আমার তিনি ‘খিদ্দা’ আপনাদের মতি নন্দী ১ম পর্ব
ক্রীড়া সাংবাদিক
সালটা ১৯৮৯।
আনন্দবাজার পত্রিকার অফিস। স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট। সন্ধেবেলা।
সদ্য কয়েক মাস হল তখন, ওখানেই জয়েন করেছি।
প্রথম বারের মতো ম্যাচ-রিপোর্ট করে এডিটর মতি নন্দীর টেবিলে জমা দিলাম। নিজের চেয়ারে বসে মতিদা।
সামনে দাঁড়িয়ে আমি।
চোখের সামনে দেখছি, আমার লেখা পাতাগুলো হুশ হুশ করে চোখ বুলিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বাঁ হাতে করে উড়িয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। ফস্ ফস্ করে সেগুলো গিয়ে পড়ছে কোনও টেবিলের খাঁজে। নয়তো চেয়ারের নীচে। এর ওর তার পায়ের তলার গুঁজিতে।
দেখছি। আর দু’চোখ বেয়ে জল নামছে শুধু আমার।
আশপাশের টেবিলে বসে কপি লিখতে লিখতে এ পাশে আড় চোখে তাকাচ্ছে যারা, আজ তাদের চেনাতে একটা শব্দও খরচা করতে লাগে না।
মানস চক্রবর্তী। গৌতম ভট্টাচার্য। অশোক রায়।
গৌতম আমার স্কুলবেলার সহপাঠী। বাকিরা সিনিয়র। ‘দাদা’ ডাকি। তাতে অস্বস্তি, লজ্জা মিশিয়ে কান্নার তোড়টা যেন আরও বেড়ে গিয়ে গলার কাছে লটকে যাচ্ছে।
|
মতিদার তিন ‘ছাত্র’ (বাঁ দিকে থেকে) আমি, গৌতম, মানসদা
|
কলকাতা লিগ। মহামেডান স্পোর্টিংয়ের ম্যাচ। জীবনের প্রথম ম্যাচ কভার করতে যাওয়া ওটাই। মহমেডান মাঠে। সাদা-কালো জার্সির প্রতিপক্ষ কে ছিল সেদিন, এই ৩০-৩১ বছর পরে এখন আর ঠিক মনে নেই। জর্জ টেলিগ্রাফ কী বাটা হবে।
আগের দিন ডেকে মতিদা বলে দিয়েছিলেন, ‘‘কালকের ম্যাচটা কভার করবে।’’
শুনেই আমার কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল। ঠক ঠক করে হাঁটুতে-হাঁটুতে লাগছিল যেন! বুঝতে পেরে মতিদার উপদেশ, ‘‘এখন সাড়ে সাতটা। আটটায় লাইব্রেরি বন্ধ। এখনই ওপরে যাও। পুরনো ম্যাচ রিপোর্ট দেখে নাও। কী ভাবে লেখা হয়।’’
বাধ্য ছাত্রের মতো সুড় সুড় করে চলে গিয়েছিলাম লাইব্রেরিতে।
মনে আছে, ম্যাচটা বোধহয় দু'গোলে জিতেছিল মহামেডান।
মতিদা তখন কাগজেকলমে স্পোর্টস এডিটর নন। কিন্তু আমি লিখতে বসার আগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ক’পাতা লিখবে?’’
আমি তাকিয়ে আছি ভ্যাবলার মতো।
দেখে বললেন, ‘‘তোমার এক পাতায় কত শব্দ ধরে?’’
তখন হলদেটে খসখসে ছোট ছোট নিউজ প্রিন্টের পেপারে ‘কপি’ লিখতে হত।
বললাম, ‘দেড়শো।’
‘‘তাহলে পুরো তিন পাতা লিখে আমাকে দেখাও।’
সেই তিনটে পাতা-র গল্প দিয়ে এই লেখা শুরু করেছি।
মতিদা একটা একটা করে পাতা দেখছেন। আর সটান সিলিং ফ্যান ঘোরা ছোট কিউবিকলের দিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
মধ্য কুড়ির ঘর পেরিয়েও আমার চোখের কোলে তখন টলটলে জল!
এত খারাপ ম্যাচ-রিপোর্ট লিখেছি!
মুখ তুললেন মতিদা।
‘‘কী ভাবছ? যাও, কাগজগুলো তুলে নিয়ে এসো।’’
কড়া মাস্টারমশাই-সুলভ নির্দেশ!
|
খুব ভক্ত ছিলেন গাভাসকারের
|
প্রায় কাঁপতে কাঁপতে সেই নির্দেশ পালন করার পরেই এক আশ্চর্য জাদুকরকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। ইন্দ্রজালের প্রথম অধ্যায়! আমার কপি ‘সাব’ করতে বসলেন মতিদা। মানে কেটেছেঁটে ‘কপি’টা দাঁড় করাবেন।
শেষে বেয়ারাকে ডেকে কাগজগুলো ডিটিপি-তে কম্পোজ করতে পাঠিয়ে দিলেন।
ঠিক সাড়ে সাতটা নাগাদ বেরিয়ে যেতেন মতিদা। সোজা ‘চাঙওয়া’। সেদিনও তাই।
চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে ডাকলেন। তারপর যে কথাগুলো বললেন, আজ এই ষাট পেরোনো জীবনেও ভুলিনি। ভুলবও না কোনওদিন। সেই থেকে কোথাও কোনও লেখা দিলে, সেটা ছেপে বেরনোর পর আমার প্রথম কর্তব্যই হয়ে গিয়েছে, মতিদার সেই নির্দেশ পালন করা! — ‘‘ছাপার অক্ষরে নিজের লেখাটা নিজেই একবার আদ্যপান্ত পড়বে। তাতে কী লিখেছিলে, আর কী ছেপে বেরিয়েছে, সেটা নিজেই বোঝার চেষ্টা করবে!’’
পরের দিন।
সকালে বাড়িতে আনন্দবাজার আসতেই নিজের লেখাটা খুললাম।
বড়জোর আট-দশটা সেন্টেন্সকে পাল্টে একটু এদিকওদিক করে দিয়েছেন। আর তাতেই বেড়াল হয়ে গিয়েছে রুমাল!
সেই প্রথম গোটা একটা ইন্দ্রজাল-পর্বের শেষ দৃশ্য দেখা শেষ হল আমার!
সুভাষ ভৌমিক তখন সদ্য ‘আজকাল’ থেকে জার্সি বদল করে আনন্দবাজার-এ। বিশেষজ্ঞ ফুটবল কলামনিস্ট। বিকেলে ডিপার্টমেন্টে আড্ডা দিতে এলেন। ঢুকেই আমায় দেখে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন, ‘‘আরে সুপ্রিয়, ওই লাইনটা তো ফাটিয়ে দিয়েছ!’’
আমি হাঁ। সুভাষদা বলে যাচ্ছেন।
‘‘গোলের পর গ্যালারিতে মহামেডান সমর্থকদের গগনভেদী চিৎকারের শব্দ বোধহয় এসপ্ল্যানেডের বাস গুমটির দেওয়ালে এসে আছড়ে পড়ছিল! আহা! কী লিখেছ! চালিয়ে যাও। চালিয়ে যাও।’’
লজ্জা-লজ্জা মুখ করে তাকিয়ে রইলাম।
আর প্রশংসা শুনতে শুনতে নিজেকে শুধু বলছিলাম, এ প্রশংসাটা ঠিক আমার প্রাপ্য নয়। আমার গুরুমশাইয়ের গুপ্তমন্ত্রের দান। কাগজে ঢুকে সেই প্রথম মতিদাকে আমার মনে মনে প্রণাম করা।
|
শ্যাম থাপার সেই বাই সাইকেল কিক
|
মাত্র দশ মাস।
দশ মাস কাগজের অফিসে কোনও টাইমই নয়। ওইটুকু সময়েই পেয়েছি মতিদাকে।
কিন্তু ওই দশ মাসে ওঁর কাছ থেকে যা শিখেছি, তাকে জুড়লে আলিবাবার রত্নগুহা পাত্তা পাবে না। গোল্ডেন নয়, বলব প্ল্যাটিনাম রাইটিং কোচিং ছিল মতিদার!
বলতেন, ‘‘যুগান্তরীয় বাংলা লিখবে না। আসর, আঙিনা এ সব শব্দ না। ও গুলো জলসার জন্য। তৎসম শব্দ ব্যবহার করে করে লেখা হল মান্ধাতা আমলের। আধুনিক গদ্য হল মুখের ভাষা। ঠিক যা ভাবছ, মুখে বললে যা বলতে, সেটাই লেখো। চেষ্টা করো ক্রিয়াপদ দিয়ে পরপর বাক্যগুলো শেষ না করতে। ‘করলেন’, ‘গেলেন’ এগুলো সেনটেন্সের ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে। ‘ভার্ব’ দিয়ে বাক্য শেষ করাটা এড়িয়ে যাও।’’
মাত্র দশ মাস!
আমার ৩২ বছরের পেশাদার ক্রীড়াসাংবাদিক জীবনের এ গুলোই আস্ত মূলধন। মনে মনে ঠিক তখন থেকেই কেমন যেন ঈশ্বরের পাশাপাশি বসিয়ে ফেলেছিলাম ওঁকে।
অথচ আমি কিন্তু মতিদার ফ্যান সেই ইস্কুলবেলার গন্ডি পেরনোর আগেই।
ক্লাস সেভেন থেকে গোগ্রাসে গিলছি ওঁর একের পর এক উপন্যাস।
আর মতিদার ম্যাচ রিপোর্ট?
কেউ স্বীকার করুক, আর না করুক, আমি বলব আমার অন্তত ওগুলোই ছিল ‘বর্ণ পরিচয়’, ‘সহজ পাঠ’, ‘ধারাপাত’, ‘কিশলয়’ কী ‘র্যাপিড রিডার্স’। কিংবা পি আচার্যর নোটবই!
যতদূর মনে পড়ছে ১৯৭২ সাল।
ভারত-ইংল্যান্ড হোম সিরিজ।
মতিদা লিখলেন, ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে সোলকারের মর্মর মূর্তি স্থাপন করা উচিত। আহা কী লাইন!
নেহরু কাপে তাঁর নিজের একটা লেখার হেডিং করলেন। খেলাটা ছিল ভারত বনাম ইতালি। মাঝমাঠ শাসন করল প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তার দু’পায়ের ড্রিবলিং, পাসিং-এ। মতিদা লিখলেন, ‘শিল্পের টানে আমরা জমির কয়েক ইঞ্চি ওপরে উঠে গেলাম’! ভাবুন একবার, এ হল খেলার পাতার হেডিং! যে কোনও সাহিত্যের উঠোনে অনায়াসে যা কলার তুলে ঢুকে পড়তে পারে।
মুম্বইতে গাভাসকরের ডাবল সেঞ্চুরির পর লিখলেন, রবিশঙ্করের সেতারও ভুল করতে পারে, গাভাসকরের ব্যাট করবে না।
১৯৭৮। লিগের ডার্বি। শ্যাম থাপার ‘বাই সাইকেল কিক’-এ মোহনবাগানের জয়ের গোলকে যেভাবে জোয়ারের টানে ভেসে আসা ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন মতিদা, আজও ভুলতে পারিনি।
বাকিরা ম্যাচ লিখতেন। উনি কবিতা রচনা করতেন।
সেই মতিদাকে আমার এডিটর পাওয়া, আনন্দবাজারে পা রেখেই!
এখনও স্বপ্নের মতো মনে হয়।
ঘোর লাগে!
কাগজে ঢোকার আগেই আন্দাজ পেতাম, গাভাসকারকে দারুণ পছন্দ করেন মতি নন্দী। তাঁর শৃঙ্খলা। তাঁর মনোনিবেশ ক্ষমতা। তাঁর ধৈর্যকে।
কিন্তু আমি যখন মতিদাকে পেলাম, মনে হল ব্যক্তিগত জীবনের মতিদা ঠিক তার উল্টো। বোহেমিয়ান। উড়ো-উড়ো। অনেকটা সত্তর দশকের শিল্পী-সাহিত্যিক। প্রকাশ্যে টুসকি মেরে, চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মধ্যবিত্তর ঘোমটাবাজিকে ঘেন্না করা মধ্যবয়সি তাজা যুবক। জীবনের অনেক কিছুতেই যিনি সামাজিক লাইসেন্স-এর তোয়াক্কা করেন না। মদ্যপান। প্রেম। কথায় কথায় নিষিদ্ধ শব্দের ব্যবহার।
ছবিঃ সৌজন্যে প্রতিবেদক
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা
Ashdharon lekha
ReplyDeleteThank you so much Joy
Delete