিয়ের কিছুদিন পরের ঘটনা।
চার্লির এক প্রাক্তন বান্ধবী হঠাৎ দাবি করে বসলেন, তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের জনক চার্লি। অভিযোগ অস্বীকার করলেন চার্লি। মানলেন না বান্ধবী। ছুটলেন আদালতে। শুরু হল টানাপোড়েন। শেষে প্রমাণিত হল, চার্লি ওই সন্তানের জনক নন।
এই মামলা নিয়ে উনার উদ্বেগ অন্তহীন! কিন্তু তিনি স্থির নিশ্চিত চার্লি নির্দোষ। প্রতিদিন স্বামীকে সাহস জোগাতেন, ‘‘লড়াই ছেড়ো না। দেখো, ঠিক জয় আসবে।’’
যেদিন, চার্লির পক্ষে আদালতের রায় বেরল, সে দিন রেডিয়ো থেকে খবর পেয়েছিলেন উনা। তাতে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন ক্ষণিকের জন্য। তখন তিনি আবার চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhxmfOFc56jVZW_M_ALS2pdwSNgdR9NeHUhMJBF0Wx9r2r-bduwHmNU3jkmYYS4Ee98qkxhzbD-dHAAqO5BY3ykjcMMNeVOd78_P7LlBfXc_IjY8HHCTgvO4RRtLdwqNreTVT6j59-KRPM/w402-h454/Una+ABC.jpg) |
প্রথম দর্শনেই কেন যে মুগ্ধ ছিলেন চার্লি, বোঝা যায় |
এত তা’ও একরকম।
বড় আকারে ঝাপটা আরও কত!
একবার যেমন। মার্কিন শাসকদের প্রতি আচরণে বিরক্ত হয়ে আমেরিকা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন চার্লি। উনা তখনও স্বামীর পাশে। নির্দ্বিধায় দেশত্যাগী হন তিনিও। কিছুদিন পর মার্কিন নাগরিকত্বও ত্যাগ করেন তিনি।
তারপরের সময়টা তো প্রাণান্তকর।
ছেলেমেয়ে নিয়ে এ হোটেল। সে হোটেল। ভাড়াবাড়ি।
উদভ্রান্ত উদ্বাস্তুর মতো জীবন প্রায়।
বারবার নতুন নতুন জায়গা। সেখানে মানিয়ে নেওয়া। এই সবটা এবড়োখেবড়ো পথে চার্লির পাশে সদা হাস্যময়ী তাঁর সহযোদ্ধা, তাঁর ঘরনী, তাঁর বন্ধু, তাঁর প্রাণাধিকা উনা। এবং উনা।
গভীর অবসাদে আক্রান্ত চার্লির জীবনই বা কম অসহনীয় নাকি! ঘরে চুপটি করে বসে থাকতেন। আর তাঁর পাশে বসে তখন মন ভাল করার নানান মজার মজার গল্প শোনাতেন উনা। এই সাহচর্যই চার্লির মুখে হাসি ফিরিয়ে দিত।
পৃথিবীর সেরাতম প্রেমের উপাখ্যানের থেকে কোনও অংশে কম নয়, উনা-চার্লির ঘননিবিড় দিনলিপি! মৃত্যুর পরেও চার্লির পাশেই থেকে গেলেন তিনি?
এক অমর প্রেম কাব্যের নায়িকা হয়ে!
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhAMvDBnolYgFDYcTyMrO59eZPuVMRvAHhxKeiOr6txW8adCy0mEZkFwREWDe6s_M3oGWldqZxFZSzKMA7skMljUYq4DmbLLpPN21CIjW-AIDJUquFj25JYG0F6OHgFKwv5Df9ffPiX4p0/s320/UNA_Charles_Chaplin_and_Oona_Chaplin_Grave_ABC.jpg) |
আজও তাঁরা পাশাপাশি শয়ান
| |
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
No comments:
Post a Comment