দূর্গতিহারিণী - সব কৃষ্ণভক্তই একটু দুষ্টু-দুষ্টু হয় বললেন পার্বতী দাস বাউল ১ম পর্ব - দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়



 পার্বতী দাস বাউল 
বললেন 
সব কৃষ্ণভক্তই একটু দুষ্টু-দুষ্টু হয়  ১ম পর্ব

দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
সাংবাদিক
সামনে সাদা-গেরুয়া-বসনা। জটাধারিণী। ব্রহ্মাণ্ড ছানবিন করে বেড়ানো বাউল। আর তাঁকেই কিনা একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছি— ‘শুনেছি খুব রেডিয়ো-ভক্ত ছিলেন! তো, বিবিধ ভারতী, অনুরোধের আসর শুনতেন? আশা, লতা, মুকেশ, রফি, কিশোর?’ ‘সিনেমা দেখেন নাকি প্রচণ্ড। আপনার কিশোরীবেলায় ‘শোলে’ তো মেগা হিট! দেখেছেন?’ ‘চাটগাঁ-র বাঙালি। কোচবিহারে বড় হলেন। জীবন-সঙ্গী কেরলের। সব মেছো-এলাকা। বাউল হলেও আপনিও নির্ঘাৎ মৎস্য-প্রিয়?’ তিনি পার্বতী দাস বাউল। সময়টা ২০১৭। নভেম্বর, কী ডিসেম্বর। আজ তার প্রায় বছর দুই পেরিয়ে তিন-এ পড়তে চলল। ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের দেড় দিনও তখন কাটেনি। তার মধ্যেই অমন বাচাল-সাংবাদিকী ঢং, ইদানীং কেমন সিঁটিয়ে দেয়। তার চেয়েও নাড়িয়ে যায় অত চড়া ‘বাজারি’ প্রশ্নের মুখে ওঁর সেদিনের দেহভঙ্গী, সওয়াল-জবাবের তাল-লয়-ফাঁক খুঁজে নেওয়ার অনায়াস তরিকা! এ ঘটনার আবার একটা মুখরা আছে। যার আলাপটুকু শুনলে ওই বাচাল-পনার ধরনে পাঠক যে আরওই অবাক হবেন, তাতেও ন্যানো-ইঞ্চি বিস্ময় নেই। আড়াই বছর ধরে ওঁর ‘এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ’-এর তাল ঠুকছি তখন। সব ক’টা সোর্স ডাহা ফেল। তার ওপর পার্বতী ‘গেছো দাদা’র চেয়েও বেশি বেশি করে হাওয়ায় মেলানো প্রায় অদৃশ্য-জীবী। আজ লাটভিয়া, তো পরশু লাক্ষাদ্বীপ, তরশু লাসভেগাস। সঙ্গে এও শুনতাম, ভীষণ মুডি, চুজি। সাংবাদিক শুনলেই ‘অ্যাবাউট টার্ন’। তো, সে বার কলকাতায় ওঁর শো। পরদিনই ছুটবেন শান্তিনিকেতন। কামারডাঙা। ওখানে ওঁর নতুন আশ্রম হচ্ছে। ‘সনাতন সিদ্ধাশ্রম’। তারই দেখভাল করতে। সফর-সঙ্গী হওয়ার ব্লু-প্রিন্টটা বানিয়ে দিল কলকাতায় সেই শো-এর আয়োজক আমারই এক বন্ধুজন, পার্বতী-ঘনিষ্ঠ নট-নির্দেশক-অভিনেতা মণীশ মিত্র। পরদিন ভোর। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। কোচ সি-ওয়ান। কামরায় ঢোকামাত্র দেখি জনা দশ-বারো নানা ভাষাভাষীর মধ্যমণি হয়ে বসা তাঁদের পার্বতী-মা। একটু পরেই এই দলের অন্যদের সঙ্গে আলাপ হবে। অর্পিতা, আরতি, সাকুরা, স্যামুয়েল, গ্রেস, রাম। একজনও বাঙালি নন। কেউ জাপানী, কেউ ফ্রান্সের, কেউ বেঙ্গালুরু-বাসী, তো কেউ রায়পুরের। সবাই হাত দশ-বারো দূরত্বে। নিজেকে কেমন ফেলুদা-ফেলুদা টাইপ লাগছিল! ট্রেনটা রাজস্থানগামী নয়। ওদিকে কোনও ‘মুকুল’, ‘ড. হাজরা’ বা ‘মন্দার বোস’ নেই, তবু একটা চাপা রহস্য, আড়াল খুঁজে নজর রাখা, ট্রেন-কামরায় তাল বুঝে আলাপ করা, তারপর বহু দিনের না-পারার রহস্যভেদ করতে চাওয়া, সবটা মিলে...। ও দিকে নরম হাসি, হালকা গল্পের ইঙ্গিত পেতেই উঠে গিয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে ভিজিটিং কার্ডটা হাতে দিয়ে আবদার করলাম, ‘যদি অনুমতি মেলে আপনার শান্তিনিকেতনের প্রজেক্টটা দেখতে চাই।’’
পুকুর ধারে সেই প্রথম বারের সাক্ষাৎকার

ভাবলেশহীন মুখ। হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। ভ্যাবলা বনে ফিরে সিটে বসে ‘হোম ওয়ার্ক’-এ মন দিলাম। সম্বল বলতে টুকটাক নোট্স আর পার্বতীরই লেখা ‘সং অব দ্য গ্রেট সোল’ নামের একটা ফালি বই। শিকে ছিঁড়লে এই হোমওয়ার্কটুকুই যা সম্বল। ততক্ষণে ফর্দ করে ফেলেছি। আদি নাম মৌসুমী। মৌসুমী পাড়িয়াল। পড়াশুনোর শুরু কোচবিহার। বাবা বীরেন্দ্রনাথ পাড়িয়াল। রেল-চাকুরে ছিলেন। এখন বারাসাতে। বয়স যখন পনেরো, তখনই পাকেচক্রে মৌসুমীর প্রেম বাউলে। কোচবিহারেরই ইন্দিরা দেবী-তে প্রাইমারি শেষে, সুনীতি একাডেমিতে ইস্কুলবেলা কাটিয়ে বিশ্বভারতী। ট্রেনে চেপে দাদার সঙ্গে যাচ্ছিলেন শান্তিনিকেতন। তখনই এক অন্ধ বাউলের গান ওঁকে পাকড়ে ফেলে। এরপরই গুরু-মা পান ফুলমালা দাসীকে। একতারা শেখেন। সেখান থেকে বাঁকুড়ায় সনাতন দাস বাউল। তারপর শশাঙ্ক গোঁসাই। ট্রেন-সফরে আর কথা হল না। স্টেশনে নেমে দেখি, ডেকে নিলেন নিজের টোটো-য়। সেই যে চাকা ঘুরল, সে চাকার ‘গড়ান’ আজও চলেছে তরতরিয়ে। শান্তিনিকেতনের ওই দিন দুই-এর বাস থেকে আজ এই দেড় দুই বছর। কত ভাবে দেখলাম ওঁকে! মঞ্চে, মঞ্চের বাইরে।

 
'কত ডাক জানে যে পাখিটা'

নিমীলিত চোখের কিন্নরী যখন একতারা আর ডুগিতে হাত রেখে গলায় ধরেন, ‘গোরা যদি হইত আমার কুমকুম চন্দন, আমি অঙ্গেতে মাখি, আমি গৌ-উ-র-র বলে ডাকি’, তখন ঘোর আস্তিকেরও আধিদৈবিক লাগে। নীল চাঁদোয়ায় নীচে দোল খাওয়া রোদের খেলায় আলোছায়ার মায়ায় যখন চোখ মেলেন তিনি, কী চকর পাখির ডাকে অস্ফুটে বলে ওঠেন, ‘‘কত ডাক জানে যে পাখিটা!,’’ আলের ধারে শ্বেত আকন্দ খুঁজে পেয়ে বিড়বিড়িয়ে ওঠেন, ‘‘ব্যথা কমাতে খুব কাজে লাগে গাছটা’’, তখন যে দরদিয়া সুর ভাসে ওঁর ঠোঁটে, চোখের তারায়, তার কোনও স্বরলিপি হয় না! আবার কোনও সময় সেই একই মানবী রসিক চঞ্চলা দুষ্টু কিশোরী যেন! যে নির্দ্বিধায় উছলে ওঠে বলে, ‘‘সব কৃষ্ণভক্তই একটু দুষ্টু-দুষ্টু হয়!’’ আবার সন্তান-হারা দম্পতির আবাসে বসে প্রবল জ্বরে পুড়তে পুড়তে ওঁকে যখন গাইতে দেখেছি, তখন ওঁর রূপ যেন আদিগন্ত বিস্তৃত কোল-পেতে রাখা কোনও এক বিশ্বমায়ের! আর আন্তর্জাতিক রেসিডেন্সিয়াল ওয়ার্কশপ, কী সেমিনারে? সে এক অন্য পার্বতী দাস বাউল। স্বভাব-শীতল শান্তস্নিগ্ধ ধারাটি বজায় রেখে দশ-দিক হাতের তালুর মধ্যে রাখা এক-আকাশ ছড়ানো হৃদ-ছোঁওয়া নেত্রী! ফিরে যাই সেই সেদিনের আড্ডায়।


'কিছুদিন মনে মনে'

 কামারডাঙা। এবড়োখেবড়ো মাটির পুকুর-ধার। ঢালু ঘাস জমিতে বসেছি তিনজনে। আমি, পার্বতী আর ওঁর আপ্ত-সহায়ক রামচন্দ্র রাও রোড্ডাম, ওরফে রাম। রেকর্ডার অন। আড়াই বছরের প্রতীক্ষার উদযাপন। কানে বাজছে ওঁরই গান, ‘কিছুদিন মনে মনে...’।

 —বিশ্বভারতী-তে পড়তে গিয়ে বাউল হলেন! বাবা-মা আপত্তি করেননি?
—মা নয়। বাবা করেছিলেন।
—মারধোর? 


 ছবিঃ প্রতিবেদক ও আরতি 



 (যে কথা না বললেই নয়ঃ পার্বতী বাউলকে নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা আমি আগে লিখেছি। তবু প্রতিবারই নতুন করে লিখতে গিয়ে মনে হয়, মানুষটিকে চেনা ঘটনার মধ্যেও অন্য ভাবে আবিষ্কার করছি। ২০১৯ সালে ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ একটি লেখা চায়। তখন যে লেখাটি লিখি তাকেই অল্প পরিমার্জন করে এখানে রাখছি, আমাদের ‘আর্কাইভ’ চিন্তাটির কথা মাথায় রেখে— লেখক) 
 

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

No comments:

Post a Comment