সেই সময় ছাপড়ায় বসে বাংলাভাষা সম্পর্কে নিধুবাবু বড়ই সংবেদনশীল হয়ে পড়েছিলেন। তার প্রমাণ মেলে তাঁর গোড়ার দিকে রচিত এই টপ্পাটিতে—
‘নানান দেশে নানা ভাষা/বিনে স্বদেশীয় ভাষা/ পুরে কী আশা’
টপ্পা শব্দটি হিন্দি।
এর অর্থ লম্ফ বা লাফ।
এ জাতীয় গান পুরোপুরি রাগসংগীত নয়।
তবে রাগরাগিনীর ছায়া প্রবলভাবেই উপস্থিত থাকে।
গিটকিরি হল টপ্পার প্রধান উপাদান।
আস্থায়ী ও অন্তরা— এই দু’ভাগে বিভাজিত টপ্পার আঙ্গিক। ভৈরবী, খাম্বাজ, সিন্ধু, কাফি, ঝিঁঝোটি, পিলু, বঁরোয়া প্রভৃতি রাগের চলন পাওয়া যায় টপ্পা গানে।
শোরী মিঞার টপ্পা মূলত মধ্যমানে আড়ঠেকায় বাধা হত। সেখানে দ্রুত তালের ব্যবহারও রয়েছে। কিন্তু নিধুবাবু যে টপ্পা তৈরি করলেন, তাতে পশ্চিমি টপ্পার মতো দ্রুত তান অনুপস্থিত।
তিনি এক একটি সুরের ওপর ভাব তৈরি করে রাগের করুণ রসকে মূর্ত করেছিলেন। তবে তাঁর ছন্দ কিন্তু গানেরই, কবিতার নয়। তাই লিরিক হিসেবে পড়তে গিয়ে অনেক সময় ছন্দের বেতাল প্রয়োগে হোঁচট খেতে হয়।
১৮ বছর ছাপরায় কাটিয়ে ৫২-৫৩ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।
এবার নতুন জীবন।
প্রভূত অর্থ উপার্জন করে ফিরেছিলেন।
তাই অন্নচিন্তা ছেড়ে বাকি জীবন তিনি গান নিয়েই কাটিয়ে দেন।
এ সময় আখড়াই গানের প্রচলন ছিল।
নিধুবাবু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুটি আখড়াইয়ের দল সৃষ্টি করলেন। আখড়াই গান ছিল মূলত রাগসংগীতের ওপর বাঁধা। দরবারি গান। অর্থাৎ দলবদ্ধভাবে আসরে বসে গাওয়া হত। নিধুবাবু প্রতি সন্ধ্যায় ২০ নম্বর নন্দরাম সেন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাছেই শোভাবাজার বটতলায় জয়চন্দ্র মিত্র নির্মিত আটচালায় বসতেন। সেখানেই বসত তাঁর গানের আসর।
শহরের জ্ঞানীগুণী মানুষকে তাঁর বাড়িতে এসে গান শুনে যেতে হত। তিনি কখনও কারও বাড়ি গিয়ে গান শোনাতেন না। সর্ব অর্থেই ছিলেন তিনি ‘বাবু’। ধনী লোকেরা তাঁকে আর পাঁচজন গাইয়ের মতো পয়সা দিয়ে তুষ্ট করার সাহস দেখাতে পারতেন না।
বটতলার এই আড্ডায় বিখ্যাত শোভাবাজারের পক্ষীর দলের জন্ম।
পক্ষীর দলে অংশ নিতেন অবস্থাপন্ন বাড়ির যুবকরা।
গাঁজা, চন্ডু, চরসের নেশায় মজার পাশাপাশি গানের পশরা— এই ছিল তাঁদের জীবনযাপন। এঁরা এক একটি পাখিকে নকল করে তার ডাক ডাকতেন। এ হেন পক্ষীর দলকে রাগরাগিনীর শিক্ষা দিয়ে সুসংস্কৃত করে তোলার দায়িত্ব নেন নিধুবাবু। নিজেও কয়েকটি আসরে উপস্থিত থাকতেন।
শোভাবাজারের পাশাপাশি্ বাগবাজারের গোস্বামীদের আটচালায় জন্ম নিল আরেক পক্ষীর দল। যা পরিচিত হল ‘বাগবাজারের পক্ষীর দল’ নামে।
বাগবাজারেরই বিখ্যাত ঢোলবাদক রসিকচাঁদ গোস্বামী ছিলেন নিধুবাবুর বিশেষ বন্ধু। আবার তাঁর বন্ধু ছিলেন এলাকার বিখ্যাত ধনী শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। শিবচন্দ্র হলেন বাগবাজারের দলের পৃষ্ঠপোষক। আর নিধুবাবু শিক্ষক।
কালক্রমে সব আসরই মাত করতে লাগল বাগবাজারের দল।
গোস্বামীদের আটচালাতেই নিধুবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর প্রধান শিষ্য বোসপাড়া নিবাসী মোহনচাঁদ বসুর। মোহনচাঁদই পরবর্তীকালে নিধুবাবুর গানকে তাঁর অতুলনীয় মধুর কন্ঠে জনপ্রিয় করেছিলেন। আখড়াই ভেঙে হাফ আখড়াইও মোহনচাঁদের সৃষ্টি।
হাফ আখড়াই অনেক সহজ। কথা ও সুরে অনেক জনপ্রিয়। নিধুবাবু গোড়ায় একে মানতে চাননি। তবে শেষজীবনে অবশ্য মোহনচাঁদকে আশীর্বাদ করে, নতুন গানকে স্বীকার করে নেন।
নিধুবাবুর জীবন প্রেমের আকুলতায় ভরপুর।
কলকাতায় তাঁর সঙ্গে মুর্শিদাবাদের দেওয়ান মহারাজ মহানন্দ রায়ের আলাপ হয়। মহানন্দর একজন সুন্দরী, সুশিক্ষিতা রক্ষিতা ছিলেন। নাম শ্রীমতি।
নিধুবাবু তাঁকে গান শেখাতে সম্মত হন।
মহানন্দ কলকাতায় থাকুন বা না থাকুন নিধুবাবু শ্রীমতির বাড়িতে যেতেন। গান শেখাতেন। পরিণত বয়সি নিধুবাবুর সঙ্গে শ্রীমতির প্রেম হয়। তবে কেউ কেউ নিধুবাবুর এই প্রেম দুর্বলতাকে আমল না দিয়ে দু’জনের সম্পর্ককে স্নেহ ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরে নিয়েছেন।
শ্রীমতির বাড়িতে বসে নিধুবাবু যখন যেমন ভাব মনে উদয় হত, সেরকম গান লিখে সুর করেছেন। কখনও মান-অভিমান, কখনও দীর্ঘ অদেখায় মনের আকুলতার, আবার কখনও প্রেম বিহনে হতাশা ফুটে উঠেছে সে সব গানের বাণীতে।
নিধুবাবু লিখেছেন, ‘‘মিলনে যতেক সুখ মননে তা হয় না।/ প্রতিনিধ পেয়ে সই, নিধি ত্যজা যায় না।’’ কিংবা ‘‘আমি যারে চাহি,সে না রাখে মান।/ এমন পিরীতে বল কী’বা প্রয়োজন।’’
১৮৩৯। দীর্ঘজীবন কাটিয়ে নবতিপর বয়সে নিধুবাবু চিরবিদায় নেন।
দিন কয়েক আগেও তাঁকে গান রচনা করতে দেখা গিয়েছিল।
প্রথম জীবনের যোদ্ধা শেষবয়সে গানকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা বাংলার এই কিংবদন্তী সন্তান এই একবারের জন্যই হার মেনেছিলেন, যখন মৃত্যু এসে তাঁর শিওরে ছোবল মারে!
অঙ্কন ও গ্রাফিক্সঃ জয়দীপ সেন
১ম পর্বে যেতে হলে এই বাক্যটিতে ক্লিক করুন
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
No comments:
Post a Comment