মহম্মদ হাবিবের সঙ্গে কেন জানি না, আমি দিলীপকুমারের মিল পাই!
আমার কাছে ময়দানের ফুটবলের নেতাদের নেতা, দ্য গ্রেট হাবিব!
ওদিকে বলিউডে শ’খানেক স্টার থেকে সুপারস্টার, সুপারস্টার থেকে মেগাস্টার এলেও 'অ্যাক্টর অফ অ্যাক্টরস্' বলতে বরাবর একজনের কথাই আমার চোখে ভাসে।
তিনি দিলীপকুমার।
সত্তরের দশকের ময়দানের মহা দুষ্ট চতুষ্টয় পর্যন্ত বড়ে মিঞার দাদাগিরির সামনে কাত্! যে দুষ্ট চতুষ্টয়কে সামলাতে গিয়ে মহাগুরু পিকে পর্যন্ত কেঁদে ফেলেছিলেন মুম্বইয়ে রোভার্স ফাইনালের সকালে!
সে গল্প দিয়েই শুরু করি।
সেই রোভার্স কাপটা জিতলে পিকে-র ইস্টবেঙ্গল ভারতীয় ফুটবলের নয়া নজির গড়বে। কিন্তু ফাইনালের সকালে ঘড়ির কাঁটায় তখন এগারোটা। তখনও হোটেলে সুধীর-পিন্টু (সমরেশ চৌধুরী) বা সুভাষ-গৌতমের ঘরের দরজা খোলার নামগন্ধ নেই।
|
রোভার্স কাপ। দিলীপকুমারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন ভাই আকবর |
কয়েক ঘণ্টা পরেই ফাইনাল।
কখনই বা টিম মিটিং করবেন?
কখনই বা সুধীর-সুভাষরা খেয়েদেয়ে তৈরি হবেন?
অপারগ পিকে প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে লাল-হলুদে সেবারের সবচেয়ে সিনিয়র ফুটবলার হাবিবের শরণাপন্ন।—
‘‘দ্যাখ না বাবা, ছেলেগুলোর যদি মরার ঘুম ভাঙাতে পারিস! ভোররাত পর্যন্ত ফূর্তি করবে, আর বেলা বারোটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোবে!’’
কোচের 'কান্নাকাটি' দেখেই হাবিব ‘ফায়ার’!
দাবানল লেগে গেল তাঁর চোখেমুখে!
গলা ফাটিয়ে বললেন, ‘‘সালো, ক্যা সমঝতে হ্যায় খুদ কো?’’
লাথি মেরে প্রায় দরজাই ভেঙে ফেলেন সুভাষ-পিন্টুদের আর কী!
যারা নিজেরাও তখনই এক-একজন সুপারস্টার ফুটবলার।
অন্য কেউ হলে ধুন্ধুমার লেগে যেত।
কিন্তু তিনি যে নেতাদের নেতা। বড়ে মিঞা।
তাঁর রুদ্রমূর্তির সামনে বাঘ-সিংহও কেঁচো!
অবস্থা সামলে গেল লাল-হলুদ শিবিরে।
এই না হলে রাজার রাজা!
একটা কথা প্রায়ই ভাবি।
একটু অন্য প্রসঙ্গ যদিও।
তবু বলি।
গোটা সত্তরের দশকজুড়ে তো বটেই, আশির দশকের গোড়াতেও, হাবিবের প্রতি মরশুমে ময়দানের হায়েস্ট পেইড ফুটবলার থেকে যাওয়ার রহস্যটা কী? তার সঙ্গে চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব?
এখানেও কিন্তু বিস্তর অবাক করা কাজকারবার চোখে পড়ে।
যা সচরাচর ময়দানে বিরল।
এর ফাঁকে একটা কথা বলে নিই।
তাকে কি পেশাদারিত্ব বলবেন, না স্নেহ, নাকি অন্য কিছু, জানি না।
|
শূন্যে আলিঙ্গনে বন্দি, শ্যাম থাপার সঙ্গে মোহনবাগানী হাবিব |
সেসময় প্রতি বছর ফুটবলে ডাবল স্ট্রাইকারে খেলার স্ট্র্যাটেজি নিতেন হাবিব। দলবদলের আগে। ময়দানের তিন প্রধান, যারা হাবিবকে নিতে আগ্রহী, তাদের কর্তাদের বড়ে মিঞা, ভাই আকবরকে নিয়ে সই করানোর দর হাঁকতেন।
এর ব্যাখ্যা তিনি কী দেন?
প্রশ্ন করতে উত্তর এল—
‘‘ওই টাকার অ্যামাউন্টে আমার কত আর আকবরের পেমেন্ট কত, সেটা আলাদা করে থাকত না। ইচ্ছে করেই রাখতাম না। ফলে যখন যে ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি করতাম, দিনের শেষে প্রতি বছর দেখা যেত আমার টাকার অঙ্কটা ময়দানে সবার চেয়ে এক টাকা হলেও বেশি!’’
হাসতে লাগলেন শাহেনশা।
কিন্তু অভিনব পেশাদারিত্ব? যা আজও কিংবদন্তী হয়ে ময়দানের মাঠে, ঘাসে, গ্যালারিতে, তাঁবুতে পাক খেয়ে বেড়ায়!
তার ব্যাখ্যা হাবিব স্বয়ং কীভাবে দিয়ে থাকেন? শুনুন তবে।
তাতেও বিস্তর অবাক হওয়ার রসদ লুকিয়ে! —
‘‘দেখিয়ে দাদা, বড় বড় অফিস যেমন ভাল ভাল অফিসারকে চাকরি দেয়, তেমনই বড় ফুটবল ক্লাব করে। আবার বড় অফিসার যেমন আগে থেকে দেখে নেয়, কোন বড় অফিসটা বেশি ভাল, বেশি মাইনে দেবে, তারপর সেই অফিসে কাজে জয়েন করে, আমিও তাই। প্রতি বছর দলবদলের সময় দেখেবুঝে নিতাম ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডানের মধ্যে কোন দলটা সে বছর সবচেয়ে ভাল হচ্ছে। আর সেটা বুঝে সেইমতো সবচেয়ে ‘টাফ’ দলটায় সই করতাম। না, না, এর জন্য আমার কোনও লজ্জা নেই। আরে, সেরা দলে খেললেই তো নিজের সেরা পারফরম্যান্সটা বেরোবে! ঠিক যেমন সেরা অফিসে একজন অফিসার তার সেরা কাজটা করতে পারে। দেখবেন সবসময় আমার দলের মাঝমাঠে গৌতম-পিন্টু বা প্রসূন-গৌতম, উইংয়ে সুভাষ-সুরজিৎ বা মানস-বিদেশ, সেকেন্ড স্ট্রাইকার শ্যাম, আকবর বা সাব্বির থেকেছে। আর ওদের মতো ফুটবলারদের নিজের পাশে পেয়ে আমি আরও বেটার খেলেছি।’’
সাফ কথা বড়ে মিঞার। স্মৃতি হাতড়ে দেখলাম, এক-দু’ মরসুম অবশ্য মিঞা ছিলেন ভাই ছাড়া। কিন্তু তখন এতই অন্য মুডে, অন্য ঢঙে, অন্য বিচরণের মুক্ত হাওয়ায় প্রাণের কথা বলছিলেন, সে প্রসঙ্গ তুলতে কেমন মায়া হল!
|
১৯৮০। ইস্টবেঙ্গল। জামশিদের সঙ্গে উল্লাসে |
এখান থেকেই চলে গেলাম তাঁর মহাগুরু পিকে এবং কোচ পিকের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অমল দত্তের মধ্যে তুলনাতে। অদ্ভুত জবাব তাতেও!—
‘‘এটা কোনও তুলনার সাবজেক্ট!’’
‘কেন?’
‘‘প্রদীপদা নিজের ভুলটা স্বীকার করতে জানতেন। দুর্ধর্ষ ম্যান ম্যানেজমেন্ট জানতেন। অমলদার সেখানে শুধু 'আমি আমি'। ম্যান ম্যানেজমেন্টে জিরো। বিরাশিতে ইস্টবেঙ্গলে ওনার বাজে ম্যান ম্যানেজমেন্টে বিরক্ত হয়েই আমার প্রথম রিটায়ার করার চিন্তা আসে। অথচ কী দুর্দান্ত টিম সেবার ইস্টবেঙ্গলের! ভাস্কর থেকে বিশ্বজিৎ। সুধীর-মনোরঞ্জন থেকে তরুণ-অলোক। প্রশান্ত থেকে মিহির-অমলরাজ। বিশ্বজিৎ-আকবর-কার্তিক শেঠ! সব ক’টা পজিশনে কী সব প্লেয়ার! অথচ আমরা সে মরশুমে বোধহয় শুধু লিগ ছাড়া আর একটাও ট্রফি জিততে পারিনি। বিরক্তিতে আমি পরের বছরই রিটায়ার করেছিলাম।’’
এ নিয়ে আজও এত অভিমানী যে, চোখের কোণদুটো চিকচিক করে উঠল!
অভিমান, আবেগের কাছে সব সময় যুক্তি কাজ করে না। সময়ের নিরিখ হারিয়ে যায়। অমল দত্তকে যেমন ভাবে দেখলেন, ব্যাখ্যা করলেন মিঞা, সেটাই কি ওই মহান কোচের জন্য যথার্থ? জানি না। এর হয়তো অন্য ব্যাখ্যা অন্যের কাছে থাকতে পারে।
কিন্তু সেই মুহূর্তে জানকীনগরের আহত সম্রাটের গলার বেদনাও বা অস্বীকার করি কী করে?
|
গোল মুখে মহামেডানের হাবিব একই রকম ত্রাস |
সত্যিকারের সম্রাটেরও কি এমনই হয়!
চিরকালের জন্য মুকুট, সিংহাসন, রাজবেশ, রাজ্যপাট ছেড়ে আসার পরে?
কখনও শোকার্ত।
কখনও আবেগের ভারে টলমল।
নিঃসঙ্গ। নিরুত্তাপ। রাগ-যন্ত্রণা-দুঃখ সব তখন যেন মাখামাখি হয়ে নবাবের মুখে ফিকে হয়ে যাওয়া রামধনুর চেহারা নিয়েছে!
আবার বড় বেদনার সেই রামধনুর একটা রং যেন একটা আস্ত ফুটবল-ড্রেসিংরুম হয়ে চিরকালের মতো লেগে রয়েছে বড়ে মিঞার চোখমুখে! যা হায়দরাবাদে বসে আজীবন লালন করে যাবেন তিনি।
একাকী! গোপনে!
(শেষ)
ছবিঃ হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, উৎপল সরকার ও সংগৃহীত
৬ষ্ঠ পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
No comments:
Post a Comment