দূর্গতিহারিণী - ওই বইগুলোর গায়ে মায়ের গন্ধ পাই পর্ব১ - অনুরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়



ওই বইগুলোর গায়ে মায়ের গন্ধ পাই পর্ব ১

অনুরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়
সঙ্গীতশিক্ষক
 
গানেরও যে একটা গন্ধ আছে, তা আমি প্রথম বুঝতে পারি আমার মায়ের কাছে! না, মা কোনওদিন বলেনি। কিন্তু না বলেও তো কথা বিলোনো যায়! ইদানীং মাঝে মাঝেই ভাবি, আমার আশৈশব জমিয়ে রাখা গানের চটি চটি বইগুলো, তার মলিন অক্ষর, তার ঝুরঝুরে পাতার গায়ে মায়ের সেই না-বলা কথাগুলো কি লুকিয়ে আছে? নইলে এত মায়া কেন ওদের ওপর! কেন এই ষাট পেরনো বুড়োবেলাতেও কিছুতেই ওদের কাছছাড়া করতে পারি না। বরং বন্ধ বাক্সের ডালা খুলে নির্জীব ওই আদুল গা গুলোয় হাত বুলিয়ে, বিলি কেটে আবার শুইয়ে রাখি আদর করে! অবচেতনে বোধহয় একটা বোধ কাজ করে! চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া আমার মায়ের স্পর্শও বুঝি লেগে আছে ওখানে, ওই ক্ষয়াটে জীর্ণ শীর্ণকায় অবলা পুঁথির শুয়ে থাকা শরীরে। ওদের সরিয়ে দেওয়া মানে তো, আমার ‘তারা’ হয়ে যাওয়া মাকে আরও আরও আলোকবর্ষ দূরে হটিয়ে দেওয়া!সেন্ট মার্গারেট স্কুলে পড়তে পড়তে মা গান শিখত সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত সঙ্গীতসাধক সত্যবাবু। না, একা একা নয়, দলে দলে গান শেখাতেন মাস্টারমশাই। আসতেন ইস্কুলে। হা, পোড়া কপাল! সে শেখা আর বেশি দূর গড়ায়নি! কে জানে কেন? কিন্তু গান তো রয়ে গিয়েছিল প্রাণে।
বিয়ে হয়ে গেল মায়ের
কুড়ি ডিঙোনোর আগেই বিয়ে হল। কোলে দিদি এল। তারপর আমি। আমার পরে ভাই। বাবা সরকারি চাকুরে। কতটুকুই বা সম্বল! অথচ তখন থেকেই আমাদের ৪৮বি পাইকপাড়া সেকেন্ড রো-এর বাড়িতে গান সবসময় ভুর ভুর করত। দাদু ক্লাসিকাল জানতেন। নানা রকমের বাজনা বাজাতে পারতেন। ক’দিন আগে ছাদ-ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে দাদুর পুরনো এসরাজটা খুঁজে পেলাম। দাদুর কাছে বেহালায় সরগম শিখে বাবা এমন ছড়ের টান লাগাতো, সুরের পাকানো নেশা তখন পাশের জ‌নের বুক আকুল করে চোখের পাতায় নরম ঘোর ছড়িয়ে দিত। ছোট্ট থেকে দেখছি, আমার মেজকাকার হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়ার কোনও সময়-অসময় নেই। যখন তখন মেজকা বসে, গায়...‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’, ‘মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে...’। পড়ার বই-এ চোখ রেখে আমি তখন রবীন মজুমদার কী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সুরের আত্মায় জুড়ে যেতাম। ছোট পিসি গিটার শিখত। বড় পিসির তালিম দিতে বাড়িতে আসতেন আরেক বড় সাধক। কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়। আর মা-কে দেখতাম, এপাশ ওপাশ ঘুরতে ফিরতে কেবলই গান গায়। ততদিনে আমারও ভেতরে গুনগুন গুনগুন। তখন কত্তোটুকু! তাতেও। মনে আছে, সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুলে আমি তখন কেজি-টু, কী কেজি ওয়ান। একটা প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সেরিমনি। দিদিমণি ডেকে বললেন, ‘‘তুমি গান জানো?’’ পড়াং করে ঘাড় কাত করে সুর টেনে বললাম, ‘হ্যাঁ-এ-এ।’ ‘গাও তো দেখি!’ গাইলাম, ‘যদি আকাশ হত আঁখি, আমি হতেম রাতের পাখি’। দিদিমণি তো হাঁ। ওইটুকুনি মেয়ে ‘আরতি মুখোপাধ্যায়’! তা’ও কিনা এই গান! সাত তাড়াতাড়ি আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘আর কী জানো?’’ এবার গাইলাম, ‘একবার বিদায় দে মা...’। তখন ‘ছাড়’। স্টেজে উঠিয়ে গাইতে দেওয়া হল। এদিকে ইস্কুলে নিতে এসে আমার মা তার মেয়ের গলা মাইকে শুনে তাজ্জব হয়নি কিন্তু। বরং ‘এই-ই তো হওয়ার কথা, এমনটাই তো স্বাভাবিক’, এটা মনে মনে বলে বোধহয় আহ্লাদই পেয়েছিল।
মেজকাকা তবলায়, বেহালায় বাবা, পিছনে দাদু, তানপুরায় বড় পিসি
ক্লাস ফাইভে উঠতে একদিন টগবগিয়ে বাড়ি ফিরে মা বলল, ‘‘শোন, তোকে ‘সুরসুন্দর’-এ ভর্তি করে দেব। ওখানে গোরাচাঁদ মুখোপাধ্যায় গান শেখান।’’ সুরসুন্দর। গানের ইস্কুল। হলাম ভর্তি। এক বছর কি দেড় বছর। দাদু আপত্তি করে বসলেন। ওই অত্তটুকু মেয়ে আধুনিক গান! বন্ধ করো। ব্যস, হয়ে গেল সুর-শিক্ষার ইতি। এরপর আবার খোঁজ। খোঁজ। খোঁজ। মাস্টারমশাইয়ের খোঁজ! তখন কে জানত, এই ‘খোঁজ’ শব্দটাই আমার গান-জীবনের ‘পাসওয়ার্ড’ হয়ে যাবে! এর মধ্যে বছর কয়েক কেটে গিয়েছে। আর তার মাঝেই, একজন মা তার গানের বীজমন্ত্র ঢেলে দেওয়ার কাজটা জারি রাখছে, তার কিশোরী মেয়েটার জন্য। সরগম-এর ‘নেশা’ তখন কেমন গোল্লাছুটের মতো চরকি-পাক খাওয়াচ্ছে আমায়। দাদুর একটা রেডিয়ো ছিল। ইলেকট্রিক রেডিয়ো। ঘরের ভেতর তার তারজালির অ্যান্টেনা। সক্কালবেলা আকাশবাণী-র ‘পোঁ’ ‘পোঁ’ আওয়াজ থেকে সে রেডিয়োর ঘুম ভাঙে। দাদুর খেয়ালে তার থেকে কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত বেরয়। খবর হয়। কৃষিকথার আসর বাজে। মহিলামহল, নাটক, অনুরোধের আসর হয়। আর পাশের ঘরে বসে, দাঁড়িয়ে আমি শুনি। ফাঁক পেলেই। হাত-বাড়ানো দূরে ভোম্বলদা-জহরদার বাড়িতে ‘মনের মতো গান’ বাজে। জানলায় বসে গানের লাইন টুকি আমি। মা হঠাৎ আবার একটা কান্ড করে বসল। খুঁজে পেতে সেই-ই সত্যকিঙ্করবাবুর কাছে গিয়ে আবদার করল, ‘‘আপনি আমাকে ইস্কুলে গান শিখিয়েছেন। এখন আমার মেয়েকে যদি শেখান মাস্টারমশাই!’’
গুরু যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সেদিনের লিখে দেওয়া 
আমি আবার ‘গুরু’ পেলাম। সে সুখ সইলে তো! বছর দেড়েক গেল না, গুরুজি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বদলে ওঁর সেজ ছেলে। নীহাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তা’ও ক’টা মাস। আবার নতুন পাঠশালা। শ্যামপুকুরে অঞ্জলি সুর তখন তাঁর বাপের বাড়িতে গান শেখান। ভরতি হলাম। ইস্কুল ফেরতা গানের ক্লাস সেরে তবে বাড়ি। অঞ্জলিদি ছিলেন চিন্ময় লাহিড়ীর ছাত্রী। সেখানেও ইতি হল। সেখান থেকে আবার মস্ত গুরু। যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়। আমহার্স্ট স্ট্রিটে সিটি কলেজের কাছে ১৯ নম্বর বলাই সিংহ লেন। আমার নতুন ‘গুরু’র বসতবাড়ি। শুরু হল যাতায়াত। টানা ছ’মাস। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। বসে আছি, তো বসেই আছি। গুরুজি গান শেখান না আর কিছুতেই। আজ বুঝি, উনি তখন আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। ধৈর্যের পরীক্ষা। স্থৈর্যের পরীক্ষা। সময় দিচ্ছিলেন ‘কান’ তৈরির। কানের সঙ্গে প্রাণের সেতু বাঁধারও। ছ’মাস বাদে গুরুজি বললেন, ‘‘দাও দিকি, খাতাটা দাও।’’ গান লিখে দিলে‌ন তাতে। রাগ বিভাস। ‘গাগরি ছি ন লিনি, অব মোহে প্যারে’। এ দিকে বাবার বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত গাইয়ে সুকুমার মিত্র। উনি থাকতেন মানিকতলার কাছে। বাবার অনুরোধে তিনিও তালিম দিতে লাগলেন। লঘু সঙ্গীতের।
গুরু সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 
সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছবিঃ লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে অনুচিত্রণঃ পরিচিতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রাফিক্সঃ জয়দীপ সেন মডেলঃ অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
পরের অংশ ২য় পর্বে

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

No comments:

Post a Comment