|
হাবুলদা (তপন দে) আর আমায় নিয়ে গুরুজি যামিনী গঙ্গোপাধ্যায় |
মায়ের শরীরটা সরগম হয়ে যেন ছড়িয়ে গিয়েছে আমার মধ্যে পর্ব ২
সঙ্গীতশিক্ষক
বড় হতে লাগলাম আমি।
তার মধ্যে অনেক কিছুই ঘটতে লাগল।
আমার একটা ছোট্ট তানপুরা হল। দাদু বেঁধে দিল। গাইতে বসলে মা’ও বেঁধে দিত মাঝে মাঝে। সুর লাগাতে বসে দেখতাম, একটু এদিকে ওদিক হলে মা ছুটে ছুটে আসে রান্না ফেলে—‘‘উঁহু, ঠিক হচ্ছে না রানু (আমার ডাকনাম)। এরম কর। এরম কর,’’ বলে সুর, ফাঁক, তাল ধরিয়ে দেয়।
ছোট পিসি গিটার বাজাত। মাস্টারমশাই আসতেন। কী যেন নাম ছিল তাঁর? অমর লাহা! ছোট পিসির গানের গলাটাও বেশ। ছোট পিসির অনেক গানের বই ছিল। পাতলা-পাতলা। চটি চটি। মায়েরও ছিল। একটু চোখকান ফুটতেই সেগুলো দেখার ‘লাইসেন্স’ পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। কত বই! সব গানের। আধুনিক গানের। সিনেমার গানের। বাংলা গান, হিন্দি গান, সব। এমনকী এইচএমভি থেকে পুজোর সময় বেরনো শারদ অর্ঘ্য-ও।
|
মাঝে দিদি, সামনে আমি আর ভাই |
আমি তখন ডাফ স্কুলে। মা আনতে যেত ছুটির সময়। পাইকপাড়ায় যেতে-আসতে তখন দু’টো মাত্র বাস। ৩৩ আর ২ নম্বর। মেট্রোর কাজের জন্য ২-এর রুট ঘুরে শেষে বাসের সংখ্যা একটায় এসে ঠেকল। সার্কুলার রোড থেকে বাসে উঠতাম। ফড়েপুকুর পেরিয়ে। তার আগে প্রায় দিনই, অরফ্যান টি হাউস, নয় দত্ত বেকারি-র সামনের ফুটে সার সার গানের বই দেখে দাঁড়িয়ে পড়তাম মা আর বেটিতে। দু রকমের বই থাকত সেখানে। একটা ছিল ৬০ পয়সা কী বারো আনা দামের। অন্যটা আরেকটু দামি। সে গুলো চকচকে। কোনওটাই হয়তো রোজ-রোজ কেনার পয়সা নেই। কিন্তু ঘেঁটে দেখতে দোষ কী! রাধা, শ্রী, উত্তরা, দর্পনা, মিত্রা বা শ্রী-তে সিনেমা দেখতে গিয়েও এক দশা। সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার আগে গানের বই কেনা!
পুজো এলেই মন আকুলিবিকুলি। নতুন জামা তো হবেই। কিন্তু সেটা আদ্দেক আনন্দ। পুজো মানেই ক’দিন বাদেই ‘শারদ অর্ঘ্য’। আর নতুন গানের রেকর্ড বাড়িতে আসা। হরলালকা বা কমলালয় থেকে জামা কিনে ‘সি সি সাহা’র রেকর্ডের দোকান না যাওয়া অবধি সবটাই কেমন আলুনি-আলুনি। মেজকাকার একটা গ্রামাফোন রেকর্ড ছিল। সবজেটে রেকসিনে মোড়া। সেখানে নতুন রেকর্ড চালিয়ে গান শোনা, আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তেপান্তর পেরনোর সুখ পেতাম!
ততদিন যামিনী গাঙ্গুলি পর্বও শেষ। সুকুমার মিত্র তখন আর এ পৃথিবীতেই নেই।
আবার খোঁজ। এবার নাগেরবাজারে। মঞ্জুশ্রী ভট্টাচার্য। ক’মাস পরে সেখানেও তাই।
|
এখন আমার গুরু এবং ‘দিদি’ রাজ্যশ্রী ঘোষ |
ক্লাস সেভেন, কী এইট। মনে আছে, মায়ের কাছে শিখেছিলাম, ‘হরিনাম লিখে দিয়ো অঙ্গে’! কী ভাল গাইত মা। গল্প শুনেছি, ছোটবেলায় যখন মায়ের ঠাকুমা মাকে নিয়ে কাশী যেতেন, ওখানকার লোকজনের কাছে মা ‘বিখ্যাত’ হয়ে গিয়েছিল এই গানটা গেয়ে! মা-ই বা তখন কত্তটুকু! আরেকটা গান। ‘কাঁহা ছুপে ঘনশ্যাম’। কিংবা ‘ওরে ঝড় নেমে আয়’। রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘চিত্রাঙ্গদা’র গান। মা শিখিয়েছিল। প্রাণ ঢেলে। কী ভাল লাগত মায়ের কাছে শিখতে! বকা নেই, ঝকা নেই। সুরে সুরে সাঁতার দেওয়া শুধু। ওই সুরেই দিন ফোটে, সন্ধে নামে, রাত হয়। আমি শিখি। মা শেখায়।
’৯২ সাল। ধুপ করে মা চলে গেল। তিন বছর বাদে বাবা। গান ততদিনে শিকেয়। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভাই চাকরিতে। আমি টিউশনি। গ্র্যাজুয়েশনের পর বাবা অনেক কষ্টেসিস্টে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিল। তখন সেটা নিয়েই শখে বসি। আবার দায়েও। ততদিনে যে আমিও গানের দিদিমণি।
এর মধ্যে একটা রেডিয়ো এসেছে। সাদা-কালো টিভিও। সে বাবা-মা থাকতেই। কিন্তু হঠাৎ ওদের হারিয়ে জীবনটা তখন ছাদ-ছাড়া বাড়ির মতো। ভিজে যাচ্ছি বারবার। অল্প ঝড়েই ভেসে যাচ্ছি। রোদের ঝামটা যখন তখন। তবু বেশ বুঝি, গান লতানে গাছের মতো সেই যে আমায় পাকিয়ে নিয়েছে, তাতে ‘ছাড়ান’ নেই! শিখতে যাওয়াটা বিলাসিতা, লাটখাওয়া জীবনে পানসি ভাসিয়ে হেলেদুলে চলতে পারাটাই ঢের! তার মধ্যেই টের পাই, সুরের আঁকশির টান। সে টানে কোনও দায় নেই, জড়ানো মায়া শুধু। যে মায়ার গায়ে কখনও মায়ের মুখটা দেখি। ঘাম জবজবে কপালটা আঁচল দিয়ে মুছে মা কেমন সুরের নকশি কাঁথা বুনে চলেছে আমাদের তিন ফুট বাই তিন ফুটের রান্নাঘরে। হু হু করে কান্না পেত। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠত। আর ধীরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারতাম আমার চলে যাওয়া মায়ের শরীরটা সরগম হয়ে যেন ছড়িয়ে পড়ছে আমার মধ্যে।
|
গান ছাড়া এই বিনোদনটা ছিল আমার ষোলোআনা। মাসির ছেলেমেয়েদের সঙ্গ। টুলে বসে আমি, একদম পিছনে দিদি, দিদির কোলের কাছে আমার ছোট মাসির মেয়ে রিঙ্কু, পাশে আমার মেজমাসির ছেলে, এখন প্রয়াত 'দ্য গ্রেট' সূর্যদাদা | |
অনেক পরের কথা।
রেডিয়োয় জ্ঞানবাণী-তে রাজ্যশ্রী ঘোষের গান আমায় পাকিয়ে ধরল। আবার আমি গুরু পেলাম। সেই থেকে আর কোত্থাও যাওয়া নেই। ‘গুরু’ এখন আমার ‘দিদি’ও। ওঁকে ছাড়া ভাবতেই পারি না। বরং মনে মনে বলি, কেন যে এতদিন বাদে পেলাম ওঁকে! দিদির স্বরে, দিদির সুরে, গায়কীতে, মেজাজে, ঠাটে এমন একটা অবগাহনের প্রশান্তি, আমার মাঝে মাঝে খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। খাটের থেকে পা ঝুলিয়ে হারমোনিয়ামটা আদ্দেক বেঁকিয়ে মা সুর লাগাচ্ছে। উল্টো পারে আমি। একটু পরেই যেমন করে ‘সাঁতার’ শুরু হত সুরের, আজ এই প্রৌঢ়বেলাতেও সেই সন্তরণ যেন ফিরে পেয়েছি।
দিদির ক্লাস সেরে বেরিয়ে মাঝে মাঝে পৃথিবীটাকে এত বড়, ব্যাপ্ত লাগে কী বলি! ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মালিন্য, দৈন্যতা, ক্লেশ, ক্লিন্নতায় ডুবতে থাকা চারপাশকে তখন এত তুচ্ছ, অপূর্ণ, উদ্বৃত্তের মতো মনে হয়! অন্ধকার নেমে আসা আকাশের গায়ে তখন কত আলো! কত কত আলো! সেই আলোর কোলে ডুব দিয়ে মনটা জুড়োয়।
তখন আবার করে ভাবি, ভাগ্যিস মায়ের মেয়ে হতে পেরেছিলাম! তাই তো এই জ্যোতির্বলয়ের দর্শন পেলাম! এত আলোর ছটা দেখতে পেলাম!
অবাক কথাটা শুনবেন? আমার মায়ের নামটা কী ছিল বলুন তো!
উচ্চারণেই যার শরীর ছাপিয়ে উছলে পড়ে আলো আর আলো— পূর্ণিমা!
কে যে রেখেছিলেন মায়ের অমন নাম, জানা হয়নি কোনওদিন!
(শেষ)
|
গুরু সুকুমার মিত্র | |
সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে
অনুচিত্রণ: পরিচিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment