যে মন্দিরের সেবায়েত হলেন বৃহন্নলারাও ৩য় পর্ব
ইতিহাসবিদ, ফরাসি চর্চাকারী ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ
সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে খুলে বসলাম ‘রিসার্চ অন ইয়েলাম্মা’।
এ কী, এ তো চেনা গল্প!
রেণুকা ছিলেন রেণুকা রাজার যজ্ঞাগ্নি (হোমের আগুন) সম্ভূতা কন্যা।
বাল্যকাল থেকেই তিনি কঠোর তপস্বিনী।
পরবর্তীকালে তাঁর বিয়ে হয় কঠোরতপা ও উগ্র ক্রোধী ঋষি জমদগ্নির সাথে।
ঋষি জমদগ্নি ও রেণুকার পাঁচ পুত্র। বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্যনু, বৃত্যকন্দ ও রামভদ্র।
সর্বকনিষ্ঠ রামভদ্র শিব ও পার্বতীর আশীর্বাদধন্য।
তিনি সর্বদা এক মহাকুঠার বা পরশু হাতে বিচরণ করতেন, তাই তাঁর অপর নাম পরশুরাম।
রেণুকা দেবী ছিলেন অখন্ড ধ্যানী।
মুহূর্তের জন্য আপন ধ্যানচ্যুত না হয়ে তিনি প্রতিদিন ভোরবেলা আশ্রমের সন্নিকটে মলপ্রভা নদীতে স্নান করতে যেতেন।
স্নানান্তে আপন শক্তিতে নদীতীরের বালি দিয়ে একটি ঘড়া বানিয়ে সেই ঘড়াভর্তি জল নিয়ে আশ্রমে ফিরতেন। সেই জল দিয়ে ঋষি জমদগ্নি আপন নিত্যকর্ম করতেন।
একদিন সকালে স্নানে গিয়ে রেণুকা দেবী দেখেন এক গন্ধর্বসদৃশ পুরুষ আপন সহচরীদের সাথে নদীতে ক্রীড়ারত।
মুহূর্তের জন্য রেণুকা আত্মবিস্মৃত ও ধ্যানচ্যুত হলেন।
আপন মনের গোপনে কল্পনায় দেখলেন সেই গন্ধর্বসদৃশ পুরুষ তাঁর স্বামী ঋষি জমদগ্নি ও তাঁর সাথে ক্রীড়ারত রেণুকা দেবী স্বয়ং।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ধিক্কার দিলেন নিজেকে।
আপন সুপ্ত কামনায় আজ তিনি জীবনে প্রথমবার ধ্যানচ্যুত। ব্রাত্য।
স্নানান্তে বালি দিয়ে ঘড়া বানালেন। কিন্তু আজ সেই ঘড়া আর জল ধারণ করল না বারংবার প্রয়াসেও। ব্যর্থ মনোরথ রেণুকা আশ্রমে ফিরলেন শূন্য হাতে। যোগ বলে ঋষি আগেই সমস্ত জেনেছিলেন। রেণুকার মুখে বিস্তারিত কাহিনি শুনে তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কঠোরতপা ঋষি জমদগ্নি তপস্যার প্রতীক। সামান্যতম বিচ্যুতিও তাঁর কাছে অমার্জনীয় অপরাধ।
রেণুকা নির্বাসিত হলেন আশ্রম থেকে।
দীর্ঘ ও কঠোর তপস্যায় নিজেকে শুদ্ধ করে রেণুকা ফিরলেন তাঁর স্বামীর আশ্রমে ক্ষমা প্রার্থনায়। কিন্তু ক্রোধী জমদগ্নি রেণুকাকে দেখে জ্বলে উঠলেন।
কঠিন তিরস্কার করে আপন সন্তানদের আদেশ দিলেন আপন মাতার শিরশ্ছেদ করার।
প্রথম চার পুত্র মাতৃবধে অস্বীকৃত হওয়ায় জমদগ্নির অভিশাপ বর্ষিত হয় তাঁদের ওপর, ‘‘নপুংসক হও।’’ তৎক্ষণাৎ তাঁরা নপুংসকের পরিণত হলেন।
কনিষ্ঠ পুত্র পরশুরাম।
তিনি নিষ্ঠার প্রতীক।
পিতার প্রতি নিষ্ঠায় মাতার শিরশ্ছেদ করলেন এবং ক্রোধে প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি পৃথিবী ক্ষত্রিয় শূন্য করবেন। কারণ সমস্ত সর্বনাশের মূল মলপ্রভা নদীতে সেই গন্ধর্বসদৃশ পুরুষ ছিলেন মহিষমতির ক্ষত্রিয় রাজা কার্তবীর্য অর্জুন।
তাঁর কারণেই পরশুরাম আজ মাতৃঘাতী।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjoFlNnildNSd0yiFgScYEoKosJsqrOYSnODEPcrnOl_oLKsMAXpdExweOwRjbQnfvG5JKOZ_3j33SQMuSUbS5F_AvRvFXEWE1CtDPAKXA9QBhAZUtnIXD9_H-_Q44dBzv77dDORtfqyWg/w454-h308/31.jpg) |
শঙ্খমালা গলায় ইয়েলাম্মা ভক্তরা
|
ঋষি রূচিক যোগ প্রভাবে সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে এসে উপস্থিত হলেন।
অতি ক্রোধী পুত্র জমদগ্নিকে তিরস্কার করে তিনি পুত্রবধূ রেণুকাকে পুনরুজ্জীবিত করলেন।
শ্বশুর রুচিককে প্রণাম করে রেণুকা বললেন, যেহেতু স্বামী জমদগ্নি তাঁর প্রাণদণ্ড বিধান করেছেন, সেহেতু ইহজন্মের সকল সম্পর্ক তাঁর শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন তিনি মুক্ত ও স্বাধীন।
আশ্রম ত্যাগ করে তিনি দক্ষিণ দিকে এক অজ্ঞাত দেশে গমন করলেন।
রেণুকার চার নপুংসক পুত্রও তাঁর অনুগমন করল।
কনিষ্ঠ পুত্র পরশুরাম পিতার আদেশে মাতৃঘাতী হওয়ার জ্বালা বুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করতে।
মধ্যরাত অতিক্রান্ত। তারা-ভরতি আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলাম।
ভাবছিলাম, রেণুকা আজ দেবী হয়ে মন্দিরে পূজিতা বিগ্রহ।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjofW_caBTZ006U1TKJTTTFPGs9opdeGGxZSVUJyN2J4VncRG9RusRRAypnpkM8FLljXkBsV3sUCCgiyZMkiIzUNcG2RbC3wcK2u-joByBMtG4Sfluu-0ONcVC1tE8gtj0tdC7057KBwwM/s320/WhatsApp+Image+2020-10-02+at+23.30.14.jpeg) |
মন্দির চত্বরে |
পরশুরাম সুদীর্ঘজীবী। তাঁর উল্লেখ পাই রামায়ণে মহাভারতে।
আজও নাকি অরুণাচলের পরশুরাম কুন্ডে তাঁকে দেখা যায়।
তিনি সময়াচারী। হয়তো আজও ছুটে চলেছেন ভীম কুঠার হাতে মহাকালের মতো।
কিন্তু কার্তবীর্য অর্জুন?
তাঁর কর্মনাশ হয়েছিল?
কর্ম সমাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না?
যদি অন্য কোনও কর্মের ফেরে তাঁর পুনর্জন্ম হয়? এখন এই সময়ে?
বেচারা রাজা!
শেষ
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
No comments:
Post a Comment