যে মন্দিরের সেবায়েত হলেন বৃহন্নলারাও ২য় পর্ব
ইতিহাসবিদ, ফরাসি চর্চাকারী ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ
মিশেলের ইমেলটা ভাবিয়ে তুলল।
হাম্পি এক অসাধারণ জায়গা। কিন্তু মিশেল বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে বাদামীর।
সাধারণত বাদামিতে আমরা এক রাতের বেশি থাকি না।
কিন্তু মিশেলের বিশেষ অনুরোধ বাদামিতে তিন রাত থাকার। কারণ কোনও এক ইয়েলাম্মা মন্দিরে সারা দিন কাটাতে হবে। যতদূর জানি ইয়েলাম্মা কর্ণাকের এক শক্তিপীঠ।
জায়গাটার নাম সৌন্দতি।
একটু ভেবে ফোন করলাম বেঙ্গালুরুর এক প্রবীণ গাইড বন্ধুকে।
তিনি শুনে একটু চুপ করে থাকলেন।
তারপর বিশদে পথনির্দেশ বুঝিয়ে দিলেন।
বললেন, ‘‘গিয়ে অনেক কিছু দেখবে। নিজে আবিষ্কার করো। আমি কিছু বলব না। ওটা খুব ট্যুরিস্টিক জায়গা নয়। কীরকম যেন রহস্যময়তা আছে।’’
একটু ধন্ধে পড়লাম।
বিশেষ অনুসন্ধান করতে হবে।
না’হলে মিশেল আর সিলভির এক লক্ষ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল হবে।
সন্ধ্যায় সিলভির ফোন, ‘‘আলো, ইয়েলাম্মা নিয়ে বেশি ভাবিস না। ওটার খবর আমরা তোকে দেব। তুই খালি নেটওয়ার্কটা ভাল করে কর। কারণ অনেকগুলো লং ড্রাইভ আছে।’’
বুঝলাম দুই ভারতপ্রেমিক বন্ধু আমার ইতমধ্যেই যথেষ্ট রিসার্চ করেছে।
নিশ্চিন্ত হলাম যে আমায় শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে।
যাত্রাপথের নেটওয়ার্ক খুব জটিল নয়।
দুই একটা লং ড্রাইভে লাঞ্চের জন্য স্যান্ডউইচ প্যাক করে নিলেই চলবে।
সমস্ত ব্যবস্থাপনা শেষ করে চেন্নাই পৌঁছে, মিশেলদের স্বাগত জানিয়ে ছিলাম ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পুরো ট্যুরের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিলাম।
সবশেষে একটু হেসে মিশেল বলল, ‘‘তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। তবে সেটা এখন দেব না।’’
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEi7zqbxv1sQaSCJuJkdnrUmxMkVQCV26n1pcGnpNc3lmJeC5hzksrZ3H1bhlwE9kSNzAw9Re9VodHjKUNukExwyz8z9yU7LG7IanTWezxIB8jjWn-o-2vKX7q5kybkYA6eDcqgm2C6oWO4/w507-h339/23.jpg) |
শ্র্রীশৈলমে চেঞ্চু উপজাতি। যারা কৃষিজীবী ও রাজমিস্ত্রি
|
চেন্নাই থেকে তিরুপতি, শ্রীশৈলম, হায়দ্রাবাদ ঘুরে বাদামি পৌঁছেছিলাম নির্বিঘ্নেই।
২২ শে ফেব্রুয়ারি ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে মিশেল একগাল হেসে বলল, ‘‘আজ সকালটা শুধু সারপ্রাইজ, এটা ধর।’’
হাতে একটা মোটা ফাইল। উপরে লেখা, ‘রিসার্চ অন ইয়েলাম্মা’।
সিলভি ততক্ষণে জিপিএস ম্যাপে সৌন্দতির অবস্থান বার করে ফেলেছে।
বাদামি থেকে গ্রামের রাস্তায় প্রায় ৩৫ কিলোমিটার যেতে হবে।
প্রাচীন নাম সুগন্ধাবতি।
৮৭৫- ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে রাট্টা বংশের রাজধানী ছিল, যা পরে ৭০ কিলোমিটার দূরে বেলগাঁওতে স্থানান্তরিত হয়। রাস্তায় যেতে যেতে ‘রিসার্চ অন ইয়েলাম্মা’র পাতা ওল্টাতে শুরু করলাম।
মিনিট কুড়ি বাদে চোখ তুললাম, আমি বিস্মিত, বাক্যহারা।
‘‘আগেই বলেছিলাম আলো, এবারটা আগের ট্যুরের সমাপ্তি,’’ মিশেলের মুখে মিটিমিটি হাসি, সিলভির চোখে ঝিলিক।
আমার কাছে এ এক অসাধারণ আবিষ্কার!
চিনেবাদাম আর ভুট্টার ক্ষেত পেরিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়িয়া এলাকা টপকে নেমে এলাম ইয়েলাম্মা-গুড্ডাতে (গুহা)।
একটা ছোট্ট পাহাড়ঘেরা উপত্যকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটা মন্দির।
মাঝখানে সবথেকে বড়টা বিখ্যাত শক্তিপীঠ ইয়েলাম্মা।
মন্দির ঘিরে মেলা বসেছে।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiAT4JN67ZCqIvjibqQAsvpejoiCN8uirPH9Nnld0qze00Zy5oMe12bydzMUdKiGrVTBqL33ZUMFd6lNIBC2KxMBemVqSwdUT-axj4THPhY-xhwCwefCaoWFAaM6nc9Am1ja9ccNoX1Wbg/w422-h286/17.jpg) |
উপজাতি চেঞ্চু |
পুঁতির মালা। কাঁচের চুড়ি। পূজার উপাচার সাজানো ছোট ছোট দোকান ঘিরে পুণ্যার্থীদের ভিড়।
চাষিরা এসেছে নতুন কেনা বলদ নিয়ে ইয়েলাম্মার আশীর্বাদপ্রার্থী হয়ে।
আমরা তিনজনই শুধু বেমানান শহুরে এবং তার ওপর দু’জন বিদেশিনী। সুতরাং সকলে ফিরে ফিরে দেখছে।
বহুবার ভারতে বেড়িয়ে অভিজ্ঞা মিশেল আর সিলভির পরনে শাড়ি। দিব্যি মানিয়েছে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম মন্দির চত্বরের দিকে।
মূল মন্দিরে পুজো দেবার আগে প্রণাম করতে হয় আরও দু’টো ছোট মন্দিরে।
প্রথমটি পরশুরাম মন্দির এবং দ্বিতীয়টিতে বসে আছেন ঋষি জমদগ্নি (পরশুরামের পিতা)।
মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবী ইয়েলাম্মার মুকুট শোভিত মস্তক মাত্র। ধড় নেই!
এ কেমন দেবী ইয়েলাম্মা!
সামান্য উপাচারে পুজো দিয়ে, সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে এসে বসলাম একটি পাহাড়ী ঝরনার ধারে।
লক্ষণীয়, এই মন্দিরের সেবায়েতরা হলেন বৃহন্নলারা এবং বিশেষ বেশের নারী।
সেবায়েত নারীদের সহজেই চেনা যায় গলার শঙ্খমালা দেখে।
কিন্তু বৃহন্নলারা কেন?
এখানে কি বৃহন্নলীতন্ত্র অনুযায়ী কোনও সাধনা জড়িত?
তার তো কোনও উল্লেখ কোথাও পাচ্ছি না।
দুই বিদেশিনীর সঙ্গে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়া সেবায়েত। পারস্পরিক কৌতূহলী কথোপকথন চলল ভাঙ্গা হিন্দিতে।
শুনলাম তাঁর কাছে তাঁদের ইয়েলাম্মার কাহিনি।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj9mSKn2NRN540-n_sCoGQk6u2KOeSHsVQetfQKpdlOzp5y5QtTmQiIT4rLywWM2TJVe08irqe3Ttgw0n2weVL-hv5Zg9bs3NLeah9JHdOcNfnsYWZzultUUj-ghCGxaPKk4klYodAnZfU/w445-h312/34.jpg) |
নতুন কেনা বলদ নিয়ে ইয়েলাম্মার আশীর্বাদপ্রার্থী হতে এসেছে চাষিরা |
সে অনেক দিন আগের কথা।
এই পাহাড় জঙ্গল ঘেরা জায়গায় থাকত উপজাতিরা।
একদিন গ্রামের মেয়েরা এই বনের মধ্যে কাঠ কুড়াতে গিয়ে দেখে এক পরমা সুন্দরী নারী একলা পথের ধারে বসে আছেন। ক্লান্ত।
গ্রামের মেয়েরা দুধ আর ফলাদি দিয়ে তাঁর সেবা করে।
একটু সুস্থ হলে তাঁরা জিজ্ঞাসা করেন, এই বনের পথে একলা তিনি কোথায় চলেছেন? তিনি উত্তর দেন ‘‘ইয়েল্লে।’’
কন্নড় ভাষায় 'ইয়েল্লে' মানে ‘এই পর্যন্ত’। সেই থেকে তিনি ওই বনেই রয়ে গেলেন এবং কঠোর তপস্যায় মগ্ন হন। গ্রামের মানুষ তাকে ডাকত ‘ইয়েল্লে আম্মা’ নামে।
পরের অংশ ৩য় পর্বে
১ম পর্বে যেতে গেলে এই বাক্যটিতে ক্লিক করুন আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
No comments:
Post a Comment