যে মন্দিরের সেবায়েত হলেন বৃহন্নলারাও ১ম পর্ব
ইতিহাসবিদ, ফরাসি চর্চাকারী ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ
দশ ফুট বাই দশ ফুট অফিসঘরে তো আর বোর্ড মিটিং হয় না। তাই ব্যবসা সংক্রান্ত জরুরি কথাবার্তা থাকলে অন্য একটা কোথাও যেতেই হয়।
মিশেলের পাঠানো আগাপাশতলা ফ্রেঞ্চ-এ লেখা আগামী ট্যুরের আইটিনেরিতে চোখ বুলানো প্রায় শেষ করে এনেছি, পাশ থেকে কল্লোল বলল, ‘‘আলো, লেটস গো ফর এ ড্রাইভ।’’
বুঝলাম জরুরি কথা আছে।
কিছুক্ষণ পরে সিটি সেন্টার টু-এ ‘ক্যাফে কফি ডে’ -তে দু’টো ক্যাপুচিনো অর্ডার করে মুখোমুখি বসলাম। মাথায় ঘুরছে মিশেলের দক্ষিণ ভারত ট্যুর। মিশেল আর তার বান্ধবী সিলভি আমাদের রিপিটার ক্লায়েন্ট। প্রায় সাতটা ট্যুর একসঙ্গে করার পর এখন বন্ধুও বটে।
কফিতে একটা চুমুক দিয়ে মুখ কোঁচকালো কল্লোল, ‘‘এরকম বিচ্ছিরি তেতোটা খেয়ে কী যে আনন্দ পাস!!
হেসে বললাম, ‘‘এনজয় দ্য লিংগারিংগ টেস্ট অফ দ্য কফি ডিয়ার।’’
কল্লোল ঠোঁট বেঁকিয়ে চুপ মেরে গেল।
‘এবার বল কী জন্য বেরোলি অফিস থেকে?’
‘‘সিম্পল, যদিও ফ্রেঞ্চ বুঝি না, তবে প্রত্যেকটা দিনের ডিটেইলিং দেখে বুঝতে পারছি যে রুটটা সোজা হবে না। শ্রীশৈলম হল অন্ধ্রপ্রদেশে, আর হাম্পি/বাদামি কর্ণাটক আরেক প্রান্তে। তুই এটাকে সাজিয়ে তোল, অন্যান্য কাজ আমরা সামলাব। তোর এখন আর অন্য কোনও কাজ নেই।’’
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgJjBn25MSsl7Ar96o3178shVWqnqk5P7xfYYEKv9vnvxpmywgkM_co7EwV44n6PoUgEsgA6SoFiNjUo3E-y697kEcWGTw4_Phn0XhS3XorTtjV0dCIC51Xv2UQ2Nscguxu6ypVFT6sDsI/w525-h361/1.jpg) |
নদীটির নাম নর্মদা |
কল্লোল সিরিয়াস।
মিশেলের ভারত প্রেমটা খাঁটি এবং সব ক’টা ট্যুরেরই একটা বিশেষ হাইলাইট থাকে, যেটায় বিদেশিদের আগ্রহ প্রায় নেই এবং প্রায়শই বেশ একটু দুর্গম এলাকায়। মনে আছে, কয়েক বছর আগে ট্যুর ছিল কেবল চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরগুলোকে ঘিরে। ফলে কেবল চৌষট্টি যোগিনী সাধনার ধারা নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
এবারেও একটা হাইলাইট আছে। ভাগ্যিস কল্লোল ফ্রেঞ্চ জানে না, বুঝতে পারেনি যে, এবারের ট্যুরের হাইলাইট কর্নাটকের প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মন্দির সৌন্দতি। উত্তর ভারতে কতজন যে সে মন্দিরের নাম শুনেছে, জানি না।
সন্ধ্যায় সিলভির ফোন, ‘‘আলো, এস ক্য তা দেজা ভেরিফিয়ে লা রুট? সে লা কোঁক্লুসিয়োঁ দ্য দের নিয়ের ভোয়াইয়াজ; হা হা হা!’’ (আইটিনেরিটা দেখেছিস? এবারটা আগের ট্যুরের সমাপ্তি।)
গত শিবরাত্রির দিন মাহেশ্বর এসে পৌঁছেছিলাম দুপুরবেলা। প্রাচীন নাম মহিষমতি মহাভারতে উল্লেখ পাই, এ রাজ্যের রাজা ছিলেন মহান কৃতবীর্য।
মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের বাংলোয় লাগেজটা ফেলে লাঞ্চ শেষ করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। ছোট্ট শহর। এখানেই বোনা হয় বিখ্যাত মাহেশ্বরী সিল্ক। হাঁটতে হাঁটতে নর্মদার তীরে এসে একটা নৌকা ভাড়া করলাম। গন্তব্য নর্মদার মাঝখানে চড়ায় প্রায় পরিত্যক্ত বাণেশ্বর শিব মন্দির। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এখানে কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং মহাদেব বাণাসুরকে দর্শন ও বর দিয়েছিলেন। ওই মন্দিরের চড়াটা থেকে মাহেশ্বরের রাজপ্রাসাদটা খুব সুন্দর দেখায়।
সিলভি আর মিশেল পরের পর ছবি তুলে চলেছে।
আমি একটু আনমনা ছিলাম।
সূর্যাস্তের পড়ন্ত আলোয় নর্মদার কূল কী যেন মনে করিয়ে দিতে চায়! কোনও এক প্রাচীন ইতিহাস!
নরম আলোয় আমি কেবলই ডুবে যাচ্ছি সেই প্রাচীন গাথায়!
সূর্যোদয় হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।
বিস্তীর্ণ নর্মদার তীরে অপেক্ষারত দুই পুরুষ।
প্রথমজন ক্ষত্রিয় সুপুরুষ বলবান এবং সশস্ত্র। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, বর্মহীন। দৃষ্টি নিবদ্ধ শূন্যে।
তিনি রাজা। রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ।
কিন্তু তাঁরই কারণে আজ শুধু রাষ্ট্র নয়, সমগ্র ক্ষত্রিয়কূল সংকটের সম্মুখীন। মনের গভীরে জল্পনা চলছেই। ক্ষাত্রধর্ম পালনে আত্মবলিদান শ্রেয়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব বিমুখ হওয়ার কলঙ্ক তার মহান বংশে লাগতে দেবেন না।
তিনি কার্তবীর্য অর্জুন। মহিষমতির রাজা।
কার্তবীর্য হলেন রাজা কৃতবীর্যের পুত্র। বর্তমান সংকটে তাঁর দায়িত্ব কতটুকু?
দ্বিতীয়জন শুভ্র সেন।
সৌম্যদর্শন ব্রাহ্মণ। মুখ চিন্তান্বিত।
রাষ্ট্রের সংকটকালে মন্ত্রীর দায়িত্ব যে সর্বাধিক।
সিংহাসনে রাজার পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু প্রজার কল্যাণ যেখানে মুখ্য, সেখানে সিংহাসন রাজাহীন হলেও রাষ্ট্রের নীতি ও নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে দেওয়া যায় না।
বিকল্প পথে প্রশাসনের সংগঠন দৃঢ় রাখতেই হবে। তিনি মহামন্ত্রী। তিনি চিন্তান্বিত।
রাজার মৃগয়া এবং প্রমোদভ্রমণ বর্তমান সংকটের মূল।
কিন্তু রাজার দায় কতটুকু? তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন মাত্র, যে, অরণ্যের যে অংশে সহচরীদের সঙ্গে তিনি আনন্দরত, সেই অরণ্যে সস্ত্রীক বাস করেন কঠোরতপা ঋষি জমদগ্নি।
রাজাকে দেখে জমদগ্নিপত্নী, আবাল্য তপস্বিনী রেণুকা দেবীর চিত্ত বিচলিত হলে বা তপস্যাভ্রষ্ট হলে রাজা কেন দায়ী হবেন?
কিন্তু একথা বিচার-বিবেচনার সময় অতিক্রান্ত।
পিতা জমদগ্নির আদেশে কনিষ্ঠপুত্র রামভদ্র, মাতা রেণুকা দেবীর শিরশ্ছেদ অন্তে প্রতিজ্ঞা করেছেন, পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করবেন এবং তাঁর প্রথম লক্ষ্য রাজা কার্তবীর্য অর্জুন।
সময় আগত কার্তবীর্য।
তিনি আসছেন। মন্ত্রীর দৃষ্টি নিবদ্ধ নর্মদার অপর পারে।
চোখ তুলে তাকালেন রাজা।
নর্মদার অপর পার থেকে এক যোগী যোদ্ধা দ্রুত এগিয়ে আসছেন। সকালের হাওয়ায় তাঁর পিঙ্গলবর্ণ উন্মুক্ত জটা আকাশে উড়ছে। হাতে এক মহাকায় কুঠার।
তিনি যোদ্ধা ও যোগ বলে বলীয়ান। তাঁর পা নর্মদার জল স্পর্শ করল না।
যেন আকাশ পথে উপস্থিত হলেন। শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে উচ্চারণ করলেন, ‘‘প্রস্তুত হও রাজা কার্তবীর্য, তোমার অপরাধ অমার্জনীয়।'
নীরবে অস্ত্র উদ্যত করে রাজা জানালেন তিনি প্রস্তুত।
যোগী পুরুষ জামদগ্নি পরশুরাম, কিন্তু কী আশ্চর্য তাঁর অস্ত্রশিক্ষা, তাঁর যুদ্ধকৌশল! তাঁর ভীম কুঠারাঘাতে মুহূর্তের মধ্যে ক্ষত্রিয় কার্তবীর্য অস্ত্রহীন ও ছিন্ন বাহু।
তিনি বিস্মিত। যুদ্ধ সমাপ্ত।
সংজ্ঞা হারানোর মুহূর্তে কানে ভেসে এল মহামন্ত্রীর কণ্ঠস্বর, ‘‘আনন্দ করো কার্তবীর্য। তোমার কর্মনাশ হচ্ছে মাত্র। আনন্দ করো।’’
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEi2J1Man7BjN0WPKexbkTxWEBzwD7QPwiuQYT0MYSGydZ0dcrT0ice7R2vYk0LO4DRy-eU_Jtt2lA4S1eNIOG8hJKCCeCGjQY3_mAPiiUGafrbTAMCt1xXknZdtV2OZSuLIVc79oXS6gKQ/s320/14.jpg) |
নর্মদার মাঝখানে দূরে চড়ার ওপরে দেখা যায় বাণেশ্বর মন্দির |
আনন্দ! কর্মনাশ!
কর্মনাশের অর্থ মুক্ত হওয়া। আর পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হতে হবে না।
তাই হোক। বুক ভরতি করে গভীর শ্বাস নিলেন রাজা।
চেতনা লুপ্ত হল তাঁর।
‘‘অ্যানাদার কফি শেক ডিয়ার?’’
বনানীর গলার আওয়াজে ফিরে এলাম অতীত স্মৃতি রোমন্থন ছেড়ে বর্তমানে।
সেদিন সন্ধ্যায় মিশেল আর সিলভিকে বলেছিলাম, বর্তমানের মাহেশ্বর অতীতের মহিষমতির রাজা কার্তবীর্য অর্জুনের গল্প। কিন্তু কাহিনির শেষটা সম্পূর্ণ জানা ছিল না।
বিভিন্ন পৌরাণিক গল্প ও অংশত মহাভারতে উল্লেখ পাই যে, পরশুরামের ঠাকুরদা ঋষি রুচিক রেণুকা দেবীর ছিন্নশির জোড়া লাগিয়ে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রাণ ফিরে পেয়ে অভিমানিনী রেণুকা দেবী স্বামী-পুত্র পরিত্যাগ করে দক্ষিণ দেশে যাত্রা করেন।
উত্তর ভারত আর তাঁর কোনও খবর রাখেনি।
পরের অংশ ২য় পর্বে
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
No comments:
Post a Comment