![]() |
হায়দরাবাদের বাড়িতে মিঞা |
দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৬
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj-Q9Xymzw935spVBKImjLaNz8RIGnbVA5bXk7tuKCxCAYIxwWxhsOTC7pqHdJ7xb1TEP5q2VXr0Cye_CO1xrREbSczwift7-WH1eSz0T75_0W16BQUQkoXS7eyBZVRkjE9dZVDjNhDTF0/s780/Supriyo+Mukherjee+3.jpg)
সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
মানুষটি সাক্ষাৎ কন্ট্রাডিকশন! গোড়াতেই বলেছি।
তেমনই কিছু নজির এই পর্বেও পাবেন।
চলুন গল্পে ঢুকি।
বিবির সামনে হঠাৎই মিঞা।
গড়গড় করে বলেছেন, ‘‘জীবনে পঞ্চাশটা টুর্নামেন্ট জিতেছি। ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাসে আমি প্রথম পাঁচজন হায়েস্ট স্কোরারের মধ্যে পড়ি। ইন্ডিয়া টিমে কুড়ি বছর বয়সের আগে খেলেছি। প্রথম ম্যাচ। ছেষট্টি সাল। উল্টো দিকে থাইল্যান্ড। ভারত দু'গোলে পিছিয়ে। ২০ গজ দূর থেকে ভলিতে গোল করার পর ভৌমিককে দিয়ে গোল করিয়ে ২-২ রেখেছিলাম। তার আগের বছর। মানে, পঁয়ষট্টি সাল। আমার জীবনের প্রথম ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ। তাতেও গোল করেছি। ভারতে সবচেয়ে বড় বিদেশি ক্লাব পেলের কসমস আর শিল্ডের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী টিম রাশিয়ার আরারাত, দুটো ম্যাচেই আমার গোল ছিল।’’
টানা বলতে বলতে উত্তেজিত সম্রাট। থামলেন খানিক।
সত্যিই, আমারও শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোর লাগছিল। হায়দরাবাদের ছোট্ট কুঠুরি সাইজের ড্রইংরুম। আমার সামনে বসা মেরেকেটে সাড়ে পাঁচ ফুটের কোলকুঁজো ষাটোর্ধ্ব বক্তা! হারানো সময় যাঁর ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বলে। আনমনা লাগছিল বড়।
সম্বিত ফিরে পেলাম বড়ে মিঞার পরের কথায়। —
‘‘কিন্তু এগুলো একটাও আমার জীবনের সেরা ম্যাচ নয়। আমার সেরা পারফরম্যান্স আটষট্টির সন্তোষ ট্রফি। সেমিফাইনাল, পঞ্জাব ম্যাচ। তার আগের দিন আমার লাশ কবরে ঢ়োকার কথা। তার বদলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ!’’
মিঞা উছলে উঠলেন আবার। ভিসুভিয়াসের মতো গনগনে দু’টো চোখ!
‘‘কোনও প্লেয়ারের জিন্দেগিতে এরকম আজব ব্যাপার ঘটেনি!’’
শুনে অবাক হয়ে ভাবছি, এই মানুষটার মধ্যেই কিনা এখন আর আগুন জ্বলে না।
মাঝে মাঝেই নিস্তেজ, শীতল হয়ে পড়েন!!
এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে??
বারবার মনে হয়েছে, আসলে বয়স নয়, তাঁকে তাড়া করেছে শুধুই ক্লান্তি।
পেনাল্টি বক্সে বারবার ছোবল মারা সেই ছোট্ট শরীরটা এখন নির্বিষ। নিস্তেজ। ঘরবন্দি। কথায় কথায় বোবা মেরে গিয়েছেন যে কতবার! নৈঃশব্দ ভাঙতে চাইলে হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আর কেন? আমার 'আমি'টার যখন 'মৃত্যু' ঘটেছে, অহেতুক এই খুঁড়তে চাওয়া কীসের?
চমক জাগে এ সব কথায়। এ কোন হাবিব?
বলে চললেন মিঞা, ‘‘পঞ্জাব ম্যাচে সেদিন ইন্দর, গুরকৃপাল, মনজিৎ, ভাটিয়া, গুরুদেব, কিষেণ। সব সিংহরা। আমি বল ধরলেই আমাকে সারাক্ষণ বুট দিয়ে বীভৎস লাথি। চোরাগোপ্তা ঘুসি। ল্যাঙ্। কনুইয়ের গুঁতো। তবু আমাকে মাঠ থেকে বার করতে পারেনি। পুরো টাইম খেলেছিলাম। কিন্তু মাঠ থেকে বেরিয়েই মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে সাইডলাইনে মুখ থুবড়ে পড়ি। সেখান থেকে সটান হাসপাতাল। সারা গায়ে কালসিটে পড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে সারারাত স্যালাইন।’’
ম্লান হাসলেন মিঞা।
তারপরই চড়া সুরে বলে চললেন, ‘‘আগের দিনের ড্র সেমিফাইনালের পরের দিনই রিপ্লে। আমি হাসপাতালে। আমাকে বাদ দিয়েই তাই সকালে হোটেলে বাংলার গেমপ্ল্যানিং চলছিল। আর আমি ঠিক সেসময়ই সেখানে গিয়ে হাজির!’’
উচ্চগ্রামে হাসি এবার।
উল্টো দিকে বসে আমি হাঁ।
বলে কী লোকটা?
বাকিটা হাবিব-পত্নী রাইসার মুখ থেকে শুনুন।
‘‘ওকে দেখে তো বাংলা দলের বাকিদের প্রায় ভূত দেখার অবস্থা! সবার অবাক প্রশ্ন, আরে হাবিব? তুই এই অবস্থায় কী করে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলি? তা মিঞা টিমকে বলেছিল, কীভাবে আবার? নিজেই স্যালাইনের সূচ হাত থেকে খুলে হাসপাতালকে পার্সোনাল বন্ড দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে এলাম।’’
যেন লাঞ্চ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিনেমা হলে চলে এলেন হাবিব!
দাঁড়ান, দাঁড়ান।
অবিশ্বাস্য কান্ডের এখানেই শেষ নয়।
আরও আছে।
এরপর পঞ্জাবের বিরুদ্ধে রিপ্লে সেমিফাইনাল। মাঠে নেমে ইন্দর-গুরদেবদের রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন হাবিব। গোল করেন। বাংলাকে জেতান। হন ম্যান অব দ্যা ম্যাচ!
তারপরেও কিন্তু ময়দানের চিরলড়াকু নবাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাঁর সেরা পাসটা নাকি বরাদ্দ থাকত ভাই আকবরের জন্য।
আর বাকিদের হসপিটাল পাস!
অভিমানী নবাব ধমকে ওঠেন এ কথায়, ‘‘একদম গলত্ বাত্।’’
বলতে থাকেন, ‘‘তব্ শুনিয়ে দাদা, পাসগুলো আকবর যেমন বুঝত, সেরকমভাবে শ্যাম, সুভাষ, রঞ্জিত, সুরজিৎ, সাব্বির, কেউ বুঝতে পারত না। তাই মাঠে খেলা দেখে লোকের হয়তো মনে হতে পারে, আমি ম্যাচের সবচেয়ে ভাল পাসটা আকবর ভাইয়াকেই দিয়েছি। কিন্তু আসলে কী জানেন? আকবর গোলের জন্য অপোনেন্ট পেনাল্টি বক্সে মরে যেতেও রাজি ছিল। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা। দুর্দান্ত পজিশন জ্ঞান। প্রায় নিখুঁত। দু'পায়েই সমান জোরে ভলি মারতে পারত। দারুণ পাওয়ারফুল হেডার। বাকিদের চেয়ে বেশি গোল তো করবেই আকবর। অবাক হওয়ার কী আছে এতে!’’
তখন কথায় কী দমক!
বড়ে মিঞা-ওয়ান। নাকি বড়ে মিঞা-টু। বারবার এমন মুডের বদল কোনও মানুষের হয়!!
আফসোস। আফসোস। মনে এখনও গোলকুন্ডা ফোর্টের বিশাল উঠোনে একদিন পায়রা ওড়াতে ওড়াতে বড়ে মিঞা বললেন, ‘‘ষাটের দশকের মাঝামাঝি সন্তোষ ট্রফিতে বাংলাকে নাস্তানাবুদ করে হারিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের যে দলটা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তার থেকে নঈম, আফজল আর আমাকে জ্যোতিষদা (গুহ) পরের সিজনেই ইস্টবেঙ্গলে সই করিয়েছিলেন। নঈম ওনাকে বরাবর জ্যোতিষসাব বলে ডাকলেও আমি প্রথম দিন থেকে ‘জ্যোতিষদা’ বলতাম। তা প্রথম বড় ম্যাচেই আমি মোহনবাগানকে গোল দেওয়ায় জ্যোতিষদা আমাকে ডেকে বলেছিলেন, হাবিব, তুম ইস্টবেঙ্গল টিম মে বড়ে মিঞা হো। কিন্তু তার কিছুদিন বাদে শ্রীমানীদা (অজয় শ্রীমানি) আমাকে কথায় কথায় বলেছিলেন, ইস্টবেঙ্গলের আসল বড়ে মিঞা হল আমেদ খান। আর তুই হলি বড়ে মিঞা জুনিয়র।’’
তার মানে তো লাল-হলুদে একজোড়া বড়ে মিঞা!
এখানেও এক আর দুই।
বড়ে মিঞা এক, বড়ে মিঞা দুই!
ঠিক ভারতীয় ক্রিকেটে দুই লিটল মাস্টারের মতো।
গাভাসকর। লিটল মাস্টার ওয়ান।
তেন্ডুলকর। লিটল মাস্টার টু!
(চলবে)
ছবিঃ উৎপল সরকার ও সংগৃহীত
৫ম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
![]() |
বছরকয়েক আগে কলকাতার হোটেলে উঠে পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে হাবিব-আকবর জুটি |
![]() |
১৯৭৭। এক ফ্রেমে পেলে-চুনী-পিকে'র মাঝে মহম্মদ আকবর। মোহনবাগান-কসমস ম্যাচের পর গ্র্যান্ড হোটেলে টিম ডিনারে |
৭ম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
No comments:
Post a Comment