মিঞা এবং বিবি |
দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৪
সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
ঔজ্জ্বল্য যেমন আছে স্মৃতিতে, তেমন আছে গভীর দুঃখবোধের নিকষ আঁধার!
এই হল আজকের মহম্মদ হাবিব।
তরতরিয়ে কথা বলেন মাঝে মাঝে।
আবার বেশ বিরক্তও হয়ে যান সময়ে সময়ে।
তিনদিনে যখনই বাড়ির বাইরে বেরিয়েছি মুহুর্মুহু তাগাদা দিয়েছেন, ‘‘বাড়ি চলুন, বাড়ি চলুন। অনেক তো ছবি হল!’’
ব্রেকফাস্ট?
তাতেও ‘মুসকিল আচে’!
তারপর হয়তো’বা ভাই আকবর সঙ্গে আছে ভেবে বলেছেন, ‘‘কী আকবর ভাইয়া? তোর ফেভারিট মশালা দোসা হতে পারে, কী বলিস?’’
পরে জেনেছিলাম, বড়ে মিঞার ফেভারিট ডিশ— মটন বিরিয়ানি, মটন মশালা আর চাপাটি। তিনটেই খোদ নিজামের শহরেও অত সকালের মেনুতে পড়ে না। তাই-ই হয়তো ভাইকে ওই 'পাস'টা বাড়ানো তাঁর প্রিয় দাদার।
এখানে আরও একটা ছোট্ট গল্প বলতে লোভ হচ্ছে।
যার সঙ্গে জড়িয়ে অভিমানী হাবিব আর তাঁর বিবিও!
চার দশক আগে ময়দানের সুপারস্টার ফুটবলার হাবিব তাঁর বিবির জন্য পেলে-ম্যাচের একটা টিকিট ধীরেন দে-র কাছ থেকে জোগাড় করতে পারেননি!
সে অভিমান আজও ভোলেননি।
ময়দানে বহু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখতে গিয়েছেন হাবিবের স্ত্রী রাইসা বেগম। সত্তরের দশকে। থেকেছেন আমিনিয়া হোটেলে।
মজার ব্যাপার হল, কলকাতায় তাঁর বিবির প্রিয় দু’টো খাবারের একটা অন্তত প্রায় হাবিবি-ঘরানার। নিজামের হোয়াইট চিকেন রেজালা! আর তার সঙ্গে তিওয়ারির কাজুবরফি। মিঞা অনেক খাইয়েছেন তাঁকে। এ সব সুখস্মৃতি। তার সঙ্গেও কী ভাবে দুঃখবোধের স্বর লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবনে!
পেলে ম্যাচের আড্ডার শুরু গোলকুন্ডা ফোর্ট-এ। একটু বাদে তার লাগোয়া এবড়োখেবড়ো ভরা রাস্তার উপর মামুলি রেস্তোরাঁ। তা’ও পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে হাবিবের বাড়ির ছোট্ট ড্রইংরুমে।
তিনতলা কিংবা একতলা, দু’টো ফ্ল্যাটেই আড়ম্বরের চিহ্নমাত্র নেই। টিপিক্যাল মুসলিম বাড়ির অন্দরমহল। বাইরের বসার ঘর আর ভেতরের ঘরের মাঝবরাবর ঝলমলে নেটের পর্দাটুকুও বহাল।
বাইরের ঘরে বসে আছি। সামনে বড়ে মিঞা। বিবি রাইসাকে ডেকে পাঠালেন খানিক বাদেই। সেই প্রথম সত্যিকারের খোসমেজাজে সম্রাট!
কয়েক মিনিটের ভেতর ঈষৎ স্থূলকায় চেহারার হাবিব-পত্নী বাইরের ঘরে আসতেই হাবিব বলে উঠলেন, ‘‘এদের বলো পেলে ম্যাচের দিন আমি ঠিক কীরকম অবস্থায় ছিলাম!’’
রাইসার পিছন-পিছন লাইন দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে তাঁদের চার নাতনি।
আরিফা, আতিফা, জেবা, সানা।
ফুটফুটে বাচ্চাগুলো পাঁচ থেকে পনেরোর মধ্যে।
প্রথম দু’জন হাবিবের মেয়ে হারিসার কন্যা। পরের দু’জন হাবিবের ছেলে মহম্মদ হাসিবের তনয়া। পুত্রবধূ সামরিনের সঙ্গে যারা ওই সময়ে জেড্ডা থেকে রমজান মাসটা তাদের দাদুর বাড়িতে কাটাতে এসেছে।
হাবিবের একমাত্র ছেলে এম.টেক।
অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘদিন উচ্চশিক্ষার খাতিরে ডনের দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে।
আবার জেড্ডায় নামী কম্পিউটার সংস্থায় উঁচু পদেও রয়েছেন তিনি।
কোনওকালেই ছেলেকে ফুটবলার করতে চাননি হাবিব।
প্রশ্ন ফেলতেই রাইসা বললেন—
‘‘আসলে আমাদের ওই একটাই ছেলে তো। কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি।’’
এরপর এক নিঃশ্বাসে বলে চললেন, ‘‘তাছাড়া আমার বাপের বাড়ির দিকে সবার প্রচুর পড়াশোনা। খুব শিক্ষিত। ওদের দিক থেকে একটা চাপ ছিল ছেলেকে অনেক দূর পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, বাবার মতো বড় ফুটবলার হওয়ার প্রতিভাও ছিল না হাসিবের।’’
তারপরই পেলে-ম্যাচের কথায় বিবি।
‘‘সেদিন সকাল থেকে ও ভীষণ তেতে ছিল। এতটাই যে তখনকার দিনেও কলকাতা-হায়দরাবাদ ট্রাঙ্ককল করে আমার সঙ্গে ঝাড়া পনেরো মিনিট কথা বলেছিল। কত টাকা বিল উঠছে সেই চিন্তাও ওই মুহূর্তে ছিল না ওর। একবার তো ফোনেই চিৎকার করে উঠেছিল, আরে ছোড়িয়ে তো? পেলে ভি ফুটবলার হ্যায়, ম্যায় ভি ফুটবলার হুঁ। হাম দোনো একই খেল খেলতা হ্যায়। আউর উসকা নাম ফুটবল। পেলে কো ভি আজ ছোড়েঙ্গে নেহি!’’
ভাবা যায়!
পেলের বিরুদ্ধে নামার আগে গোটা পৃথিবীতে হাবিব ছাড়া এরকম কথা কেউ কোনও দিন বলেছে কিনা সন্দেহ!
মিঞা বললেন—
‘‘আসলে মাঠে নামলে কাউকে ভয় পেতাম না। সাপোর্টররা তাই বাঘের বাচ্চা বলে আদর করে ডাকত।’’
হাসি খেলে গেল মিঞার চোখে!
‘‘ম্যাচের পর গ্র্যান্ড হোটেলে ডিনার পার্টি। ধীরেন দে আর প্রদীপদার সামনে পেলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ইউ উড বি ইন্ডিয়ান পেলে,’’ একটানা কথাগুলো বলার সময় বিবি রাইসার সামনে তখন গদগদচিত্ত এতক্ষণের ব্যাজারমুখো মহম্মদ হাবিব-ও!
(চলবে)
ছবিঃ উৎপল সরকার ও সংগৃহীত
৩য় পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
চালক এখন ভাই |
ফুটবল সম্রাটের সামনে লড়াকু নবাব |
৫ম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
No comments:
Post a Comment