![]() |
২০১৫। অগস্ট ১। 'ইস্টবেঙ্গল গৌরব' পুরস্কার নিতে এসে ড্রেসিংরুমের প্রিয় দশ নম্বর ড্রয়ার-লকারের সামনে |
দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ২
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj-Q9Xymzw935spVBKImjLaNz8RIGnbVA5bXk7tuKCxCAYIxwWxhsOTC7pqHdJ7xb1TEP5q2VXr0Cye_CO1xrREbSczwift7-WH1eSz0T75_0W16BQUQkoXS7eyBZVRkjE9dZVDjNhDTF0/s780/Supriyo+Mukherjee+3.jpg)
সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
পরের দুপুর। দুরুদুরু বুকে ফের হাবিবের মোবাইলে রিং।
কী ভাগ্যিস, বড়ে মিঞাই ফোনটা রিসিভ করলেন।
পরে বুঝেছিলাম, গত চব্বিশ ঘন্টায় মিঞার মন একটু হলেও গলেছিল। সে কারণেই আগেভাগে ঠিক করে নেওয়া সময়ে ফোন করাতে প্রায় ঝট করে নিজেই ফোন ধরেছেন।
তবে হাবিব হলেন হাবিব!
মূর্তিমান এক কন্ট্রাডিকশন!
একবার বললেন, ‘‘কী লাভ বলুন তো আপনার এত দূর এসে আমাকে খুঁচিয়েখাচিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করার?’’
পরক্ষণেই আবার সেই একই লোক বললেন, ‘‘হায়দরাবাদে এসে কীভাবে আমার বাড়ি খুঁজে বার করবেন? চেনেন হায়দরাবাদের কিছু?’’'
বরফ গলতে শুরু করেছে বুঝে এবার বললাম, ‘স্যার, আপনিই রুটটা বলে দিন না প্লিজ। যেদিন টাইম দেবেন, আমি আর আমার ফটোগ্রাফার সহকর্মী ঠিক তার আগের দিন হায়দরাবাদে পৌঁছে যাব। বেশিক্ষণ থাকব না। কথা দিচ্ছি। সামান্য কিছু কথা। কয়েকটা ছবি। প্লিজ, স্যার!'
কী বুঝলেন, তিনিই জানেন।
তবে একটুক্ষণ চুপ থেকে বেশ কেটে কেটে উচ্চারণ করে বললেন, ‘‘অটোয় প্রথমে হায়দরাবাদের টলি চৌকিতে। তারপর সেখানে জানকীনগরের খোঁজ নেবেন। জানকীনগরে এসে মইন হাইটস মাল্টিস্টোরিড। ওই বাড়িতেই আমাদের ফ্ল্যাট।’’
শুনেটুনে মনে হল নিজামের শহরের বেশ জমকালো অঞ্চলেই ময়দানের ফুটবলের একদা শাহেনশার এখনকার নিবাস!
দু'দিন বাদেই আমি আর উৎপল পৌঁছে গেলাম হায়দরাবাদ।
ওহ্, বলা হয়নি।
উৎপলের উৎসাহে আমরা এই ট্যুরে ওর চেনাজানা একটা ফাইভ স্টার হোটেলে ‘চেক ইন’ করেছিলাম তিনদিনের জন্য। বেশ মোটা কনসেশনে।
প্রথম দিন।
অটো ধরে হাবিবের বাড়ি যেতে গিয়ে এটাও বোঝা গেল যে আমাদের হোটেলটা খুব একটা দূরে কিছু নয়!
অবশেষে হাবিব-সংস্কৃতি-দর্শন!
এবং সেটা ঠিক কীরকম?
শুনুন তা’হলে!
হায়দরাবাদে তিনি এখন স্বেচ্ছানির্বাসিত। ষাটোর্ধ্ব মহম্মদ হাবিবের ডেরায় বসে, তাঁর পুরনো সাম্রাজ্যের অলিগলি হয়ে যে সম্রাটের দেখা পেলাম, তাঁর চোখে চশমা। চুল ধবধবে সাদা। শরীর সামান্য ভারী। বেশিক্ষণ হাঁটলে হাঁপিয়ে ওঠেন। আর সব প্রশ্নেই বলেন, 'মুসকিল আচে।'
অথচ এককালে কিনা তাঁরই অভিধানে 'পারব না' শব্দটা ছিল সীমানার ওপারে। ইনি তাঁর মহাগুরু পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাস্টারপ্ল্যান’ পালটে দিয়েছেন বড় ম্যাচের সেই ঐতিহাসিক ১৭ সেকেন্ডর গোলে। একেই তো ময়দানে ধরা হয় সংযম আর শৃঙ্খলার প্রতীক। আজকের তিনি, পুরনো দুই-এ মাইল-কে-মাইল ফারাক, তবু দুটোই মহম্মদ হাবিব।
এখনকার হাবিব ২০১৫-র।
আগের হাবিব ১৯৭৬-এর!
এই হাবিবকে বেশি প্রশ্ন করলে বিরক্ত হন।
কোনও অতিথি দশ মিনিটের বেশি তাঁর বাড়িতে থাকলে নিজেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে থেকে বুঝিয়ে দেন, এবার আপনি আসতে পারেন।
আমাদেরও প্রথমদিন প্রায় হটিয়েই দিচ্ছিলেন।
কোনওক্রমে কথা সেরেছি, গ্রাউন্ড ফ্লোরে ওঁর যে গেস্টদের বসার ঘর, সেখানে। তারপর দিন থেকে অবশ্য সোজা চার তলার ফ্ল্যাটে।
এই হাবিবের সঙ্গে হায়দরাবাদে দিনকয়েক কাটানোর পরও চার দশক আগের সেই ময়দান কাঁপানো সুপারস্টার ফুটবলারের চার শতাংশও মিল খুঁজে পাইনি!
ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। মেয়ের ফ্ল্যাটে বসা। বৃদ্ধ বয়সকে খানিক দূরে ঠেলে রাখা প্রৌঢ় নবাব।
তার সঙ্গে সত্তর দশকের জেদি হাবিব?
কিচ্ছুটি মেলে না। কিচ্ছুটি না।
কথায় কথায় ’৭৬ সালের সেই ১৭ সেকেন্ডের গোলের কথা উঠল। যে গোল ‘শেল’ বিঁধে দিয়েছিল তার আগের পাঁচবারের সিংহাসনে রাজ করা লাল-হলুদ শিবির আর তার হাজার হাজার ভক্তের বুকে!
‘‘প্রদীপদার মাস্টারপ্ল্যান ছিল, কিক অফের সঙ্গে সঙ্গে আমি আকবরের মাথা টার্গেট করে ইস্টবেঙ্গল পেনাল্টি বক্সের মিডলে উঁচু সেন্টার করব। কিন্তু আমি কোচকে বারবার বলেছিলাম, না, ওদের দু’জন স্টপার লম্বা। ফ্রন্ট হেডিং দু’জনেরই খুব ভাল। গোল না’ও হতে পারে।’’
এরপরেই প্ল্যান-বি’তে ঢুকে পড়া বড়ে মিঞার কথাতেই।
‘‘আমি বললাম, সুধীরের (কর্মকার) ফর্ম একটু হলেও খারাপ যাচ্ছে। আমি গত বছর মহমেডানে থাকায় সুধীরের উল্টোদিকে কয়েকটা ম্যাচ খেলে সেটা বুঝেছি। কিন্তু আপনারা দু’জনেই আগের মরশুমে ইস্টবেঙ্গলে থাকায় সেটা হয়তো ঠিক বোঝেননি। তাই আমি যদি লেফট উইংয়ে উলগাকে লম্বা ক্রস পাঠাই, আর ও সুধীরকে একবার টপকে ওদের বক্সে সেন্টার করে, তা’হলে ততক্ষণে আকবরের পাশে আমিও পৌঁছে যাব হেড নিতে। মানে গোলের ডাবল চান্স।’’
একটানা বলে চলা বড়ে মিঞা তখন যেন 'মাঠে' নেমে পড়েছেন!
একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, ‘‘ব্যাপারটা অত সহজে হয়নি। সেদিন ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে টিমের নামা পর্যন্ত প্রদীপদার সঙ্গে এই নিয়ে খালি তক্ক হয়েছে! কিছুতেই তিনি রাজি হতে চাইছিলেন না। আর ম্যাচের পর? সবার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান মুলে দেওয়ার ভান করে মজা করে বলেছিলেন, আকবরের গোলটা না হলে কিন্তু এই কানমলাটা তুই সত্যি খেতিস! সচ বাত ভাইয়া। উয়ো এক জমানা থা!’’
(চলবে)
ছবিঃ উৎপল সরকার ও সংগৃহীত
১ম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
![]() |
১৭ সেকেন্ডে গোল |
![]() |
মোহনবাগানের ঐতিহাসিক জয়ের রিপোর্টিং ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় |
![]() |
সুধীর কর্মকার |
৩য় পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
No comments:
Post a Comment