চতুর্ভূজা দুর্গা ও প্রাচীন গাঁ পিয়াসাড়ার গল্প অনেকটা যেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ১ম পর্ব
শিক্ষক, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি চর্চাকারী
গাঁয়ের বাড়িতে দুগ্গা পুজো করবেন বলে মুক্ত হন কর দিতে না-পারা কারারুদ্ধ জমিদার!
সেই গাঁয়ে এককালে চলত মার্টিন রেল!
দখলদারীর থাবা, সতীত্বনাশ করা ‘দুষ্টের পালন’-কে ঘিরে বিতর্ক থেকে গাজনের বিচিত্র উৎসব, নীলাবতীর বিয়ে— সবটা জুড়ে ৩০০ বছরের এই পল্লীর ইতিহাসের প্রতিটি অক্ষরে আজও যেন ধরা আছে বিদ্যুতের ঝলকানি!
শুনতে শুনতে মনে হয়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাসের ঝলক পাচ্ছি বুঝি!
তবে ওটুকুই সার!
যত দিন যাচ্ছে পলির পর পলির গ্রাসে যেমন ফুরোয় গাঙের ধারা, ঠিক তেমনই যেন বিস্মৃতির চড়া ক্রমেই হাঙরের মতো গিলে খা্চ্ছে ভরা জোয়ারের পাড়।
আজ সেই ভাঙা পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘাটের কথা বলব।
জেলা হুগলি। থানা তারকেশ্বর। গ্রাম পিয়াসাড়া।
নামটা শুনেই ভ্রু তুলে ফেললেন তো! অদ্ভুত লাগল?
স্বাভাবিক। প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি নাম। অথচ ইতিহাসের বহর সেখানে কত যে গণ্ডা, সে গল্পে ঢুকলে আরেকবার টের পাবেন, অঞ্চলের ইতিহাসকে বেমালুম বস্তাবন্দী করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে এ জাতির জুড়ি নেই!
আসব সে সব গপ্পে। তার আগে চলুন ‘পিয়াসাড়া’র নাম-রহস্যটা একটু নেড়েচেড়ে দেখি!
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEietQHiiO6lLScnBBOs2500WI7vk0LPdXsuhfWVVAXq3oX4rkuZ_TXMtMynWBVuQHOtpimmuhw5LfroqPwLgRrXbX4jTQh-QM6OY7t8_MKpJUGS7mQiXBVmM0OttN2WEZBP-Cml3o24BdQ/w497-h337/IMG_20200829_014659.jpg) |
‘পিয়াসাড়া’র পথে প্রান্তরে
|
প্রথমেই সুকুমার সেন।
তাঁর ‘বাংলা স্থাননাম’-এ তিনি বলছেন, ‘ষণ্ডা’ থেকে ‘সাড়া’ নামটি আসতে পারে। ‘ষণ্ডা’, অর্থ ফলহীন বৃক্ষ। ফলে এখানে এক সময় ফলহীন বৃক্ষের কোনও ব্যাপার-স্যাপার ছিল, একথা অনুমান করতে পারি মাত্র।
বিশ্বেন্দু নন্দ।
তিনি আবার বলছেন, ‘সাড়া’ মানে ‘পথ’ও হয়।
যেমন বাকসাড়া>বাগসাড়া, অর্থাৎ বাগানের পিছন দিকের রাস্তা।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
তাঁর ‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসে ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে’ ছড়াটির যে পাঠ রয়েছে, তাতে এক জায়গায় দেখবেন, লেখা আছে— ‘সাড়া গেল বামনপাড়া’। [১]
এখানে শাস্ত্রী মহাশয় কিন্তু ‘সাড়া’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘মিছিল’।
এর বাইরে ১৭৭৬ সালে আঁকা, রেনলের যে মানচিত্রটি পাওয়া যায়, সেখানে উত্তর দিক থেকে রাজবলহাটগামী যে রাস্তাটি দেখানো আছে, অনেকেই মনে করেন, এটি ওই পিয়াসাড়া গ্রামের ওপর দিয়েই যেত।
এ তো গেল নাম-রহস্য। চলে যাই গাঁয়ের গোড়ার কথায়।
মোটামুটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিক জন্ম নিচ্ছে এই প্রাচীন পল্লী।
কিন্তু কী ভাবে? সেই কাহিনিতে ঢুকতে গেলে আরও একটু পিছিয়ে যেতে লাগে।
সপ্তদশ শতাব্দী। হাওড়া ও হুগলির বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন ছিল ভুরশুট পরগণার অন্তর্ভুক্ত।
১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্র রায় ভুরশুট আক্রমণ করেন। তখন হাওড়া হুগলির একাধিক অঞ্চল বর্ধমানের রাজের অধীন হয়।[২]
পরবর্তীকালে এই বিশাল অঞ্চল ছোট ছোট জমিদারিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এইসব স্থানীয় জমিদাররা সময়মতো বর্ধমানের মহারাজাকে কর দিয়ে নিজের এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন।
এরকমই একটি জমিদার বংশ হল পিয়াসাড়ার সরকার বংশ।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjJMnc5vZf5bs0uvb9gBXdWh0YV_gHONtBK7cdeYqoaMlaxIme4Cue8oM6RlnHFWIr8Tk-MQN9JUv2tjY1ulQ5MKP1wzTmRbVly5YjxnstUG8ARxNdNkmAYMNJhynanfvEdInnAdKZiQ2s/w542-h340/IMG_20200829_014903.jpg) |
পিয়াসাড়ার সরকার বাড়ির চত্বরে |
সরকারদের বংশতালিকায় নজর ফেললে দেখা যায়, বর্তমান প্রজন্ম হল এই সরকারদের ১২ তম পুরুষ। এবার এক পুরুষে ২৫ বছর ধরে হিসেব করি, তো সরকারবংশ মোটামুটি ৩০০ বছরের প্রাচীন।
সে দিক থেকেও কিন্তু সময়কালটি বর্ধমান-রাজ কীর্তিচন্দ্রের ভুরশুট আক্রমণের সাথে প্রায় মিলে যায়।
সেটি মাথায় রেখে এগোলেই আমরা দেখি, জনৈক শরৎচন্দ্র সরকার আনুমানিক ১৭২০ সাল নাগাদ পিয়াসাড়া জমিদারির প্রতিষ্ঠা করেন।
ইনি ছিলেন জাতিতে সদগোপ। পিয়াসাড়া গ্রামে আর সদগোপ বলতে আছেন গ্রামের মণ্ডলরা। কিন্তু জমিদার সরকার বংশ সম্ভবত বর্ধমানের কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে এখানে আগত। বর্ধমানের মহিষগড়িয়ায় এই বংশের একটি শাখা এখনও বসবাস করছে।
এই বংশের চতুর্থ পুরুষ হলেন জমিদার ইন্দ্রনারায়ণ সরকার। তাঁর সময়কাল আনুমানিক ১৮০৫-১০। ওই সময় একটি অভূতপূর্ব ঘটনা পিয়াসাড়ার সরকারদের ভাগ্যের চাকা ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
খাজনা বাকি থাকার কারণে জমিদার ইন্দ্রনারায়ণ সরকারকে বর্ধমানে নিয়ে এসে কারাবন্দী করে রাখেন বর্ধমানের মহারাজা।
সময়টা শরৎকাল।
জমিদারবাবু মহারাজাকে জানান যে, তাঁকে এভাবে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখলে এ বছর পিয়াসাড়ায় দুর্গাপুজো হয়তো হবে না। এ কথা শুনে মহারাজা বোধহয় খানিক বিচলিত হয়ে পড়েন।
তারপর তিনি দেখেন, জমিদারমশাইয়ের ব্যবহারটিও বেশ সুখকর। সব মিলিয়ে মহারাজা সন্তুষ্ট হয়ে ইন্দ্রনারায়ণকে মুক্তি দেন। তবে একটি শর্ত।— তিনি যেন ফিরে গিয়ে তাঁর গ্রামে অবশ্যই দুর্গাপুজো করেন।
কারামুক্ত জমিদার অল্প সময়ের মধ্যেই সে বছর দুর্গাপুজোর আয়োজন করলেন।
পুজোর খবর বর্ধমান-রাজ অবশ্যই শুনলেন। তুষ্টও হলেন। উপহার হিসেবে পিয়াসাড়া জমিদারকে তিনি নিষ্কর ঘোষণা করে দিলেন।
তারপর থেকে সরকাররা নির্ঝঞ্ঝাট জমিদারি ভোগ করতে লাগলেন।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiHq2bIhY5zmucmvjnTwGLGT66U5KVu23ARVoHS7bjVuh0LTC7E4za76cSjYD7PJq7jbsP08_5a5JR_Z6OUSS8qbJ-wwwlYRIbB-jh871eG3AFnQFyZT3KkiJO4UkfX7c6ZfE7CuOUb-AU/w368-h470/IMG_20200829_014304.jpg) |
পিয়াসাড়ার সরকার বাড়ির চত্বরে |
ছবিঃ প্রতিবেদক
ঋণঃ
[১] বেনের মেয়ে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ১১৫,
[২] বর্ধমান ইতিহাস ও সংস্কৃতি, যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী, দ্বিতীয় খণ্ড,পৃষ্ঠা ১৭০
পরের অংশ ২য় পর্বে
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
No comments:
Post a Comment