Saturday, May 1, 2021

চাঁদ সওদাগরের কাহিনি তবে কল্পকথা নয়




চাঁদ সওদাগরের কাহিনি তবে কল্পকথা নয়

সৌমেন জানা
শিক্ষক, মুর্শিদাবাদ
চাঁদ সদাগর নাকি আদতে মুর্শিদাবাদের এক বণিক! নবাবি আমল নয়, মুর্শিদাবাদের জন্ম রাজা শশাঙ্কেরও বহু আগে? স্থানীয় লোককথা এমনই বলে! যে কোনও ইতিহাসপ্রেমীর মাথায় চক্কর লাগিয়ে দেওয়ার জন্য এ দু’টি তথ্যই ঢের। তার ওপর মুর্শিদাবাদে গোটা একটা যুগ কাটিয়ে এমন ধুঁয়াধার খবর কস্মিনকালেও পাইনি। ফলে পায়ের তলায় সরষে দানা চিড়বিড়িয়ে উঠল। ফল? বাইকে চেপে সোজা ধাঁ। গন্তব্য আমার আবাস মুর্শিদাবাদেরই কান্দি থেকে অল্প দূরে জজান!
সোমেশ্বর ঘোষের বংশধরদের রাজবাড়ি
যাচ্ছি আর ভাবছি। যুদ্ধ, দেশপ্রেম, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক চক্রান্ত, বেইমানি, আত্মত্যাগ। এবং অবশ্যই হাজারদুয়ারি। এর বাইরে বড়জোর পলাশীর যুদ্ধ। এছাড়া তো মুর্শিদাবাদ ঘিরে কিচ্ছুটি মনে পড়ে না। কিন্তু এ কী শুনলাম!! নবাবি আমল নয়, খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক যে রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, সেটিও ছিল মুর্শিদাবাদেরই কর্ণসুবর্ণে! চাঁদসওদাগর তো রূপকথা, অ্যাদ্দিন তাই জানতাম। কিন্তু এ তো বাস্তবের কথা বলে! পৌঁছলাম অতীতের পাতায় হারিয়ে যাওয়া এক প্রাচীন রাঢ়ীয় গ্রামে। জজান। ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়ে। কান্দি শহরের থেকে ৫ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে। আগে নাম ছিল জয়জান। পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই জজানের চেহারা তেমন আলাদা নয়। শস্য-শ্যামলা। সুজলা-সুফলা। বিশ শতকের স্পর্শে আধুনিক অনেক বাড়ি থাকলেও অনেক মাটির বাড়িও চোখে পড়ল।
রাজবাড়িটির কিছু এখনও বর্তমান
কায়স্থদের কুলগ্রন্থে থেকে জেনেছি, ৮০৪ শকাব্দ অর্থাৎ ৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে কায়স্থ বংশীয় সোমেশ্বর ঘোষ অন্যান্য চারজন কায়স্থের সঙ্গে মহারাজা আদি শূরের রাজসভায় এসেছিলেন। উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থগণের কুলগ্রন্থে তারা সকলেই শ্ৰীশ্ৰী চিত্রগুপ্তদেবের অন্যতম পুত্ৰ শ্ৰীকর্ণের বংশধর বলে উল্লেখ। এখনও উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থরা ‘শ্ৰীকরণ’ নামে পরিচিত। ইতিহাস বলে, ওই জয়যান গ্রামের চারপাশের বহু গ্ৰাম নিয়ে একটি সামন্ত রাজ্য গঠিত হয়। মহারাজ আদিত্যশূর বার্ষিক ১৫ শত টাকা কর নিৰ্দ্ধারণ করে সোমেশ্বর ঘোষকে এই সামন্ত রাজ্যের রাজা করে তোলেন। সোমেশ্বর ঘোষ এখানে সোমেশ্বর শিব মন্দির ও সর্বমঙ্গলা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে সেই প্রাচীন মন্দিরগুলি আজ আর নেই। তার বদলে রয়েছে তুলনায় নতুন মন্দির। অবশ্য সোমেশ্বর ঘোষের বংশধরদের রাজবাড়িটির কিছু এখনও বর্তমান। যদিও রাজবাড়িটি দেখে তার বয়স অনুমান করা সম্ভব না হলেও খুব প্রাচীন নয় বলেই মনে হল। এখন কোনও রাজা নেই। নেই পাইক-পেয়াদা, নেই রাজা-মন্ত্রী। রানীমহলে রানী-মাও নেই, নেই দাস-দাসী। নেই দরবার, প্রজাদের আনাগোনা। ঘোড়াশালে ঘোড়া উধাও, হাতিশালে নেই হাতি। আছেটা কী? জরাজীর্ণ মলিন বদন রাজবাড়িটি। চুরি হয়ে গেছে তার গরিমা। তার আভিজাত্য। জৌলুস। হারিয়েছে তার প্রতাপ। বদলে পালে পালে চামচিকের দল। অথচ এক সময় সবই ছিল। কারুকাজে ভরা বিশাল অট্টালিকা। শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। রাজবাড়ির যত ঠাটবাট, সব।
সর্বমঙ্গলা মন্দির
ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি তল্লাটে। কাঁচা-পাকা রাস্তা বেয়ে। গাছগাছালিকে সঙ্গী করে। সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দির। গ্রামের আর এক পুরাতন ঐতিহ্য। স্থানীয়দের মুখে তার গল্প শুনলাম, রাজা সোম ঘোষ ‘স্বপ্নাদেশ’ পেয়ে এই মন্দিরের দেবী মূর্তিটি এক পুস্করিনী থেকে তুলে আনেন। তারপর প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। বর্তমান মন্দিরের গায়ে একটি প্রস্তর ফলক। সেখানে খোদাই করে লেখা— ৭০০ শকাব্দ, রামেশ্বর দত্ত, ৩৬০ বিঘা ভূমি দান। রামেশ্বর দত্ত। এই মানুষটিরই কথা জেনে প্রথমেই তাক লেগে গিয়েছিল। ওই অঞ্চলের পুরনো লোকেরা ওঁকে বলতেন চাঁদ সওদাগরের বংশধর। অনুমান, রামেশ্বর দত্ত থাকতেন জজানের পশ্চিমে। বোদপুর গ্রামে। সেখানে একটি অঞ্চলের নাম রামদত্তের ডাঙা। জায়গাটি একসময় ছিল ‘গড়’ দিয়ে ঘেরা। তিনিও সেখানে সর্বমঙ্গলা মন্দির স্থাপন করেন। প্রথম যেখানে মন্দির গড়েন সেই স্থানটি আজও লোকে ডাকে ‘দেবস্থান’। রামেশ্বর দত্ত নিয়ে আর বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তবে সে কালে যে মানুষটি দেবীর পূজা নির্বাহের জন্য একসঙ্গে ৩৬০ বিঘা দান করেছিলেন, বলা বাহুল্য তিনি ছিলেন অতি সঙ্গতি সম্পন্ন এক মানুষ। দেবী সর্বমঙ্গলার সাবেক মন্দিরটি বয়সে অনেক নবীন হলেও তার ওপরের কারুকার্যগুলি যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও দেবী সর্বমঙ্গলা সাড়ম্বরে পূজিত হন। হয়্তো সেই প্রাচীন জাঁকজমক নেই। জজান এককালে নদী ও বিলের কাছে থাকায় জলপথে বাণিজ্য করার প্রচুর সুযোগ ছিল। এই কারণে এই সমস্ত অঞ্চলে অনেক বণিক সেকালে বসবাস করতেন। কান্দি-জজানের খুব কাছেই হিজলের বিল। যার সঙ্গেই চাঁদ সওদাগরের নাম ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে। কান্দির এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হিজলের নিম্নভূমি। বর্ষাকালে সেখানে বানের জল জমে। হিজল বিলের পাশ দিয়ে দ্বারকা আর ময়ুরাক্ষী নদী বয়ে যায়।
রাজবাড়িটির জরাজীর্ণ মলিন বদন
শোনা যায়, মা মনসার অভিশাপে এই হিজলের বিলেই নাকি চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা ডুবেছিল। এখনও হিজলের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে মা মনসার প্রভাব বর্তমান। মনে পড়ে যায়— "মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ/ চম্পার কাছে/ এমনই হিজল-বট-তমালের নীল/ ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ/দেখিয়াছে।" এখন হিজলে বাঁধ দিয়ে বহু জমি চাষযোগ্য করা হয়েছে। হিজলকে ঘিরে অনেক জমিদারি ছিল, তারা তাদের সুবিধামতো বাঁধ দিয়ে একটা সময় থেকে জমি ভরাট করে চাষ-আবাদ শুরু করেছে। ফলে বহু জমি ভরাট হয়ে গিয়েছে। বলা বাহুল্য, অপরিকল্পিতভাবেই। এক সময় হিজল কান্দি জেমো ও বাগডাঙ্গার জমিদারদের যৌথ খাজনা আদয়ের অন্তর্ভূত এলাকা ছিল।পরে গোটা অঞ্চলটি কয়েকটি জমিদারি মালিকানায় বিভক্ত হয়ে যায়। নদীর জল যাতে প্লাবিত হতে না পারে, তাই নিজের নিজের এলাকা মাটির বাঁধ বা ঘের দিয়ে ঘিরে নেওয়ার ‘চল’ এখানে। তাই হিজলকে অনেকে 'ঘের'ও বলে। যেমন— মাখনবাবুর ঘের , সোনাডাঙা ঘের, ষোলোভাগি ঘের ইত্যাদি। চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে যে এই এলাকাগুলির সম্পর্ক আছে তার প্রমাণ মেলে পদ্মপুরাণে — নবদূর্গা গোলহাট বামেতে রাখিয়া/চলিল সাধুর ডিঙা পাটন বহিয়া/দক্ষিন পাটনে যবে গেইলা সদাগর/শঙ্খ-মুক্তা-চুনি আইনা বোঝায় কৈলা ঘর। এখনও সেই পাটনের বিল বহাল। সরকারি হিসাব বলে, এককালে জলা ছিল তিন হাজার বিঘার। বিলের সাক্ষ্য মেলে কায়্স্থ কারিকাতেও। সেখানে লেখা, নবদূর্গা গোলহাটকে বাঁ দিকে রেখে চাঁদ সওদাগরের নৌকা পাটনের বিল দিয়ে যাতায়াত করত। ঘুরতে ঘুরতে কেবলই বুঝতে পারছি, নবদূর্গা গোলহাট, কল্লা, জজান গ্রামগুলি চাঁদ সওদাগরের চিহ্ন কী ভাবে বয়ে নিয়ে চলেছে আজও! কিন্তু চাঁদ সওদাগর কোথাকার বাসিন্দা ছিলেন? কেউ বলেন, তিনি আসলে পূর্ব বর্ধমান জেলার চম্পাই নগরীর বাসিন্দা। আবার কেউ কেউ বলেন বিপ্রদাস পিপলাই তাঁর মনসাবিজয় (মনসামঙ্গল) কাব্যে চাঁদ সদাগরের যাত্রাপথের বর্ণনায় চিৎপুর, বেতড়, কালীঘাট, চূড়াঘাট, বারুইপুর, ছত্রভোগ, বদ্রিকুণ্ড, হাথিয়াগড়, চৌমুখি, সাতামুখি ও সাগরসঙ্গমের (সাগর দ্বীপ), ব্যান্ডেলের নাম উল্লেখ করেছেন। এমনকী বাংলাদেশ বা অসমের অনেক জায়গাতে আজও চাঁদ সওদাগরের স্মৃতি বিজড়িত চিহ্ন বর্তমান। তাহলে? এ নিয়ে আজ অবধি কেউ কোনও গবেষণা করেননি। আসলে প্রায় সবাই মনে করেন, চাঁদ সওদাগরের আসলে কোনও বাস্তবিক ভিত্তিই নেই! একটি কল্পচরিত্র মাত্র! অথচ জজানে এসে সে কথা ভাবাও যেন ধৃষ্টতা! এমন তার আবেশ, এমন তার লতায়পাতায় মাখা লোককথা! ফিরতি পথে উজান-হাওয়ায় জজান কিছুতেই মন ছাড়ে না। বুকের কাছটা কেমন কেমন লাগে! লোককথা, কল্পকাহিনি, ইতিহাস সব মিলিয়ে হারানো সড়কের খোঁজটা কী ভেবে মিলবে? জানিনা! ঋণঃ ১.বংশ-পরিচয় (অষ্টম খণ্ড) - জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার, ২. মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি – কমল বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

Tuesday, April 20, 2021

দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৭

২০১৫। ১ অগস্ট। ইস্টবেঙ্গল দিবস-এর মঞ্চে সেবারের 'ভারত গৌরব' পুরস্কার হাতে মহম্মদ হাবিব


দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৭

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
মহম্মদ হাবিবের সঙ্গে কেন জানি না, আমি দিলীপকুমারের মিল পাই! আমার কাছে ময়দানের ফুটবলের নেতাদের নেতা, দ্য গ্রেট হাবিব! ওদিকে বলিউডে শ’খানেক স্টার থেকে সুপারস্টার, সুপারস্টার থেকে মেগাস্টার এলেও 'অ্যাক্টর অফ অ্যাক্টরস্' বলতে বরাবর একজনের কথাই আমার চোখে ভাসে। তিনি দিলীপকুমার। সত্তরের দশকের ময়দানের মহা দুষ্ট চতুষ্টয় পর্যন্ত বড়ে মিঞার দাদাগিরির সামনে কাত্! যে দুষ্ট চতুষ্টয়কে সামলাতে গিয়ে মহাগুরু পিকে পর্যন্ত কেঁদে ফেলেছিলেন মুম্বইয়ে রোভার্স ফাইনালের সকালে! সে গল্প দিয়েই শুরু করি। সেই রোভার্স কাপটা জিতলে পিকে-র ইস্টবেঙ্গল ভারতীয় ফুটবলের নয়া নজির গড়বে। কিন্তু ফাইনালের সকালে ঘড়ির কাঁটায় তখন এগারোটা। তখনও হোটেলে সুধীর-পিন্টু (সমরেশ চৌধুরী) বা সুভাষ-গৌতমের ঘরের দরজা খোলার নামগন্ধ নেই।
রোভার্স কাপ। দিলীপকুমারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন ভাই আকবর
কয়েক ঘণ্টা পরেই ফাইনাল। কখনই বা টিম মিটিং করবেন? কখনই বা সুধীর-সুভাষরা খেয়েদেয়ে তৈরি হবেন? অপারগ পিকে প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে লাল-হলুদে সেবারের সবচেয়ে সিনিয়র ফুটবলার হাবিবের শরণাপন্ন।— ‘‘দ্যাখ না বাবা, ছেলেগুলোর যদি মরার ঘুম ভাঙাতে পারিস! ভোররাত পর্যন্ত ফূর্তি করবে, আর বেলা বারোটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোবে!’’ কোচের 'কান্নাকাটি' দেখেই হাবিব ‘ফায়ার’! দাবানল লেগে গেল তাঁর চোখেমুখে! গলা ফাটিয়ে বললেন, ‘‘সালো, ক্যা সমঝতে হ্যায় খুদ কো?’’ লাথি মেরে প্রায় দরজাই ভেঙে ফেলেন সুভাষ-পিন্টুদের আর কী! যারা নিজেরাও তখনই এক-একজন সুপারস্টার ফুটবলার। অন্য কেউ হলে ধুন্ধুমার লেগে যেত। কিন্তু তিনি যে নেতাদের নেতা। বড়ে মিঞা। তাঁর রুদ্রমূর্তির সামনে বাঘ-সিংহও কেঁচো! অবস্থা সামলে গেল লাল-হলুদ শিবিরে। এই না হলে রাজার রাজা! একটা কথা প্রায়ই ভাবি। একটু অন্য প্রসঙ্গ যদিও। তবু বলি। গোটা সত্তরের দশকজুড়ে তো বটেই, আশির দশকের গোড়াতেও, হাবিবের প্রতি মরশুমে ময়দানের হায়েস্ট পেইড ফুটবলার থেকে যাওয়ার রহস্যটা কী? তার সঙ্গে চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব? এখানেও কিন্তু বিস্তর অবাক করা কাজকারবার চোখে পড়ে। যা সচরাচর ময়দানে বিরল। এর ফাঁকে একটা কথা বলে নিই। তাকে কি পেশাদারিত্ব বলবেন, না স্নেহ, নাকি অন্য কিছু, জানি না।
শূন্যে আলিঙ্গনে বন্দি, শ্যাম থাপার সঙ্গে মোহনবাগানী হাবিব
সেসময় প্রতি বছর ফুটবলে ডাবল স্ট্রাইকারে খেলার স্ট্র্যাটেজি নিতেন হাবিব। দলবদলের আগে। ময়দানের তিন প্রধান, যারা হাবিবকে নিতে আগ্রহী, তাদের কর্তাদের বড়ে মিঞা, ভাই আকবরকে নিয়ে সই করানোর দর হাঁকতেন। এর ব্যাখ্যা তিনি কী দেন? প্রশ্ন করতে উত্তর এল— ‘‘ওই টাকার অ্যামাউন্টে আমার কত আর আকবরের পেমেন্ট কত, সেটা আলাদা করে থাকত না। ইচ্ছে করেই রাখতাম না। ফলে যখন যে ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি করতাম, দিনের শেষে প্রতি বছর দেখা যেত আমার টাকার অঙ্কটা ময়দানে সবার চেয়ে এক টাকা হলেও বেশি!’’ হাসতে লাগলেন শাহেনশা। কিন্তু অভিনব পেশাদারিত্ব? যা আজও কিংবদন্তী হয়ে ময়দানের মাঠে, ঘাসে, গ্যালারিতে, তাঁবুতে পাক খেয়ে বেড়ায়! তার ব্যাখ্যা হাবিব স্বয়ং কীভাবে দিয়ে থাকেন? শুনুন তবে। তাতেও বিস্তর অবাক হওয়ার রসদ লুকিয়ে! — ‘‘দেখিয়ে দাদা, বড় বড় অফিস যেমন ভাল ভাল অফিসারকে চাকরি দেয়, তেমনই বড় ফুটবল ক্লাব করে। আবার বড় অফিসার যেমন আগে থেকে দেখে নেয়, কোন বড় অফিসটা বেশি ভাল, বেশি মাইনে দেবে, তারপর সেই অফিসে কাজে জয়েন করে, আমিও তাই। প্রতি বছর দলবদলের সময় দেখেবুঝে নিতাম ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডানের মধ্যে কোন দলটা সে বছর সবচেয়ে ভাল হচ্ছে। আর সেটা বুঝে সেইমতো সবচেয়ে ‘টাফ’ দলটায় সই করতাম। না, না, এর জন্য আমার কোনও লজ্জা নেই। আরে, সেরা দলে খেললেই তো নিজের সেরা পারফরম্যান্সটা বেরোবে! ঠিক যেমন সেরা অফিসে একজন অফিসার তার সেরা কাজটা করতে পারে। দেখবেন সবসময় আমার দলের মাঝমাঠে গৌতম-পিন্টু বা প্রসূন-গৌতম, উইংয়ে সুভাষ-সুরজিৎ বা মানস-বিদেশ, সেকেন্ড স্ট্রাইকার শ্যাম, আকবর বা সাব্বির থেকেছে। আর ওদের মতো ফুটবলারদের নিজের পাশে পেয়ে আমি আরও বেটার খেলেছি।’’ সাফ কথা বড়ে মিঞার। স্মৃতি হাতড়ে দেখলাম, এক-দু’ মরসুম অবশ্য মিঞা ছিলেন ভাই ছাড়া। কিন্তু তখন এতই অন্য মুডে, অন্য ঢঙে, অন্য বিচরণের মুক্ত হাওয়ায় প্রাণের কথা বলছিলেন, সে প্রসঙ্গ তুলতে কেমন মায়া হল!
১৯৮০। ইস্টবেঙ্গল। জামশিদের সঙ্গে উল্লাসে
এখান থেকেই চলে গেলাম তাঁর মহাগুরু পিকে এবং কোচ পিকের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অমল দত্তের মধ্যে তুলনাতে। অদ্ভুত জবাব তাতেও!— ‘‘এটা কোনও তুলনার সাবজেক্ট!’’ ‘কেন?’ ‘‘প্রদীপদা নিজের ভুলটা স্বীকার করতে জানতেন। দুর্ধর্ষ ম্যান ম্যানেজমেন্ট জানতেন। অমলদার সেখানে শুধু 'আমি আমি'। ম্যান ম্যানেজমেন্টে জিরো। বিরাশিতে ইস্টবেঙ্গলে ওনার বাজে ম্যান ম্যানেজমেন্টে বিরক্ত হয়েই আমার প্রথম রিটায়ার করার চিন্তা আসে। অথচ কী দুর্দান্ত টিম সেবার ইস্টবেঙ্গলের! ভাস্কর থেকে বিশ্বজিৎ। সুধীর-মনোরঞ্জন থেকে তরুণ-অলোক। প্রশান্ত থেকে মিহির-অমলরাজ। বিশ্বজিৎ-আকবর-কার্তিক শেঠ! সব ক’টা পজিশনে কী সব প্লেয়ার! অথচ আমরা সে মরশুমে বোধহয় শুধু লিগ ছাড়া আর একটাও ট্রফি জিততে পারিনি। বিরক্তিতে আমি পরের বছরই রিটায়ার করেছিলাম।’’ এ নিয়ে আজও এত অভিমানী যে, চোখের কোণদুটো চিকচিক করে উঠল! অভিমান, আবেগের কাছে সব সময় যুক্তি কাজ করে না। সময়ের নিরিখ হারিয়ে যায়। অমল দত্তকে যেমন ভাবে দেখলেন, ব্যাখ্যা করলেন মিঞা, সেটাই কি ওই মহান কোচের জন্য যথার্থ? জানি না। এর হয়তো অন্য ব্যাখ্যা অন্যের কাছে থাকতে পারে। কিন্তু সেই মুহূর্তে জানকীনগরের আহত সম্রাটের গলার বেদনাও বা অস্বীকার করি কী করে?
গোল মুখে মহামেডানের হাবিব একই রকম ত্রাস
সত্যিকারের সম্রাটেরও কি এমনই হয়! চিরকালের জন্য মুকুট, সিংহাসন, রাজবেশ, রাজ্যপাট ছেড়ে আসার পরে? কখনও শোকার্ত। কখনও আবেগের ভারে টলমল। নিঃসঙ্গ। নিরুত্তাপ। রাগ-যন্ত্রণা-দুঃখ সব তখন যেন মাখামাখি হয়ে নবাবের মুখে ফিকে হয়ে যাওয়া রামধনুর চেহারা নিয়েছে! আবার বড় বেদনার সেই রামধনুর একটা রং যেন একটা আস্ত ফুটবল-ড্রেসিংরুম হয়ে চিরকালের মতো লেগে রয়েছে বড়ে মিঞার চোখমুখে! যা হায়দরাবাদে বসে আজীবন লালন করে যাবেন তিনি। একাকী! গোপনে! (শেষ) ছবিঃ হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, উৎপল সরকার ও সংগৃহীত ৬ষ্ঠ পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

Wednesday, April 14, 2021

দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৬

হায়দরাবাদের বাড়িতে মিঞা


দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৬

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
মানুষটি সাক্ষাৎ কন্ট্রাডিকশন! গোড়াতেই বলেছি। তেমনই কিছু নজির এই পর্বেও পাবেন। চলুন গল্পে ঢুকি। বিবির সামনে হঠাৎই মিঞা। গড়গড় করে বলেছেন, ‘‘জীবনে পঞ্চাশটা টুর্নামেন্ট জিতেছি। ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাসে আমি প্রথম পাঁচজন হায়েস্ট স্কোরারের মধ্যে পড়ি। ইন্ডিয়া টিমে কুড়ি বছর বয়সের আগে খেলেছি। প্রথম ম্যাচ। ছেষট্টি সাল। উল্টো দিকে থাইল্যান্ড। ভারত দু'গোলে পিছিয়ে। ২০ গজ দূর থেকে ভলিতে গোল করার পর ভৌমিককে দিয়ে গোল করিয়ে ২-২ রেখেছিলাম। তার আগের বছর। মানে, পঁয়ষট্টি সাল। আমার জীবনের প্রথম ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ। তাতেও গোল করেছি। ভারতে সবচেয়ে বড় বিদেশি ক্লাব পেলের কসমস আর শিল্ডের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী টিম রাশিয়ার আরারাত, দুটো ম্যাচেই আমার গোল ছিল।’’ টানা বলতে বলতে উত্তেজিত সম্রাট। থামলেন খানিক। সত্যিই, আমারও শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোর লাগছিল। হায়দরাবাদের ছোট্ট কুঠুরি সাইজের ড্রইংরুম। আমার সামনে বসা মেরেকেটে সাড়ে পাঁচ ফুটের কোলকুঁজো ষাটোর্ধ্ব বক্তা! হারানো সময় যাঁর ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বলে। আনমনা লাগছিল বড়। সম্বিত ফিরে পেলাম বড়ে মিঞার পরের কথায়। — ‘‘কিন্তু এগুলো একটাও আমার জীবনের সেরা ম্যাচ নয়। আমার সেরা পারফরম্যান্স আটষট্টির সন্তোষ ট্রফি। সেমিফাইনাল, পঞ্জাব ম্যাচ। তার আগের দিন আমার লাশ কবরে ঢ়োকার কথা। তার বদলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ!’’ মিঞা উছলে উঠলেন আবার। ভিসুভিয়াসের মতো গনগনে দু’টো চোখ! ‘‘কোনও প্লেয়ারের জিন্দেগিতে এরকম আজব ব্যাপার ঘটেনি!’’ শুনে অবাক হয়ে ভাবছি, এই মানুষটার মধ্যেই কিনা এখন আর আগুন জ্বলে না। মাঝে মাঝেই নিস্তেজ, শীতল হয়ে পড়েন!! এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে??
বছরকয়েক আগে কলকাতার হোটেলে উঠে পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে হাবিব-আকবর জুটি
বারবার মনে হয়েছে, আসলে বয়স নয়, তাঁকে তাড়া করেছে শুধুই ক্লান্তি। পেনাল্টি বক্সে বারবার ছোবল মারা সেই ছোট্ট শরীরটা এখন নির্বিষ। নিস্তেজ। ঘরবন্দি। কথায় কথায় বোবা মেরে গিয়েছেন যে কতবার! নৈঃশব্দ ভাঙতে চাইলে হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আর কেন? আমার 'আমি'টার যখন 'মৃত্যু' ঘটেছে, অহেতুক এই খুঁড়তে চাওয়া কীসের? চমক জাগে এ সব কথায়। এ কোন হাবিব? বলে চললেন মিঞা, ‘‘পঞ্জাব ম্যাচে সেদিন ইন্দর, গুরকৃপাল, মনজিৎ, ভাটিয়া, গুরুদেব, কিষেণ। সব সিংহরা। আমি বল ধরলেই আমাকে সারাক্ষণ বুট দিয়ে বীভৎস লাথি। চোরাগোপ্তা ঘুসি। ল্যাঙ্। কনুইয়ের গুঁতো। তবু আমাকে মাঠ থেকে বার করতে পারেনি। পুরো টাইম খেলেছিলাম। কিন্তু মাঠ থেকে বেরিয়েই মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে সাইডলাইনে মুখ থুবড়ে পড়ি। সেখান থেকে সটান হাসপাতাল। সারা গায়ে কালসিটে পড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে সারারাত স্যালাইন।’’ ম্লান হাসলেন মিঞা। তারপরই চড়া সুরে বলে চললেন, ‘‘আগের দিনের ড্র সেমিফাইনালের পরের দিনই রিপ্লে। আমি হাসপাতালে। আমাকে বাদ দিয়েই তাই সকালে হোটেলে বাংলার গেমপ্ল্যানিং চলছিল। আর আমি ঠিক সেসময়ই সেখানে গিয়ে হাজির!’’ উচ্চগ্রামে হাসি এবার। উল্টো দিকে বসে আমি হাঁ। বলে কী লোকটা? বাকিটা হাবিব-পত্নী রাইসার মুখ থেকে শুনুন। ‘‘ওকে দেখে তো বাংলা দলের বাকিদের প্রায় ভূত দেখার অবস্থা! সবার অবাক প্রশ্ন, আরে হাবিব? তুই এই অবস্থায় কী করে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলি? তা মিঞা টিমকে বলেছিল, কীভাবে আবার? নিজেই স্যালাইনের সূচ হাত থেকে খুলে হাসপাতালকে পার্সোনাল বন্ড দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে এলাম।’’ যেন লাঞ্চ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিনেমা হলে চলে এলেন হাবিব! দাঁড়ান, দাঁড়ান। অবিশ্বাস্য কান্ডের এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। এরপর পঞ্জাবের বিরুদ্ধে রিপ্লে সেমিফাইনাল। মাঠে নেমে ইন্দর-গুরদেবদের রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন হাবিব। গোল করেন। বাংলাকে জেতান। হন ম্যান অব দ্যা ম্যাচ! তারপরেও কিন্তু ময়দানের চিরলড়াকু নবাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাঁর সেরা পাসটা নাকি বরাদ্দ থাকত ভাই আকবরের জন্য। আর বাকিদের হসপিটাল পাস! অভিমানী নবাব ধমকে ওঠেন এ কথায়, ‘‘একদম গলত্ বাত্।’’ বলতে থাকেন, ‘‘তব্ শুনিয়ে দাদা, পাসগুলো আকবর যেমন বুঝত, সেরকমভাবে শ্যাম, সুভাষ, রঞ্জিত, সুরজিৎ, সাব্বির, কেউ বুঝতে পারত না। তাই মাঠে খেলা দেখে লোকের হয়তো মনে হতে পারে, আমি ম্যাচের সবচেয়ে ভাল পাসটা আকবর ভাইয়াকেই দিয়েছি। কিন্তু আসলে কী জানেন? আকবর গোলের জন্য অপোনেন্ট পেনাল্টি বক্সে মরে যেতেও রাজি ছিল। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা। দুর্দান্ত পজিশন জ্ঞান। প্রায় নিখুঁত। দু'পায়েই সমান জোরে ভলি মারতে পারত। দারুণ পাওয়ারফুল হেডার। বাকিদের চেয়ে বেশি গোল তো করবেই আকবর। অবাক হওয়ার কী আছে এতে!’’ তখন কথায় কী দমক! বড়ে মিঞা-ওয়ান। নাকি বড়ে মিঞা-টু। বারবার এমন মুডের বদল কোনও মানুষের হয়!!
১৯৭৭। এক ফ্রেমে পেলে-চুনী-পিকে'র মাঝে মহম্মদ আকবর। মোহনবাগান-কসমস ম্যাচের পর গ্র্যান্ড হোটেলে টিম ডিনারে
আফসোস। আফসোস। মনে এখনও গোলকুন্ডা ফোর্টের বিশাল উঠোনে একদিন পায়রা ওড়াতে ওড়াতে বড়ে মিঞা বললেন, ‘‘ষাটের দশকের মাঝামাঝি সন্তোষ ট্রফিতে বাংলাকে নাস্তানাবুদ করে হারিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের যে দলটা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তার থেকে নঈম, আফজল আর আমাকে জ্যোতিষদা (গুহ) পরের সিজনেই ইস্টবেঙ্গলে সই করিয়েছিলেন। নঈম ওনাকে বরাবর জ্যোতিষসাব বলে ডাকলেও আমি প্রথম দিন থেকে ‘জ্যোতিষদা’ বলতাম। তা প্রথম বড় ম্যাচেই আমি মোহনবাগানকে গোল দেওয়ায় জ্যোতিষদা আমাকে ডেকে বলেছিলেন, হাবিব, তুম ইস্টবেঙ্গল টিম মে বড়ে মিঞা হো। কিন্তু তার কিছুদিন বাদে শ্রীমানীদা (অজয় শ্রীমানি) আমাকে কথায় কথায় বলেছিলেন, ইস্টবেঙ্গলের আসল বড়ে মিঞা হল আমেদ খান। আর তুই হলি বড়ে মিঞা জুনিয়র।’’ তার মানে তো লাল-হলুদে একজোড়া বড়ে মিঞা! এখানেও এক আর দুই। বড়ে মিঞা এক, বড়ে মিঞা দুই! ঠিক ভারতীয় ক্রিকেটে দুই লিটল মাস্টারের মতো। গাভাসকর। লিটল মাস্টার ওয়ান। তেন্ডুলকর। লিটল মাস্টার টু! (চলবে) ছবিঃ উৎপল সরকার ও সংগৃহীত ৫ম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
  ৭ম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা