ইংরেজি তো জানতেনই। জানতেন ফারসি, সংস্কৃতও।
শোনা যায়, নবাবের ফৌজদার হয়ে লালমুখোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন।
তখন কে জানত, এ মানুষই মধ্যজীবনে এসে বাংলা সঙ্গীতে এমনই একটি ধারার জন্ম দেবেন, যার জোরেই তিনি পরিচিতি পাবেন! বছর বছর বেঁচে থাকবেন বাঙালির প্রাণের নিধি হয়ে!
তিনি রামনিধি গুপ্ত। তামাম সঙ্গীতপ্রেমী বাঙালি যাঁকে চেনে ‘নিধুবাবু’ নামে।
বছর পঁয়ত্রিশ অবধি তাঁর জীবন যেন রহস্যে ঘেরা!
আর তারপরে? নিজেও মজলেন রসে, বাংলা সঙ্গীতকেও টইটুম্বর করে তুললেন রসসাগরে! সে এক কাহিনি বটে!
বলতে বসে জন্মকাল থেকেই শুরু করি।
১৭৪২ সাল।
ত্রিবেণীর কাছে চাঁপতা গ্রামে মাতুলালয়ে বাড়িতে জন্ম নিল যে শিশুটি, বয়সকালে তিনি হবেন টপ্পা গানের নিধুবাবু!
বাবার নাম হরিনারায়ণ। কাকা লক্ষ্মীনারায়ণ। বহু আগে থেকেই তাঁরা কলকাতার কুমোরটুলির বাসিন্দা। এলাকার কবিরাজ বলে সুপরিচিত।
পলাশির যুদ্ধের আগে বর্গির হাঙ্গামার ভয়ে হরিনারায়ণ সাময়িকভাবে চাঁপতায় চলে এসেছিলেন।
বয়স যখন ছয়, রামনিধি তখন কলকাতায় আসেন। এর বাইরে তাঁর বাল্যবেলা নিয়ে অল্পবিস্তর যা কিছু জানা যায়, তা হল, তাঁর শিক্ষা। ফারসি জানতেন। সংস্কৃতও। বাংলা তো বটেই। পাশাপাশি তিনি এক ইংরেজ পাদরির কাছে ইংরেজি ভাষাও শিখেছিলেন।
তখনকার দিনে মুৎসুদ্দির চাকরি পেতে গেলে ইংরেজি জানতেই হবে। তো, রামনিধির সেই শিক্ষা থাকায় ১৭- ১৮ বছর বয়সে তিনি নবাবের আওতায় চাকরি নিয়ে বিহারে চলে যান।
৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনকাহিনি বেশ খানিকটা রহস্যের অন্তরালে ঢাকা।
নিধুবাবু নিজেও এ নিয়ে ঘুণাক্ষরে কারও কাছে মুখ খুলতেন না।
অনেকে বলেন নবাবের ফৌজদার হিসাবে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সিয়ারুল মুতাক্ষরিন ও বেঙ্গল গেজেটের সাক্ষ্যে ‘নিধি’ নামে এক দোর্দন্ডপ্রতাপ বাঙালি হিন্দু ফৌজদারের কথা জানা যায়, যিনি ইংরেজ সৈন্যকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিলেন। রামনিধিই সম্ভবত সেই ফৌজদার।
মীরকাশিম যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর তিনি কলকাতায় পালিয়ে আসেন।
ইংরেজ রাজত্বে তাঁর অতীত কাহিনি ফাঁস হয়ে পড়লে পাছে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, তাই সম্ভবত অতীত নিয়ে বিশেষ কিছুই বলতেন না তিনি।
ইংরেজি জানা থাকলেও কোনও এক অজানা কারণে তিনি ইংরেজদের দাক্ষিণ্যের চাকরি খোঁজার চেষ্টা করেননি।
সম্ভবত কলকাতায় ফিরে আসার পর তাঁর বিবাহ হয়। পরে অবশ্য প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি আরও দু’টি বিবাহ করেছিলেন। চার ছেলে ও দুই মেয়ের পিতা এই রামনিধি গুপ্ত।
গানবাজনা শিখেছিলেন বিহারে যাওয়ার আগেই। কলকাতাতেই। কিন্তু সেই শিক্ষা পাকাপোক্ত রূপ পায় বিহারে। ছাপড়ায়। ৩৫ বছর বয়সে রামনিধি এক প্রতিবেশীর ডাকে ছাপড়ায় দেওয়ানিতে চাকরি নিয়ে চলে যান। সেখানে এক মুসলিম ওস্তাদের কাছে তাঁর রাগ সঙ্গীতের শিক্ষা। তবে সেই ওস্তাদ তাঁকে ঘরানার ‘আসলি চিজ হাসিল’ করাননি বলে নিধুবাবুর আক্ষেপ ছিল।
ছাপড়ার ক্ষুদ্র পরিসরে রামনিধি অন্য কোনও নামজাদা ওস্তাদেরও সন্ধান পাননি। ক্ষুব্ধ নিধুবাবু স্থির করেন তিনি বাংলা গানই করবেন। বাংলা ভাষার মাধুর্যকে মিশিয়ে দেবেন ধ্রুপদী সংগীতের সঙ্গে। সৃষ্টি করবেন নতুন এক সঙ্গীতধারার।
সেই সময় গোটা উত্তর ভারতে টপ্পা গানের বহুল প্রচলন হয়েছিল। এই গানের জন্ম পঞ্জাবের উটচালকদের মুখে মুখে। তাই টপ্পা গান গোড়ার দিকে মূলত পাঞ্জাবি ভাষাতেই শোনা যেত।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অযোধ্যা-নিবাসী গুলাম নবি নামে এক ওস্তাদ টপ্পা গানকে সুসংস্কৃত করেন। তাঁর গানে শোরী নামে এক মহিলার প্রতি প্রেম নিবেদনের ভাব খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাই অনেকে তাঁর গানকে বলতেন ‘শোরী মিঞাঁর টপ্পা’।
এ ধরনের টপ্পাকেই নিধুবাবু তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে ঢেলে সাজালেন।
অঙ্কন ও গ্রাফিক্সঃ জয়দীপ সেন
পরের অংশ ২য় পর্বে
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
No comments:
Post a Comment