দূর্গতিহারিণী - ইস্কুলে অঙ্ক ছাড়া সব ভাল্লাগতো বললেন পার্বতী বাউল ২য় পর্ব - দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়


পার্বতী দাস বাউল 
বললেন ইস্কুলে অঙ্ক ছাড়া সব ভাল্লাগতো
 ২য় পর্ব

দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
সাংবাদিক
পাগলা ঝড়ের হাওয়ায় যেন দু’পাশে দুলে উঠল ঝাঁকড়া-চুলো জটা, ‘‘বাবা কোনওদিন কাউকে মারেননি। মা’ও না। মা শুধু একবার হোমওয়ার্ক করিনি বলে অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাবাকে তো কাউকে জোরে বকা দিতেও দেখিনি। একবারই শুধু বকে ছিলেন, আমাদের হইচই-এর ঠেলায় ঘুম আসছিল না, তাই। আর বাউল হব শুনে বাবা খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। বাবার কোনও ধারণাই ছিল না বাউল নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে চলে আসা মানুষ। তারপর অসম। আমাদের বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা আসতেন। সে সব দিকে গেলে হয়তো অসুবিধে হত না। কিন্তু বাউল? একদম অচেনা, অজানা। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। বাবা আমার কাছে বাউল গান শিখেছেন। একতারাও শিখেছেন। এখন অবশ্য অ্যালঝাইমার হয়ে গিয়েছে। বয়সটাও তো হল। পঁচাশি পেরিয়েছে।’’ —এই পাড়িয়াল পদবিটা ঠিক কোথাকার? —চট্টগ্রামের। আসলে গাঙ্গুলী। পাড়িয়ালদের একটা গুষ্টি আছে ওখানে। পার্বতীর এক দাদা। তিন বোন। দাদা থাকেন দুবাই। ইঞ্জিনিয়র। দুই দিদি। একজন কোচবিহারে। ইস্কুলে পড়ান। অন্যজন কলকাতায়। ঘরণী। —যেতে পারেন বাবা-মায়ের কাছে? —যাই তো! বেশি থাকতে পারি না। —তখন বাউলের আচার-রীতি মানতে অসুবিধে হয় না? —না, না। আসলে আমার মা খুব ভক্ত মানুষ। শুধু মায়ের কাছে কেন, কেরলে যখন থাকি, তখনও নিয়ম মানি। কমবেশি সব জায়গাতেই তাই। হয়তো নিজে রান্নাবান্না করে খাওয়াটা হয় না। মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্টেও খেতে হয়। কী করব! অনেকে আবার নিরামিষ রান্না করে আনে। —নিরামিষটা নিশ্চই ছোট্ট থেকে নয়! —আরে, না না। আমি বাঙালি তো! তবে বাউলরা কিন্তু মাছ খায়। আমি মাছ ছেড়েছি ২০০৭, কী ২০০৮-এ। —কোচবিহারের ছোটবেলা, মনে পড়ে?
বাবা খুব এস ডি বর্মনের ভক্ত ছিলেন
—রাজবাড়ির পাশে থাকতাম। যার কাছেই ছিল ‘নরনারায়ণ ব্যায়ামাগার’। ওখানে লোকে কুস্তি শিখত। বালির মধ্যে। ইয়া তাগড়াই সব চেহারা। ওরা ছাতু খেত। মুগুর ভাঁজত। ভোরবেলা। আমি দেখতাম। কত বন্ধুর কথা মনে পড়ে। স্কুল... —পড়তে ভাল্লাগতো? —হ্যাঁ-এ-এ। অঙ্কটা ছাড়া সব। (ছলছলিয়ে উঠল হাসি) কেমিস্ট্রির এক্সপেরিমেন্ট করতে খুব মজা লাগত। একবার ঠিক করলাম, কী করে জল ভেঙে হাইড্রোজেন পাওয়া যায়, দেখব। সে কী কাণ্ড! (কলকল হাসিতে পাহাড়ী ঝোরা যেন লাফিয়ে উঠল লালমাটির দেশে) তবে ইস্কুলে বেশি করেছি নাচগান। টিচাররা ‘ছাড়’ও দিতেন তাতে। —বাব্বা! তাই? —হ্যাঁ। আসলে কোচবিহার জায়গাটাই এমন যে, ওখানে শিল্প, মানে আর্ট খুব গুরুত্ব পায়। আমিই দেখুন না, ছোটবেলায় কত্থক শিখেছি, রীতিমতো গুরুর বাড়িতে থেকে। যে জন্য প্রতি মাসে ইস্কুলে আমার দশটা দিন ‘অফ’ হয়ে যেত। সেটা বাবা-ই পারমিশন করিয়ে নিয়েছিলেন স্কুল থেকে। বাবা টিচারদের বলে রেখেছিলেন, খুব ইম্পর্টেন্ট ক্লাস না থাকলে আমি যেন ‘লিবার্টি’ পাই। তখন আমি ইস্কুলেরই ওপরতলার কোনও ঘরে গিয়ে নাচ প্র্যাকটিস করতাম। —আপনার বাবা তো শুনেছি, গান-পাগল। দুর্ধর্ষ সব লং-প্লেইংয়ের স্টক আপনাদের বাড়িতে। কলকাতা থেকে সব নিয়ে যেতেন আপনার বাবা। —হুম। ঠিক। বাবা রেডিয়োয় গানও শুনতেন খুব। —আপনি? বিবিধ ভারতী, অনুরোধের আসর... —শুনতাম। তবে হিন্দি গানটা শোনার অনুমতি ছিল না। —সে কী! আপনার কৈশোরবেলা মানে তো, রফি-কিশোর-মুকেশ-লতা-আশা... —তা’ও না। —শচীন কর্তা? এবারে ভীষণ উত্তেজিত, ‘‘ইয়েস। ইয়েস। বাবা এসডি বর্মনের খুব ভক্ত ছিলেন। ওঁর গানের স্টক খুব বেশি আমাদের বাড়িতে। বাবা অবশ্য ওস্তাদ আমির খানের গানও খুব ভালবাসতেন। আর বেগম আখতার...’’ —কোনওদিন আক্তরি বাঈয়ের ‘পিয়া ভোলো অভিমান’ ট্রাই করেছেন?
মাঝে মাঝে ধরতাই দিচ্ছিলেন রাম
চকিতে চাইলেন। মুড়নো ঠোঁটটা দাঁতে কেটে বললেন, ‘‘করেছি। হয়নি। আসলে ও গান কারও গলায় হওয়ার নয়।’’ তারপর নিজের থেকেই বললেন, ‘‘ভাওয়াইয়া খুব ভালবাসতাম। কোচবিহারের ঢোলও। ছুটে ছুটে নদীর কাছে চলে যেতাম। মাঝিদের সঙ্গে নৌকায় উঠে পড়তাম। সারিন্দা বাজানো দেখে মন জুড়িয়ে যেত।’’ —এ তো খুব সিরিয়াস-সিরিয়াস ব্যাপার-স্যাপার! অন্তত বয়সের তুলনায়। সিনেমা দেখতেন না? তখন তো ‘শোলে’ সুপারডুপার হিট? অমিতাভ-ধর্মেন্দ্র-হেমা-আমজাদ... —না। (শিশুসুলভ চপলতা খেলে গেল মুখের রেখায়) তবে এখন ফ্লাইটে সব সময় খুব সিনেমা দেখি। (এ বার রামের দিকে তাকিয়ে) তাতে রাম আবার খুব রেগে যায়। (এতক্ষণ শান্ত হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা রাম এবার কথার পাকে নিজের নামটা শুনে চমকে তাকালেন। তারপর ইংরেজি তর্জমা করে দিতে হাসলেন মৃদু। বলে চললেন পাবর্তী) এই তো কিছুদিন আগে গুরিন্দার চাড্ডার একটা সিনেমা দেখলাম, ‘পার্টিশন’। দুর্ধর্ষ লাগল। দিনের আলো মুড়িয়ে এসেছে প্রায়। পুকুর-জলে বিলি কাটছে কালো কালো গাছের ছায়া। পিছনে চাষজমিতে নুয়ে পড়েছে শেষ-বিকেলের আলো। একটু দূরেই খড়ের ছাউনিওয়ালা গোলঘর। যার চাতালে বসে দুপুরের খাওয়া সেরেছি সবাই। এখান থেকে ওদিকটা এখন ছায়া-ছায়া। কত কত পাখির কূলায় ফেরার ডাক, নাকি আজান দিচ্ছে ওরা! গান ভেসে আসছে হাওয়ার গা বেয়ে বেয়ে, ‘ও-ও বন্ধু প্রাণসখা এমন দিনে পাই যেন তব দেখা’। বললাম, ‘আপনার গুরুরা, ফুলমালা দাসী, সনাতনবাবা, শশাঙ্কদাস বাউল...?’’ —সবারই সমাধি হয়েছে। —ও! আ্চ্ছা, এই ‘সমাধি’ হওয়ার ব্যাপারটা একটু বলবেন? আঁধার-আলো পিছলে যাচ্ছে পার্বতীর মুখে। বলতে লাগলেন, ‘‘আসলে সত্যিকারের সাধক যাঁরা, তাঁরা পরমাত্মায় লীন হন। তাঁদের দাহ করা হয় না। তাঁদের সাধনার সারবস্তু, যে প্রাণিত শক্তি, সেটা সকলের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সমাধি মাটিতেও হতে পারে। আবার জলেও।’’
‘যে জন পদ্ম হেম সরোবরে যায়’
হঠাৎ কেমন থম মেরে যাওয়া আশপাশে প্রায় নিঝুম স্তব্ধতা। তারই ছেঁড়া-ছেঁড়া ফাঁক গলে শুধু ফিকে হওয়া গানের তান, শোঁ শোঁ হাওয়ার ছড়-টান শব্দ, পুকুরের লাবডুব শুধু। কী যেন খেয়ালে আবারই বাচালপনায় পেল। বললাম, ‘একটা সত্যি কথা বলুন তো। এই যে বাউল চর্চা নিয়ে সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন, এত কিছু করছেন, তাতে সাধারণ মানুষের কী এল গেল? তারা গান শুনবেন। বিগলিত হবেন। ব্যস। তারপর?’ আবছায়া সন্ধেয় এক ঈশ্বরী যেন এবার তাঁর ভাব-কাহন, তাঁর মন-গহন, তাঁর আঁকাবাঁকা, এলোমেলো আদি-অনন্তের গুহায় কয়েক পা হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেন আমায়। চরাচরে মায়াস্রোত! আকিঞ্চন সবটা জুড়ে। ডুবসাগরে এক তাপসী উঠে এসেছেন ধরাধামে বুঝি! বলে চললেন তিনি, ‘‘এ প্রশ্ন আজকে দাঁড়িয়ে বড় প্রাসঙ্গিক। বাউলের যে জীবন চর্চা, তা যদি কোনও মানুষ নেয়, সত্যি করেই সে উন্নত হয়ে যাবে। চৈতন্যদেবের আটটি শ্লোক আছে, পড়ে দেখবেন। আমি যখন শশাঙ্কবাবার বাড়ি প্রথম যাই, উনি যে খাতাটা খুলে দেন, তাতে চারটি শ্লোক ছিল। জীবনের মূল কথা ওগুলোই। ঘাসের চেয়েও বিনম্র হতে হবে। সহিষ্ণু হতে হবে। সবাইকে শ্রদ্ধা করতে হবে। শুধু মানুষ নয়, পোকাকেও। মুখে সব সময় হরিনাম রাখতে হবে। ওই নামের মধ্যেই শক্তি আছে। রামকৃষ্ণদেব বলতেন না, যেমন ভাব, তেমনই লাভ, সেটাই। বৈভব, ঐশ্বর্য যা কিছুর জন্য মানুষ ছুটে বেড়ায়, সেগুলো আজ আছে, কাল নেই। এর সঙ্গে একটা কথা, পৃথিবী, জগৎ, প্রকৃতি এই সব কিছুর মধ্যে একটা ক্ল্যারিটি থাকা দরকার। বাউল-জীবনচর্চা এটাই শেখায়।’’ থামলেন তিনি। জীবনও থেমে আছে যেন, এক টুকরো জমিতে! ও ধারে গোলঘরে গান বদলে গিয়েছে। একতারায় টংটংটংটং-এ কেমন ঝিমুনি-ধরা ভাব! কে বেশ গাইছে— ‘যে জন পদ্ম হেম সরোবরে যায়...’ ছবিঃ প্রতিবেদক ও আরতি ​ ১ম পর্বে যেতে হলে এই বাক্যটিতে ক্লিক করুন (যে কথা না বললেই নয়ঃ পার্বতী বাউলকে নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা আমি আগে লিখেছি। তবু প্রতিবারই নতুন করে লিখতে গিয়ে মনে হয়, মানুষটিকে চেনা ঘটনার মধ্যেও অন্য ভাবে আবিষ্কার করছি। ২০১৯ সালে ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ একটি লেখা চায়। তখন যে লেখাটি লিখি তাকেই অল্প পরিমার্জন করে এখানে রাখছি, আমাদের ‘আর্কাইভ’ চিন্তাটির কথা মাথায় রেখে— লেখক)
 

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

No comments:

Post a Comment