দূর্গতিহারিণী - বলতেন ইয়ান বোথামের জীবনী ঘরে বসে টুকে না লিখে মাঠে যাও মশলা পাবে পর্ব ২ - সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়


বলতেন ইয়ান বোথামের জীবনী ঘরে বসে টুকে না লিখে মাঠে যাও মশলা পাবে ২য় পর্ব
সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
অন্যকে যাচাই করার ‘ট্রিটমেন্ট’গুলোও ছিল মতিদার এক্কেবারে বাউন্ডারি বাইরের টেক্সট। গৌতমের (ভট্টাচার্য) একটা গল্প বলি। শোনা গল্প। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এ তখন গৌতম শিক্ষানবীশ ডেস্ক-সাব। সেখান থেকে খুব শখ আনন্দবাজারে ক্রীড়া সাংবাদিকতার। তো, ও গিয়েছে মতিদার কাছে। মতিদা ওর পরীক্ষা নিতে একটা অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ চাইল‌েন। ঠিক ওই সময়ে কপিল-গাভাসকরের প্রবল কট্টাকট্টি। সেই ঝামেলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। যাচাই-এর তরিকা, বুঝলেন কিছু! রূপকদার (সাহা) গল্পটা আর এক কাঠি বাড়া! নিজের একটা ম্যাচ রিপোর্টে ‘বাই লাইন’ (নিজের নাম) দাবি করে বসলেন রূপকদা। প্রকাশ্যেই। ক্রীড়া সম্পাদক তখন মতি নন্দী। ৩৬ পয়েন্টে (কাগজের হেডিংয়ের যেটা পয়েন্ট সাইজ তখন) রূপক সাহার নাম দিয়ে দিলেন, 'শায়েস্তা' করতে! ভাবুন, শুধু ‘ট্রিটমেন্ট’ কাকে বলে! আড়া ব্যাটে বারবার এমন ছক্কা হাঁকাতে দেখেছি মতিদাকে। লোকে বলত দুর্মুখ। মুখফোড়। যা নয় তাই বলে। হতে পারে। আমি কিন্তু ওই কঠিন খড়বড়ে মুখটার পিছনে মিষ্টি জলের ঝরনাটাও দেখেছি! সে আমার পরমতম সৌভাগ্য!
এই ষাট পেরনো বয়সেও ওঁর কথা মেনে চলি
মতিদা তাঁর বিখ্যাত ক্রীড়া উপন্যাস ‘শিবা’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন এই অধমকে। সঙ্গে প্রশ্রয়মূলক আদরের সংযোজন— ‘‘নরম মনের ছেলের এত ঢুসুমঢিসুম সহ্য হবে তো?’’ আসলে 'শিবা' ছিল এক তরুণ বক্সারের লড়াকু প্রত্যাবর্তনের কাহিনি। আমার বিয়ের বৌভাত। মনে আছে। উত্তর কলকাতার বাড়ি থেকে মতিদা আসবেন। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে আমার ভাড়া করা বিয়েবাড়িতে। খুঁজতে খুঁজতে এলেনও। তারপর আমাকে সস্ত্রীক আশীর্বাদ করেই ছদ্ম ‘ঝাড়’, ‘‘এই বুড়ো বয়সে আর্থারাইটিসের পায়ে আমাকে দেড় মাইল হাঁটালে?’’ বহু কপি উল্টেপাল্টে সংশোধন করে দিয়েছেন। এমনকী এক-দু’বার নিজেও লিখে দিয়েছেন এই সামান্য ক্রীড়া সাংবাদিকের হয়ে! পাশাপাশি একই সঙ্গে দিয়েছেন সফল সাংবাদিক হওয়ার অমোঘ সব শর্ত। বলতেন, ‘‘টুকে লিখবে না। টুকে লিখবে না। ইয়ান বোথামের জীবনী কলকাতায় বসে লিখতে চেয়ো না। তাতে কিস্যু হবে না। তার চেয়ে শীতের দুপুরে ময়দানে খোলা মাঠগুলো ঘুরে বাংলার ক্রিকেটের অবস্থা দেখে এসো। তাতে লেখার মশলা বাড়বে।’’ ১৯৮৯-৯০ মরশুম। বাংলা ৫১ বছর পর রঞ্জি ট্রফি জিতল। প্রতিপক্ষ দিল্লি। ইডেনে পিচের গুড লেংথ স্পট ভিজে থাকায় শেষ দিনের খেলা বানচাল। ড্রেসিংরুমে কীর্তি আজাদ, রামন লাম্বারা চিফ গ্রাউন্ডসম্যান ভৈরব গাঙ্গুলির ওপর রীতিমতো চোটপাট চালাচ্ছে। সাজঘরের ভেতর। দরজা খোলা। ঘটনার একমাত্র মিডিয়া-সাক্ষী আমি। পরদিন আনন্দবাজারের জন্য তার খবর লিখলাম। পুরো ‘আঁখো দেখা হাল’। কপিটা ভেতরের পাতায় দিলেন রূপকদা। বিকেলে অফিসে পৌঁছে মতিদা দ্ব্যর্থহীনভাবে রূপকদাকে বললেন, ‘কপিটা আজকের খেলার পাতায় লিড স্টোরি হওয়া উচিত ছিল। বাংলা এত বছর বাদে রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হলেও তার আসল ইনসাইড স্টোরি ওটাই।’’ এই হলেন মতিদা! রগচটা। দুর্মুখ। বজ্রকঠিন। ঠিক কথা। তার আড়ালে ভীষণ নরম একটা মন লুকিয়ে ছিল ওঁর মধ্যে। যে কারণে বিচারের ধরনটাতেও সেই ছোঁওয়াটা লেগে থাকত, লোকের চোখে বা কানে যা খটখটে, রুক্ষ্ম। কিন্তু মতিদা অমনই। স্বতন্ত্র। আলাদা। অনেকের চেয়ে আলাদা। স্যাঁতসেঁতে, ভেজা-ভেজা, ন্যাতানো নয়। চাপা আগুনে পেস বোলার যেন! কিংবা প্রতিপক্ষের জাল ফুঁড়ে দেওয়া পাঞ্চের ক্ষমতা রাখা ধুরন্ধর ‘টাফ’ স্ট্রাইকার!
রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা ১৯৮৯-৯০

আর ছিল তুঙ্গস্পর্শী আত্মবিশ্বাস। অমনটা কার মধ্যে দেখেছি! নইলে ভরা ক্রিকেট-ফুটবলের জমানায় আনন্দবাজারের মতো কাগজে খেলার পাতায় মাঝেমধ্যেই সাঁতার, অ্যাথলেটিক্স, কী দিব্যেন্দু বড়ুয়ার দাবাড়ু-জীবন নিয়ে লিড স্টোরি করার ‘ধক’ দেখান! আসলে মতি নন্দী হলেন বাংলা ক্রীড়া সাংবাদিকতায় গেম-চেঞ্জার। সর্বপ্রথম গেম-চেঞ্জার। অন্যরা এক। উনি অনন্য। তবু এক-এক সময়ে দুঃসাহসী ভাবনায় গুরুকেই মনে মনে চ্যালেঞ্জ দিয়ে ফেলি— আজকের সর্বগ্রাসী টেলি-মিডিয়ার যুগে, লাইভ কভারেজের আমলে মতি নন্দী কি পেরে উঠতেন? কলম হাতে? কিংবা এডিটরের টেবিল সামলাতে! পরক্ষণেই আনন্দবাজার-এ বহুশ্রুত একটা ঐতিহাসিক কথোপকথন মনে পড়ে যায়। আর থমকে যাই। মনে ম‌নে প্রণাম ঠুকি আমার সাংবাদিকতার এক ঈশ্বরকে! ‘‘পারতেন রঞ্জি সিংজি আধুনিক সময়ে মানিয়ে নিয়ে ব্যাটিং করতে?’’ অভীক সরকার একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন এবিপি পাবলিকেশন-এ স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড-এর এডিটর টাইগার পটৌডিকে।
নবাব পটৌডি

অভীকবাবুর যুক্তি ছিল, মডার্ন ফিল্ডিং স্ট্র্যাটেজি তো রঞ্জির সেই বিখ্যাত লেগ গ্লান্স থামিয়ে দিত। রানটা তা’হলে আসত কোথা থেকে? পটৌডি উত্তরে ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, ‘‘লেগ গ্লান্স হয়তো থেমে যেত। কিন্তু তার বদলি অন্য কোনও সমান স্কোরিং শট উনি নিশ্চয়ই বার করতেন। ওই পর্যায়ের জিনিয়াসের উদ্ভাবনী ক্ষমতাই আলাদা! ওটা আন্দাজ করা যায় না।’’ আমি শুধু রঞ্জির নামটা পালটে ‘মতি নন্দী’ বসিয়ে ‘টেলিমিডিয়া’ যুগ নিয়ে ওই প্রবাদপ্রতিম মানুষটিকে জড়িয়ে আমার অমন বামন-বামন ভাবনাটার ইতি ঘটাই। মনে মনে নাক-কান মুলে গুরুকে প্রণাম জানাই। সার্থকনামা ওই মানুষটা! হিরে, জহরতের সহোদর। দ্য গ্রেট মতি নন্দী! আমার এডিটর। আমার পরমেশ্বর।

শেষ ছবিঃ সৌজন্যে প্রতিবেদক ​ ১ম পর্বে যেতে হলে এই বাক্যটিতে ক্লিক করুন
 

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

2 comments: