Wednesday, March 31, 2021

দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৫

১৯৭৫ নিয়ে তাঁর দুঃখবোধ আজও বহাল


দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৫

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
আবার পরের দিন। সকাল। জানকীনগরের বাড়ি। সোফায় বসা বড়ে মিঞা। দূর থেকে তখন আজানের স্বর ভেসে আসছে। আল্লা....আ...আ... মিঞার চোখ সিলিঙের দিকে। থমথমে মুখে। গায়ে দুধসাদা পাঞ্জাবি। কালো চশমার আড়ালটা এদিন নেই। ঈষৎ ফ্যাকাশে লাগছে যেন চার দশক আগের ময়দানের নবাবকে। একটু পৱেই আমরা ঢুকে পড়লাম মধ্য সত্তরের এক বিতর্কিত অধ্যায়-এ। তার শুরুতেই তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপরই যেন শব্দ হারিয়ে ফেললেন। অস্ফূটস্বরে বললেন, ‘‘কসুর মেরা ভি থা। লেকিন উও লোগ সব বেকার কর দিয়া!’’ আসলে ১৯৭৫-এ লাল-হলুদ জনতাকে ভাসিয়ে দিয়ে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিংয়ে চলে যান হাবিব। একা নয়। সঙ্গে আকবর, লতিফুদ্দিন, মহম্মদ নাজির। টানা পাঁচবার কলকাতা লিগ জেতার পুরনো গৌরব তখনও মহমেডানের দখলে। ময়দানে রটেছিল 'কট্টর মৌলবাদী' হাবিব চাননি মহমেডানের সেই রেকর্ড ভেঙে যাক সেবছর ইস্টবেঙ্গলের হাতে। তাই সেবার লাল-হলুদ জার্সি ত্যাগ! এমনকী হাবিবের মহাগুরু, তখনকার ইস্টবেঙ্গল কোচ পিকে-ও নাকি ঘরোয়া আড্ডায় সেই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেননি! অথচ তার আগে পর্যন্ত ১৯৭০-৭৪, পাঁচ বছর হাবিব ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময় টানা ১৯৩২ দিন মোহনবাগানের কাছে হারের মুখ দেখেনি লাল-হলুদ। তা সত্ত্বেও 'মিস্টার ফাইটার অফ ইন্ডিয়ান ফুটবল'-এর বিরুদ্ধে ১৯৭৫-এ ওই অভিযোগ!
৭০ দশক। কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। লাল-হলুদ ব্রিগেডকে নির্দেশ দিচ্ছেন সাইড লাইন থেকে
মহায়দরাবাদের বাড়িতে তাঁর সামনেই কথাটা তোলার আগে ভাবছিলাম এবার নির্ঘাত ফেটে পড়বেন। টেপরেকর্ডার বন্ধ-টন্ধ করিয়ে সটান বলে দেবেন, ইন্টারভিউ এখানেই শেষ। কিন্তু ২০১৫-র হাবিব কী করেছিলেন? হো হো করে হাসতে লাগলেন! সাতষট্টির (এই মুহূর্তে বাহাত্তর চলছে মিঞার) প্রৌঢ় শরীরটা সোফায় প্রায় গড়িয়ে পড়ার জোগাড়। ‘‘আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান! এটা তো জানতাম না? হাবিব ফান্ডামেন্টালিস্ট? হাবিব?’’ আবার অট্টহাসি! খানিকটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি! এক পলক দেখে বড়ে মিঞা ফের বললেন, ‘‘আমি যদি সত্যিই এতটা গোঁড়া মুসলিম হতাম তা’হলে তো সবচেয়ে বেশি মহমেডানে খেলতাম! অথচ সবচেয়ে কম বছর খেলেছি ওই ক্লাবে। ইস্টবেঙ্গলে খেলেছি আট বছর। মোহনবাগানে সাত বছর।’’ থামলেন একটু। তারপরেই প্রচন্ড সিরিয়াস ঢঙে টানা বলে চললেন— ‘‘পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গল ছাড়ার দুঃখ আজ ৪০ বছর পরেও আমি পাই। ওই ভুলের জন্য নিজেকে কোনওদিনও ক্ষমা করতে পারব না আমি। ইস্, আগের পাঁচ বছর থাকলাম, আর ইস্টবেঙ্গলের রেকর্ডের বছরেই থাকলাম না! আমার ভুলের জন্য আকবরও একটা বিরাট গৌরবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারেনি। যার জন্য আমার ভাইয়ার কাছেও আমি আজীবন লজ্জায় থাকব। আসলে কী জানেন? ইস্টবেঙ্গলে তখন সেক্রেটারি ডাক্তারদা (ডাঃ নৃপেন দাস)। দারুণ মানুষ। দারুণভাবে ক্লাব চালাচ্ছিলেন। টিম টানা ছ'বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নতুন রেকর্ড করার পথে। সেটা হলে ক্লাবে ডাক্তারদার হাত আরও শক্ত হবে। কিন্তু সেটা ইস্টবেঙ্গলেরই একটা গোষ্ঠীর কর্তারা সেবার চাইছিলেন না। এরাই ঘুরিয়ে রটিয়ে দিয়েছিলেন, মুসলিম হাবিব-আকবর নাকি চায় না মহমেডানের রেকর্ড ভেঙে যাক। এবার ওরা দলে থাকলে সাবোটাজ করবে। তাই ওদের দলে রেখো না। কোচও নাকি সেরকম ভাবছে। আমিও ওই রটনায় প্রচন্ড রেগেমেগে একদিন প্রদীপদার সঙ্গে ঝগড়া করে বসেছিলাম। তাতে সেসময় প্রদীপদাও আমার ওপর খানিকটা রেগে ছিলেন। এখন শুধু ভাবি, ইস্! আমি যদি একবার নিজের থেকে ডাক্তারদার সঙ্গে এ নিয়ে সরাসরি কথা বলতাম, তা’হলে জীবনের এত বড় ভুলটা করে বসতাম না!’’
ডা. নৃপেন দাস। প্রাক্তন ইস্টবেঙ্গল সাধারণ সচিব
আফসোস। আফসোস। মনে এখনও তাজা গভীর ক্ষত। ভীষণ মায়া লাগছিল, এমন সময় ওঁকে দেখতে। বয়স বাড়লে মানুষ তো খানিক ‘শিশু’ও হয়ে পড়ে! কিছু স্মৃতি টাটকা হলেও নিজের বয়সটাও ঠিকমতো জানান দিতে পারে না। তিনদিনে তিনরকম বললেন! একবার বললেন, ‘‘একষট্টি চলছে।’’ আর একদিন, ‘‘আমার নাইনটিন ফর্টিনাইনে জন্ম।’’ তা’হলে হয় ছেষট্টি বছর। আমি হিসেব করছিলাম হাবিব 'অর্জুন' হয়েছিলেন গুরদেব সিংহেরও দু'বছর পর। বেশ মনে পড়ে। ফেডারেশনের তুঘলকি কারবারের সে ছিল ভয়ঙ্কর নিদর্শন। সেই ঘটনা আপমর ফুটবল-প্রেমী ভোলেনি। অথচ দেশের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার সাল-তারিখ আজ বেমালুম ভুলে মেরেছেন হাবিব? কী বলব একে? বার্ধক্য? বললাম, ‘‘অর্জুনটা কোথায়? এ বাড়িতে? না আগের বাড়িতে?’’ হাঁ করে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘‘কে জানে? বিবি বোধহয় জানে। শেষবার তো ওটা পুরনো বাড়ির আলমারিতেই দেখেছিলাম। যতদূর মনে হচ্ছে!’’ আমি সালটা বিলক্ষণ মনে করতে পারি। ১৯৮০। গুরদেব ১৯৭৮। অথচ সময়ের কথা উঠতে অবলীলায় বড়ে মিঞা বললেন, ‘‘আমার শাদি ’৭৩-এ। আর তারপরের বছরই অর্জুন।’’ এরপরে এই মানুষের বাকি সব ট্রফি, মেমেন্টোর খোঁজ নেওয়ার আর মানে হয়? (চলবে) ছবিঃ উৎপল সরকার ও সংগৃহীত ৪র্থ পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
  ৬ষ্ঠ পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

No comments:

Post a Comment